হোস্টেলের প্রথম দিনগুলোয় আমার স্থান হয় টিভি রুমে। টিভি’র সামনের অনেকটা অংশ জুড়ে কার্পেট বিছানো। পাশে কয়েকটি বসার টুল। মেঝেতে কিংবা টুলে বসে সবাই টিভি দেখে। বিশালাকৃতির পুরো হলরুমের বাকী অংশ জুড়ে ঢালাও সিঙ্গেল বেডে ঠাসা। কোথাও তিল পরিমান জায়গা নেই। যার যখন খুশি টিভি দেখে। সকাল, দুপুর কিংবা মধ্যরাত। খেলা দেখে কেউবা বিজয়ের আনন্দে লাফিয়ে উঠে। কেউ আবার মধ্যরাতে হরর মুভি দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠে। পড়ার কিংবা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলেও মুখ বুজে থাকাই শ্রেয়। ছোট মানুষদের, নতুন আগতদের যে প্রতিবাদ করার অধিকার নেই ! একবছর বাদে কেউ কেউ রুম পাচ্ছে। ম্যাডাম ষোল নাম্বার রুমের সিনিয়র আপুদের ডাকলেন। আমাকে সেই রুমে দেয়া হবে, জানালেন। কিন্তু তাঁরা তিনজনই আমাকে তাঁদের রুমমেট হিসেবে পেতে চাইলো না। কেন নয়__ সেই ব্যাখ্যায় তাঁরা নীরব থাকলেন। তীব্র আপত্তির মুখে অবশেষে সেই রুমেই আমার জায়গা হয়। তল্পিতল্পা সহ উঠি। প্রতি মুহূর্তে তীব্র অপমানবোধ আর মন খারাপের মাঝে বিষণ্ণ হয়ে থাকি …
আপুরা ডায়নিং এ বসে লাঞ্চ, ডিনার করে না। খাবার তুলে রুমে নিয়ে আসে। রুমের হিটারে বাড়তি ২/১ টি আইটেম রান্না করে। সালাদ করে। অতঃপর সবাই মিলে একসাথে খায় অনেকটা পারিবারিক আবহে। আমি একাকি ডায়নিং রুমে খাই। সন্ধ্যা অবধি রুমে থাকি না। ক্লাস শেষে বান্ধবীদের রুমে, কিংবা ছুটিতে মামা খালার বাসায় থাকি। ক’দিন বাদেই চুপচাপ, প্রতিবাদহীন, নিরীহ আমার জন্যে আপুদের মায়া লাগতে থাকে সম্ভবত। লাঞ্চ কিংবা ডিনারের সময়ে খাবার রেডি করে হোস্টেলের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত হেঁটে হেঁটে আমাকে খুঁজে। ডায়নিং রুম, টিভি রুম, বান্ধবীর রুম… সব স-ব। অতঃপর একত্রে বসিয়ে খাওয়ায়। আমার প্রতি ভুল ধারনা পোষণ করবার জন্যে, মনে কষ্ট দেবার জন্যে সরি বলে। অনুশোচনা করে। খুব ভোরে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। বলে, তোমার বাবা এসেছে। আমি জানালা দিয়ে নিচে তাকাই। বাবা’কে দেখে দৌড়ে নিচে নামি। যেন পিতা-কন্যা’র দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে প্রতীক্ষিত মিলন ! মা’য়ের পাঠানো খাবার সবাই মিলে খাই। অনেক রাত অবধি হাসি গল্পে মেতে থাকি। আমরা ক্রমশ আত্নার আত্মীয় হয়ে উঠি।
এক শুক্রবার আমার ফ্লাইট। দু’দিন আগেই বিকেল আর সন্ধ্যার সন্ধিক্ষণে স্মৃতিময় রুমটিতে যাই। তল্পিতল্পা গুছাই। আধো অন্ধকারে মায়াময় তিনজোড়া চোখ ছল্ছল্ করছিলো। মুখগুলো মলিন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। স্নেহ, ভালবাসাময় টুকরো টুকরো তুচ্ছ ঘটনাগুলো জীবন্ত হয়ে জ্বলজ্বল করে উঠলো চোখের সামনে। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো। আবেগ বহিঃপ্রকাশ হবার ভয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসি প্রিয় রুম আর মানুষগুলো ছেড়ে। বাবা-মা’হীন একাকি সেই সময়টাতে আপন করে নেয়া মানুষগুলো এখন কে কোথায় কেমন আছে জানিনা। কিছুকাল রক্ত সম্পর্কের বাইরে আত্নার আত্মীয় হয়ে থাকা মানুষগুলোকে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে যখন মনে পরে, একগুচ্ছ সাদা রঙের ফুল কিনে টেবিলের ফুলদানীতে সাজাই। পিছনের কালে ফিরে সাদার শুভ্রতায় মুখগুলো, সময়গুলো দু’চোখ ভরে দেখি প্রাণহীন পাথর হয়ে। শেষদিন বিদায়ের সময়টাতে তাঁরা আমায় একগুচ্ছ শুভ্র রজনীগন্ধা দিয়েছিলো, এই ভেবে ……
৩১টি মন্তব্য
মেহেরী তাজ
আপনি আপনার হোস্টেল লাইফ নিয়ে আমাদের জানাচ্ছেন দেখে ভালো লাগছে।
এক রুমে থাকা বড় আপুদের সাথে একটা অন্যরকম ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। তারা চলে গেলে বা তাদের ছেড়ে লেগে কেনো যেন বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে যায়।
রিমি রুম্মান
একরুমে থাকলে তিক্ততা যেমন হয়, ভালোবাসাও তেমনি জন্মায় মনের গহীনে। ছেড়ে যাবার সময় বুঝা যায় অচেনা অজানা মানুষগুলো কতো আপন ছিল।
ব্লগার সজীব
অসাধারন।এত আবেগ দিয়ে লেখা আপনার মত কেউ লিখতে পারেন কিনা জানা নেই আমার।লেখা পড়েই তো হোষ্টেলের আপুদের কাছ হতে বিদায়ের ক্ষনটিতে চোখে পানি এসে গেলো।আপনাকে ঘিরে থাকা মানুষ জন ভালো থাকুক।
রিমি রুম্মান
ওরা আমায় কতোটা ভালোবাসতো চলে আসবার সময়টাতে হাড়ে হাড়ে বুঝি। ওখানে সবাই সবার আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠে। ভাল থাকুন আপনিও।
ছাইরাছ হেলাল
কষ্টমাখা স্মৃতিচারণ সুন্দর করেই তুলে এনেছেন।
রিমি রুম্মান
অনেক শুভকামনা জানবেন।
হিলিয়াম এইচ ই
ভালো লেগেছে। 🙁
রিমি রুম্মান
ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগলো। ভাল থাকবেন।
স্বপ্ন
কত সুন্দর ভাবে স্মৃতির কথা প্রকাশ করলেন আপু।
রিমি রুম্মান
আমার লেখা ভালোলাগা, আমার প্রতি ভালোবাসা হিসেবে দেখি। ভাল থাকুন।
খেয়ালী মেয়ে
হুমমমম হোস্টেলের প্রথমদিনগুলো অনেকটা কষ্টেরই হয়…..নতুন সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগে, আর সেই জায়গায় রুমমেটরা যদি দূরত্ব রাখে তাহলে তো আরও কষ্ট হয়………তবে একসময় এই রুমমেটরাই আত্নার আত্মীয় হয়ে উঠে…………হোস্টেল ছাড়ার সময় দেখেছি এক একজনের বাঁধভাঙা কান্না……………….বরাবরের মতোই ভালো লাগলো আপনার লেখাটা……
রিমি রুম্মান
আমার আপুর ভার্সিটির শেষ সপ্তাহ ছিল যখন, আমাকে নিয়ে যায়। শেষ দিনটিতে সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। আজও চোখে ভাসে। অতঃপর একদিন আমাকেও যেতে হল সেই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। অল্প সময়ে মানুষ মানুষের কতোই না আপন হয়ে উঠে।
জিসান শা ইকরাম
এমনি করেই প্রিয় মানুষদের কাছে রাখুন।
সোনালি দিনের সোনালি মানুষকে ভোলা যায় না।
আপনি ভাল লেখেন,আবারো বললাম 🙂
ভাল থাকুন।
রিমি রুম্মান
প্রিয় মানুষগুলো কাছেই আছে। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এসেও ভুলিনি তাঁদের। মনে পরে খুব সময়ে অসময়ে। কে জানে হয়তো আমার লেখা দেখেই কোন একদিন তাঁরা আমায় খুঁজে বের করবে। আই উইশ…
সীমান্ত উন্মাদ
স্মৃতি চারনটা চমৎকার হয়েছে।
রিমি রুম্মান
চমৎকার থাকুন সবসময়।
শুন্য শুন্যালয়
দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা গুলো আবেগ দিয়ে এভাবে ফুঁটিয়ে তোলেন যেন আমাদের স্মৃতিতেও ঢুকে যায়।
ইচ্ছে করছে আমিও লিখি সেই দিনগুলোর গুলো। প্রিয় মানুষ গুলোর কথা। কিন্তু আপনার মতো এমন করেতো পারবোনা!!
রিমি রুম্মান
আপনি লিখুন। আপনার মত করেই লিখুন। আমাদের এক একজনের লেখা এক এক ভাবে উঠে আসবে। ভাল থাকুন।
মিথুন
চমৎকার আবেগময় লেখা।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন। শুভকামনা নিরন্তর।
ইমন
যাহ! কেঁদেই দিলাম….. -{@
রিমি রুম্মান
নানান ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে বহমান আমাদের জীবন। জীবনের গল্পগুলো কখনো হাসায়, কখনো কাঁদায়।
ইমন
🙁
সিকদার
স্মৃতিচারণ চিরকালই আবেগময় । বর্তমান ধূসর এক কাগজের পাতা অতীত হলেই সেই ধুসর কাগজের পাতা রঙ্গিন হয়ে উঠে ।
রিমি রুম্মান
পিছনে ফেলে আসা সময়গুলো সবসময়ই কি রঙিন ? রঙিনই বটে । নইলে আমরা সেই সময় গুলোয় ফিরে যেতে চাই কেন ?
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
হোস্টেল লাইফ দেখার সৌভাগ্য হয়নি আপনার এবং তাজঁ আপুর লেখা পড়ে পড়ে জানছি তিক্ততাসুখের কথা।লিখতে থকুন দিদি।
রিমি রুম্মান
নানান জায়গার মানুষের সাথে সেই প্রথম মিশার সুযোগ হয়েছিল। অচেনা অজানা হলেও আমরা সবাই সবার এত আপন হয়ে উঠেছিলাম যে, আজ এতগুলো বছর বাদেও ওদের মনে করি, নোনা জলে ভাসি।
নুসরাত মৌরিন
আপু খুব সাধারন চেনা-জানা গল্পগুলোই আপনি এত সুন্দর করে শোনান।মুগ্ধ হয়ে পড়ি।
ভাল লাগলো খুব।
রিমি রুম্মান
এমন মন্তব্যে উৎসাহিত হই। লিখি আবারও। লিখবো আবারও …
লীলাবতী
আপু আপনার এমন লেখা গুলো পড়তে চোখ ভিজে যায়।
রিমি রুম্মান
আমি কি কেবলই সবার চোখ ভেজাই ? আমার হাত দিয়ে এমন লেখাই কেন উঠে আসে, জানা নেই। হাসাতে পারলে ভাল লাগতো নিশ্চিত…