আমি ভুলে যাই তুমি আমার নও (ছোট গল্প)

মামুন ২৬ মার্চ ২০১৫, বৃহস্পতিবার, ০১:৪৮:১২পূর্বাহ্ন গল্প ১৪ মন্তব্য

‘ আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে

মনে পড়ল তোমায়…’

পাশের বাসায় গান বাজছে। উস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মাদ চৌধুরীর। ওর ফেভারেট। এরকম খুব অল্প গানই আছে, যা রিমকি’র ভালো লাগে। আসলে ভালোলাগার পরিমাণ যদি বেশী হয়ে যায়, সেখানে কোয়ালিটি থাকেনা। বেশীরভাগ মানুষই এখন আর্টিফিশিয়াল ভালোলাগার পিছনে ছুটে চলেছে। কোয়ালিটির থেকে কোয়ান্টিটির দিকেই ধাবমান।

ইউনিভার্সিটি বন্ধ। গরমের বন্ধ প্রায় শেষ হয়ে আসছে। এজন্য কি মনে কোনো আক্ষেপ রয়েছে ওর?

নাহ! বরং খোলা থাকলেই বেশী ভালো লাগে। কতটা ভালো?

বিছানায় উপুড় হয়ে বুকের নীচের বালিশটা জাপ্টে ধরে ভাবে, ‘তাই তো? উমম… ৫৫% ভালো লাগে।’ আর বাকী ৪৫% খারাপ লাগাটা শুধু মাত্র সারাদিন ঘুমুতে পারেনা ফ্যাকাল্টি খোলা থাকলে- সেজন্য। আর এই দশ ভাগ বেশী ভালোলাগাটা কি রাসেলের জন্য?

বালিশের উপরে যে শরীরটা… সেখানে ধুকধুক করা হৃদয় থেকে এক ঝলক উষ্ণ শোণিত সারা দেহময় ছড়িয়ে পড়ে… ভালোলাগার আবেশে আন্দোলিত করে রিমকিকে। একটা নাম! তাতেই কত রিফ্লেক্স…অনুভুতি…আরো কিছু যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না এমন।

ক্যাম্পাসের পাশেই টিচারস কোয়ার্টারে থাকে রিমকি। বড় ভাই অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। তার সাথেই থাকে ও। আর রাসেল হলে থাকে। সে বন্ধেও সাধারণত বাড়ি যায় না। সেটাও কি রিমকির থেকে দূরে সরে যাবে … ওকে দেখতে পাবে না বলে? কতবার ভেবেছে ওকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু ওর সামনে গেলে ভালোলাগাটা এমনভাবে রিমকিকে ঘিরে ধরে যে, সে অন্য সব কিছু ভুলে যায়।

রাসেল ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারি। তবে সেই পরিচয়ে রিমকি ওকে পছন্দ করেনি। বলতে গেলে রাসেল রাজনীতির সাথে জড়িত থাকুক, এটাও সে চায় না। কিন্তু এই ব্যাপারে রাসেল কোনো কথাই শুনতে নারাজ। একবার সরাসরি ওকে বলেও দিয়েছে, ‘ তুমি আর আমার রাজনীতি- দু’টোই আমার কাছে প্রিয়।’ ওর কোঁকড়া চুলের নীচে দুইটি মায়াভরা চোখে দেশের প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা… সমাজকে বদলে দেবার একটা দৃঢ় প্রত্যয় রিমকি দেখেছে। গতানুগতিক ছাত্র নেতাদের মত সন্ত্রাস- চাঁদাবাজি ও লুটপাটতন্ত্রে সে বিশ্বাসী না। এজন্যই রাসেলের বিরুদ্ধে ওদের সংগঠনের ভিতরে একটা গ্রুপিং এর সৃষ্টি হয়েছে। রিমকিকে সে দুজনের একান্ত নিরিবিলি সময়গুলোতে আক্ষেপ করে এটা বলেছেও। প্রচন্ড কষ্টে রিমকি ওর প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছে শুধু… তবে সব ছেড়ে দিয়ে ওকে নিয়ে থাকুক- মনের এই কথাটি কেন জানি বলতে পারেনি।

বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি… হৃদয়ে ব্যাকূলতা…প্রিয়তমকে এক পলক দেখার ইচ্ছেটা বেড়েই যাচ্ছে। মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রীনে রাসেলের চেহারাটা দেখে… আর উত্তরোত্তর বাড়ে ওকে কাছে পাওয়ার বাসনা! বৃষ্টির ভিতরে কি মানুষকে উষ্ণ করে দেবার মত এমন কিছু আছে? সাধারণভাবে আমরা দেখি মানুষ শীতল হয়… তবে কি রিমকিদের মতো দ্বাবিংশ বর্ষীয়া তরুণীদের দেহমনে এমন কোনো কিছু একটা রয়েছে, যা বৃষ্টির আগমনে তাদেরকে উষ্ণতর করে দেয়?

ভাবতে ভাবতেই রাসেলের ফোন! রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রাসেলের গলা,

‘ এই! চলে এসো আমার কাছে… দুজনে বৃষ্টিতে ভিজি!’

– আহহারে, কত শখ হয়েছে জনাবের!

‘ কি? আসছ তো?’

– কোথায় এখন তুমি?

‘ কালভার্টের পাশের কৃষ্ণচূড়ার তলায় তোমার অপেক্ষায় আছি!’

– থাকো…আসছি!

লম্বা পীচ ঢালা পথটি সোজা কালভার্টের সাথে গিয়ে মিশেছে। এরপর সামান্য বামে বেঁকে গিয়ে কিছুদূর চলার পর ডানে ছোট্ট একটা মোড় নিয়ে আবার সোজা চলে গেছে। দূর থেকে কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুলের ভিতর দিয়ে হাল্কা সবুজাভ পাতা উঁকি দিচ্ছে। প্রচন্ড বৃষ্টি রিমকির সারা শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে আহ্লাদে ফেটে পড়ছে! গাছের নীচে একজনের সাদা পোষাকের অস্পষ্ট অবয়ব দেখা যাচ্ছে! রিমকির চলার গতি আরো একটু দ্রুত হল… সেই সাথে হৃদস্পন্দনও! হ্যা, ওই তো রাসেল! পহেলা বৈশাখে ওর দেয়া সাদা পাঞ্জাবীটা পড়ে আছে।

দুটো মটর সাইকেলে চারজন তরুন রিমকিকে পাশ কাটিয়ে গেলো। মুহুর্তে কেমন যেন একটা অশুভ অনুভূতির ছোঁয়া দিয়ে যায় ওকে।

সোজা কৃষ্ণচূড়ার নীচে দাঁড়ানো রাসেলের সামনে থামে ওরা। প্রচন্ড বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়েও মৃত্যুর বিভিষীকা জাগানো শব্দে কেঁপে উঠে দশদিক! রিমকির চোখের সামনে লুটিয়ে পরে রাসেল… সাদা পাঞ্জাবী কৃষ্ণচূড়ার ফুলের রঙে লাল হয়ে যায়… রিমকির চীৎকারকে অগ্রাহ্য করে পরিচিত সন্ত্রাসীরা দ্রুত সরে যায়।

রাসেলের মাথাকে নিজের কোলে নিয়ে সাহায্যের জন্য রিমকি চীৎকার করে। কিন্তু এই বৃষ্টির ভিতরে আশে পাশে কেউ নেই। রাসেল ওর চোখের দিকে তাকায়… দুর্বল ওর রক্তমাখা হাত দিয়ে একবার রিমকির ঠোটকে ছুঁয়ে দিয়ে একটু হাসে! বাতাস ওর কোঁকড়া চুলে লেগে থাকা বৃষ্টির পানিকে রিমকির শরীরে মাখিয়ে দেয়। রাসেলের রক্ত আর গাছের নীচের লাল ফুল এক হয়ে যায়… বৃষ্টি ওর শরীরের রক্তকে বয়ে নিয়ে কৃষ্ণচূড়ার ফুলকে আরো রক্তিম করে! ভালোবাসার মানুষটির নিস্তেজ দেহ আঁকড়ে ধরে এক তরুনী কাঁদতে থাকে…

কালভার্টের পাশে একটি নিঃসঙ্গ কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে!

—————————————————————-
প্রতিবছর বর্ষা আসে… ক্যাম্পাসের অন্য কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর মতই কালভার্টের সাথে লাগোয়া বিচ্ছিন্ন একটি কৃষ্ণচূড়া গাছও ফুলে ফুলে রক্তিম হয়ে উঠে। আর বৃষ্টি গাছের পাতাগুলোকে আরো লাল…চকচকে করে তোলে। প্রচন্ড ঝুম বৃষ্টির ভিতরে এক যুবতি কালো লম্বা পীচ ঢালা পথটি ধরে হেঁটে হেঁটে এই গাছের নীচে এসে দাঁড়ায়… দুহাত ছড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে… বৃষ্টিকে উপভোগ করে। কারো সাথে কথা বলে… অদৃশ্য একজনের হাত ধরে থাকে… দুজনে বৃষ্টিতে চুপচাপ ভিজে। একসময় তার ঘোর ভাঙে। সে উপলব্ধি করে সে একা… সে ভুলে যায়, যার হাত ধরে ছি্‌ সে আজ তার নেই! বহুদূরে চলে গেছে। তারপর বৃষ্টির সাথে সাথে নীরবে সেও কেঁদে চলে…

অন্য কোনো কৃষ্ণচূড়ার কাছে সে কখনো যায় না। এই কালভার্টের সাথের গাছটির ফুলগুলোও কেন জানি অন্যগুলোর থেকে অনেক বেশী লাল। একজন যে হৃদয়ের সকল ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে গেছে গাছটিকে… রক্তিম ভালোবাসা!!

৫৯৯জন ৫৯৯জন
0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ