
সোনেলা ব্লগে লেখার জন্য আমার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে প্রথম যে মানুষটি সাড়া দিয়েছিলেন তিনি ব্লগার “আরজু মুক্তা”। একজন মুক্তমনা লেখক, অত্যন্ত স্পষ্টবাদী মানুষ। সোনেলার প্রতি যিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। পরিবার-পরিজন এবং নিজের ব্যক্তিগত কাজের ফাঁকে সময় করে সোনেলায় অন্যান্য লেখকদের লেখাতে তার উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মতো।
তার লেখা সিনেমা রিভিউ থেকে শুরু করে রম্য, কবিতা, গল্প এবং নিজের ভালোলাগা স্বনামধন্য লেখকদের লেখা বইয়ের রিভিউ – এসবের প্রতিটি মাধ্যমেই তিনি নিজেকে দারুণভাবে প্রকাশ করেছেন সোনেলার পাঠকসমাজে। সেই আরজু মুক্তার লেখা আর কখনোই সোনেলায় প্রকাশিত হবেনা এটা মেনে নেয়া সত্যিই কষ্টকর।
আরজু মুক্তার এই পৃথিবীকে চির বিদায়ের খবরটি শুনে অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি অসুস্থতাজনীত মুমূর্ষ অবস্থায় রংপুর মেডিকেলে ভর্তি ছিলেন অনলাইনে অনুপস্থিতির কারনে তা জানতে পারিনি। ব্যক্তিগত কাজে আমি নিজেও ক’দিন থেকে রংপুরের বাইরে ছিলাম। সেদিন সন্ধ্যা হতে তাঁর নাম্বারে অনবরত ফোন করেই যাচ্ছিলাম, কেউ ফোন রিসিভ করছিলো না। বাসার ঠিকানা জানা ছিলোনা বিধায় কাউকে পাঠাতেও পারছিলামনা। তাঁর একমাত্র কন্যা নাবা’র মুখটা স্মৃতিতে ভেসে উঠেছিলো বারংবার।
কোন এক ঈদুল ফিতরের দিন আমার নানা প্রচন্ড অসুস্থ হন, রক্তশূন্যতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। রক্তের জন্য সারা শহরে আমার পরিচিতদের জানিয়ে ফোন দিচ্ছিলাম পাগলের মতো। ফেসবুকে “রক্ত চাই” শিরোনামে একটি সাহায্য পোস্টও দিয়েছিলাম। সেই পোস্ট দেখে আমার কাছে প্রথম যিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ইনবক্স করেছিলেন তিনি ব্লগার আরজু মুক্তা।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তিনি যখন আমাকে ইনবক্স করেন তখন আমার কাছ থেকে তিনি প্রায় হাজার কিলোমিটার দূরে ছিলেন। সেখান থেকেই তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে সেদিন ভার্চুয়াল জগত থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকারে নিজের বোনের মতন আমাকে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। তাও বেশ ক’বছর হয়ে গেলো। হয়তো কোনও একদিন দেখা হবে ভেবে ভার্চুয়ালি ধন্যবাদ জানিয়ে আপনাকে সেদিন ছোট করতে চাইনি আরজু আপু।
তিনি অসুস্থ হবার দুই তিন সপ্তাহ আগে আমাকে বললেন- ভাই, আপনি সোনেলায় আসছেন না কেন? আপনি এডমিন থেকে লীভ নিয়েছেন কেন? আপনি সোনেলায় অনিয়মিত হলে হবে? যে কথাগুলি আর কেউ জিজ্ঞেস করেনি এবং আমি জানি তিনি বোনসুলভ স্নেহের জায়গাটি থেকেই বিচলিত হচ্ছিলেন। তাই তাঁর এসব প্রশ্নের উওর সযচনে এড়িয়ে গিয়ে বলেছিলাম- আপু ব্যস্ততা যাচ্ছে খুব, একটু ফ্রী হলেই নিয়মিত আসবো সোনেলায়। জেনে রাখবেন- সোনেলার সাথে ছিলাম, আছি, থাকবো সবসময়। ভালো কিছুর জন্য পদ, পদবী জরুরি নয়। ভালো মন-মানসিকতাই মননে ধারণ করাটা জরুরী। জানবেন আপনাদের সাথে আমিও আছি।
এইতো সেদিনও দেখা করতে চেয়ে বললেন- ভাই রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা মিষ্টি খাওয়াবেন না? বললাম- আপু, একটু ফ্রী হয়ে নেই, বাসায় দাওয়াত দেবো আপনাদের সবাইকে। একদিন দেখা করবো সেই সময় আর হলোনা! আমি মরমে জর্জরিত হয়ে আছি এখনো, আমায় ক্ষমা করবেন!
সামনাসামনি আপনাকে আর কোনদিনই কিছু বলা হবেনা আমার। তাই আজ এই চিঠিতেই নিজের অনুভূতি লিখে আপনার আকাশের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম-
প্রিয় আরজু মুক্তা,
আপনি কি জানেন- অপরূপা টাঙ্গাইল শাড়ি পরিহিতা আপনি যেদিন অপেক্ষায় ছিলেন সোনেলার প্লাটফর্মে, আপনার সেই লালচে ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিয়ে আপনাকে দেখবো বলে আমরাও সেদিন ধরেছিলাম মধ্য রাতের ট্রেন?
সোনেলায় আগমনের কারণ জানতে চেয়ে অকালকুষ্মাণ্ডদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়েও আপনি আমাদের শুনিয়েছেন নীলাম্বরী কবিতা। কাঁশফুলের শুভ্রতায় নিজেকে সজ্জিত করে হাতে আকাশী কাঁচের রেশমি চুড়ির লেখকীয় ঝংকারে আপনাকে পেয়ে পাঠক হিসেবে এক অদৃশ্য মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম আমরা সেদিন।
সময়ের সাতকাহনে দিন মাস বছর পেরিয়ে সোনেলা আপনাকে প্রিয় বৃষ্টি নূপুরের লেখক বলে সম্মোধন করে একটি চিঠি দিয়েছিলো মনে পড়ে কি? সেই চিঠির প্রতিটি লাইনে লেখা আছে বৃষ্টি কাব্যের কথা।
জানি সোনেলাকে ভালোবাসেন বলেই আপনার ভালোবাসারা অভিমানী । সোনেলার আকাশে উজ্বল নক্ষত্র হয়ে আপনি সবসময় আলোকিত থাকবেন আমাদের আঙিনায়।
সোনেলা পরিবারে আপনাকে পেয়ে আমরা গর্বিত ছিলাম, আছি, থাকবো। যে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আমাদের আবদ্ধ করে রেখেছেন এর ঋন শোধ করবার দুঃসাহস, শক্তি কোনটাই আমাদের নেই।
প্রিয় ব্লগার, আপনার উপহার দেয়া “নির্ঝর শব্দের ঢেউ” বইটি আমার কাছে স্মৃতি হিসেবে রয়ে যাবে। যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন এই প্রার্থণাই করি। আল্লাহ আপনাকে উত্তম জান্নাত দান করুন।
[ছবি- স্বত্ব সংরক্ষিত]
৯টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি
সোনেলার কেঊ আরজু মুক্তা আপাকে ভুলতে পারবে না। যেমন তার লেখনি পাওয়ার সাংগঠনিক ভাবে ঠিক তেমনি তার পরদর্শীতা।
কমেন্টস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
আপুরা ওপারে ভাল থাকুন এই কাম্য।।
লেখাটা সুন্দর হইছে।
আলমগীর সরকার লিটন
আসলে মুক্তা আপু এতটাই অন্তরিকছিলেন ভাবতে গাও শিংরে উঠে কবিতা পড়ে মন্তব্য আর করবেন না
অনেক দোয়া করি যেখানে থাক জান্নাত তে থাক আমিন——-
অনন্য অর্ণব
আরজু মুক্তা আপু ছিলেন খাঁটি মুক্তোর মতো উজ্জ্বল ব্যাক্তিত্বের অধিকারী। উনার সাথে আমার কখনোই দেখা হয়নি, এমনকি কথাও হয়নি। নির্ঝর শব্দের ঢেউ বইটি প্রকাশ করার সময় আপু একটা গ্রুপ খুলেছিলেন। সেই গ্রুপে আমাকে এড করে আমার কাছে লেখা চেয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে তখন আমি লেখা দিতে পারিনি। ভেবেছিলাম পরের বছর দেবো ইনশাআল্লাহ ।
কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস – একজীবনে আপুর সাথে আর দেখা হলোনা । আপু যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। এটাই আল্লাহর কাছে কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আমরা এক খাঁটি মুক্তোকে হারালাম॥ যা সত্যি অপূরণীয়। আর বইও বের করা হবে না। কাকন তার মতো কেউ আগলে রেখে সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারবে না।
কাল কবর দেখতে গিয়েছিলাম॥ আর তার শূণ্য তা নিতে পারছি না।
আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুক।।।
মোঃ মজিবর রহমান
আরজু তাঁর সৃষ্টি কর্মেই মানুষের মাঝে চির জাগ্রত থাকবে।
সাবিনা ইয়াসমিন
কিছু বলার নেই ভাই। যা হারিয়েছি তা আর কিছুতে পূর্ণ হবার নয়। তিনি ভালো থাকবেন ওপারে।
আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।
প্রদীপ চক্রবর্তী
নির্বাক!
এতো তাড়াতাড়ি আপু অপারে পাড়ি জমালেন ভাবতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
উনার সাথে লেখালেখি নিয়ে প্রায়ই কথা হতো।
কিন্তু তিনি আজ নেই।
..
তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।
হালিমা আক্তার
আরজু আপার হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়া কষ্ট কর। মুক্তোর মত উজ্জল হয়ে থাকবেন মনের মনিকোঠায়। আল্লাহ উনাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন।
জিসান শা ইকরাম
আরজু মুক্তা বেঁচে থাকবেন আমাদের অন্তরে, স্মৃতিতে উজ্জ্বলতা ছড়াবে।
আরজুর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।