অবশেষে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে স্বামী’র যখন কোনমতে চলার মতন একটি জব হয়, আমরা আত্মীয়ের বাড়ি ছেড়ে আলাদা বাসায় উঠি। নিউইয়র্ক শহরে খাওয়া খরচ কম। বাড়িভাড়া এক্সপেন্সিভ। আমাদের সামর্থ্যের বাইরে। বিধায় একটি রুম ভাড়া নেই। ছোট ছোট চার রুমের বাড়িটির তিন রুমেই ব্যাচেলর। একরুমে স্বামী-স্ত্রী থাকেন। তাঁরা একটু গুছিয়ে উঠেছেন, তাই আলাদা বাড়িতে যাচ্ছেন। সেই রুমটিতে আমরা উঠবো। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরে। ব্যাচেলর ছেলেদের সাথে এক বাড়িতে থাকবো ! অসম্ভব ! সেইসব অসম্ভব অনেককিছুই হেরে গিয়ে সম্ভব হয় বাস্তবতার কাছে। অসহায়ত্বের কাছে। গরীবি হালের কাছে…
আমি বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদি। এমন পরিবেশে কেমন করে থাকি ! দেশে আমার বাবার বাসায় যে রক্ষণশীল ভাবে বেড়ে উঠেছি ! স্বামী বোঝালো__ ছেলেগুলো খুব ভালো। তাছাড়া আগেও এইরুমে স্বামী-স্ত্রী ই ছিল। আমাকে ভুলে যেতে হল, দেশে কি ছিলাম… কেমন ছিলাম। তীব্র মন খারাপের মাঝে সেই বাড়িতে সংসার পাতলাম। সারাদিন ব্যাচেলররা জব করে। এই সুযোগে আমি আমার সব কাজ সেরে নেই। সন্ধ্যায় তাঁরা একে একে বাড়ি ফিরে, রান্না করে, ক্যাসেট ভাড়া করে আনে, নাটক দেখে। আমি চুপটি করে রুমে বসে থাকি।
ভাগ্য আমার সহায় ছিল। কোন এক অদৃশ্য কারনে তাঁরা সবাই আমাকে স্নেহ করে, ভালোবাসে, সন্মান করে। ভালোমন্দ রান্না করলে ডাকে। বিকেলে চা, মুড়ি, চানাচুর বানালে ডাকে। আমরা একসাথে খাই। গল্প করি। দিন্কে দিন তাঁদের সবাইকে ভীষণ আপন মনে হতে থাকে। দু’জনকে আবার আংকেল ডাকি। আমি তাদের দেশে রেখে আসা কন্যা’দের সমবয়সী। ব্যাচেলররা এক একদিন এক একজনের রান্নার দায়িত্ব। সব ঠিকভাবে চলে যদিও, কিন্তু যেদিন সাফা নামের ছেলেটির রান্নার দিন__ সেদিন বাড়িটিতে হৈচৈ লেগে যায়। সাফা’র রান্না মুখে দেবার মতো নয়। সবাই তাকে বকাঝকা করে__ মাছ বা মাংস ভাল করে কসায় না কেন… ভাজে না কেন… ঝোল বেশি দিসে কেন… লবন কম/বেশি কেন। সাফা মুখ বুঁজে থাকে। টুঁ শব্দটি করে না। মন খারাপ করে রুমে চলে যায়। নামাজ পড়ে। দু’হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করে ! কি জানি, রান্না ভাল হবার জন্যে দোয়া করে কিনা, কে জানে…
আমার মায়া লাগে। বলি__ সাফা ভাই, আপনি সব কেটে ধুয়ে রেডি করে দিয়েন। আমি না হয় রান্না করে দিবো। তিনি খুশী হন। এরপর সপ্তাহের একটি দিন অন্য সবার অগোচরে আমি সাফা’র রান্না করে দেই। তিনি পাশে দাঁড়িয়ে শেখার চেষ্টা করেন। রাতে সবাই তৃপ্তি নিয়ে খায়। অবাক হয়। সাফা’কে মধুর তিরস্কার করে, এতদিন মনোযোগ দিয়ে রাঁধেনি বলে ! সাফা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয় না। মাথা হেঁট হয়ে থাকে। প্লেটের দিকে চেয়ে নিবিষ্ট মনে খেয়ে রুমে চলে যায়।
এদিকে ঠাণ্ডার দেশে আমি ঠাণ্ডাজনিত অসুখে পরি। তাঁরা সবাই মিলে যে যখন বাসায় থাকে, আমাকে আদা-এলাচ-লেবু-লং এসব দিয়ে বিশেষ চা বানিয়ে দেয়। রোযার দিনে ইফতার বানিয়ে টেবিল সাজায়। খেতে ডাকে। যার যেদিন ছুটি, আমাকে রাস্তা চিনাতে নিয়ে যায়। স্ট্রীট, এভিনিউ শেখায়। সাবওয়ে ম্যাপ বুঝায়। হারিয়ে গেলে কিভাবে ফিরবো, বলে দেয়। আমি উপলব্দি করতে থাকি___ কখনো কখনো পরও অনেক আপন হয়…
এখন বাংলাদেশী বেড়েছে। বাংলাদেশীদের আধিপত্য বেড়েছে। অনেককিছুই অনেক সহজ হয়েছে। আমি হয়তো এদেশে নতুন আসা পরিচিতদের একটি জব খুঁজে পেতে কিংবা প্রাথমিক সহযোগিতাগুলো করি। কিন্তু একদিন আত্মীয় পরিজনহীন এই ভিন দেশে যারা আমার জন্যে এতকিছু করেছে, আমি তাদের কেমন করে ভুলি ? অচেনা অজানা সেই মানুষগুলো’র টুকরো টুকরো ঋণ কোন কিছুর বিনিময়েই কি শোধ হবার ?
২২টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
এমন মানুষ এখনো আছে বলেই আমরা মানুষের উপর বিশ্বাস রাখতে পারি
বিশ্বাস নষ্ট হয়না।
এমন মানুষেরাই আলোকিত করে আমাদের।
শ্রদ্ধা জানাই এমন আত্মার আত্মীয়দের
ভাল থাকুন প্রবাসে।
রিমি রুম্মান
এমন মানুষগুলো আছে বলেই অচেনা অজানা দেশে আমরা এগিয়ে যাই। ভাল থাকুন।
শুন্য শুন্যালয়
আত্মীয়স্বজন সব ছেড়ে বিদেশের জিবনযাত্রা কেমন হয়, এখন বুঝতে পারি। এখানে প্রতিটি ভালোবাসা আর মায়ার তীব্রতা অনেক বেশি করে বোঝা যায়। আর তা যদি হয়, খুব প্রতিকূল মুহূর্তে তাহলে আরো বেশিগুনে। ভালোবাসার ঋণ শোধ করবার নয়, ভোলারও নয়। অজানা, অচেনা সে মানুষগুলো আর আপনার জন্য শুভকামনা রইলো আপু।
রিমি রুম্মান
তাঁরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো বলে সেদিন অনেক কিছু অনেক সহজ হয়েছিল। আমি তাদের কেমন করে ভুলি ? মানুষকে ভালবাসলে অন্তরের অন্তস্থল থেকে দোয়া এমনিতেই এসে যায়। ভাল থাকুন আপনিও।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
”সেইসব অসম্ভব অনেককিছুই হেরে গিয়ে সম্ভব হয় বাস্তবতার কাছে, অসহায়ত্বের কাছে। গরীবি হালের কাছে…” প্রতিটা মানুষকেই জীবনের কোন না কোন সময় মনে হয় স্ট্রাগল করতেই হয়। বিশেষ করে যারা আত্মনির্ভরশীল জীবন যাপন করতে চায়।
দুঃসময়ে যারা সামান্য সহযোগিতাও করে তাঁদেরকে মানুষ কোনদিনও ভুলতে পারে না। সুদিনে অনেকেই থাকে কিন্তু র্দুদিনে যারা হাত বাড়িয়ে দেয়, তাঁদের প্রতি সারাজীবনই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে যায়। আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠে। রক্ত সর্ম্পককে ছাপিয়ে পরও আপন হয়ে উঠে।
রিমি রুম্মান
সেই থেকে আমি জেনেছি___ রক্তের সম্পর্কই সব নয়। ভাল থাকুন সবসময়।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
বিদেশের এমন অভিজ্ঞতা আমার আছে।আমার জানা মতে শুধু মাত্র রান্না করা নিয়ে যত বিপত্তি ঘটে।ভাল লেগেছে….সময় হলে সোনেলায় প্রকাশিত প্রবাসে আমার একটি ধারাবাহিক পোষ্ট আছে পড়লে কৃতজ্ঞ হবো নাম হলো…অতৃপ্ত জীবন…প্রবাসী। -{@
রিমি রুম্মান
“অতৃপ্ত জীবন” কিছু পর্ব পড়েছি। সময় করে বাকীগুলোও পরবো নিশ্চই। এমন অনেক টুকরো টুকরো সুখ-দুঃখের স্মৃতি আছে। মাঝে মাঝে সোনেলায় পোস্ট দিবো।
কৃন্তনিকা
মানুষের আবেগ অনুভূতি আছে বিধায় এখনো মানুষ টিকে আছে, নইলে কবে হারিয়ে যেতো…
আবেগের জন্যই ভুলতে পারেন না। চিরদিন থাকুক এই আবেগ… -{@
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। ভাল থাকুন। শুভকামনা রইলো।
মেহেরী তাজ
আপু আপনি আপনার সব লেখাতে কিভাবে এতো মায়া মিশিয়ে ফেলেন বলেন তো?!
সব কিছুতে বড্ড মায়া মায়া লাগে।
তো আপনি কি এখন ও সাফা’র হয়ে রান্না করে দেন?
সব কিছু মিলিয়ে ভালো থাকুন আপু…..
রিমি রুম্মান
ওরা এখন কে কোথায় আছে জানিনা। ওদের এদেশে থাকার লিগ্যাল পেপারস ছিল না। তবে দোয়া করি সব সময়।
খেয়ালী মেয়ে
যেখানে ভালবাসা সম্মান আছে সেখানে পরও খুব সহজে আপন হয়ে যায়–যাদেরকে কখনো ভুলা যায় না, যাদের ঋণ শোধ হবারও নয়…
ভালো কাটুক প্রবাস জীবন….
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনিও।
লীলাবতী
আপু এত শ্নেহ ভালবাসার কথা শুনলে কেমন জানি চোখে পানি চলে আসে।আপনি ভাল থাকুন আপু।
রিমি রুম্মান
স্নেহ, ভালবাসাগুলো খুব কাছ থেকে পেয়েছি অচেনা মানুষগুলোর কাছ হতে। ভালোমানুষ আছে এখনো এই পৃথিবীতে। ভাল থাকুক সবাই।
শিশির কনা
বিদেশে সবাই এত আন্তরিক ভাবাই যায়না আপু।এমন ভাবে লিখলেন,মনে হচ্ছে ঘটনা গুলো দেখতে পেলাম।
রিমি রুম্মান
বিদেশে আবার রেষারেষিও আছে। আমি হয়তো আমার চারিপাশে ভালমানুষগুলোই পেয়েছি বেশি। তাই আমার সব ছেড়ে আসার পরও ভাল সময় কেটেছে।
নুসরাত মৌরিন
আপু লেখাটা পড়ে মনটা আর্দ্র হয়ে গেল।
বিদেশ বিভুঁইয়ে মানুষ হয়ত এমন করেই আত্মীয় অনাত্মীয় মিলে মিশে যায়।
ভাল লাগলো পড়ে।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন। এমন আরও বাস্তব ঘটনা আছে। যা নিয়ে আসবো মাঝে মাঝেই এই সোনেলায়। সাথে থাকার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।
বন্দনা কবীর
প্রবাসে অনাত্মীয় পরিবেশে এমন সহযোগিতা পাওয়াটা ভাগ্যের বিষয়।আপনাদের সবাইকে শুভেচ্ছা।
রিমি রুম্মান
শুভেচ্ছা আপনাকেও। ভাল থাকুন সবসময়।