অনেকদিন পর বাসায় আমি একা। একেবারেই একা। কম্পিউটারে প্রিয় গানগুলো ছেড়ে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের একটা বই হাতে নিয়ে বসেছি। গান বাজছে কিশোর কুমারের #জীবনের অংকটা মেলাতে গিয়ে# কুমার শানুর # নিথর জলের বুকে#
আমি কখনোই নিজেকে কারো সাথে মিলাতে যাইনা। আমি কখনোই কারো কথায় খুব একটা বিচলিত হইনা। আমি বাবার একটা কথা সব সময়ই লালন করি, তা হলঃ পৃথিবীতে এক একটা মানুষ এক একেক রকম। তাদের চিন্তাও আলাদা। তোমার সাথে নাও মিলতে পারে। সেই স্কুল জীবনে পড়ার এক ফাঁকে আব্বা এসে কবিতা আবৃত্তি করতঃ এই খানে তোর দাদীর কবর, আমি দেখতাম আব্বার গলা ধরে আসত। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। কতো যে মধুর ছিল আমার সেইদিনগুলি। অনেক পরিবারে একজনের অনুপস্থিতিতে অনেক সমালোচনা করতে দেখেছি। আমরা যেহেতু থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কোয়ার্টারে বড় হয়েছি, অনেক সময় আন্টিরা একজন আর একজনের দোষ নিয়ে গল্পে মেতে উঠত। মা সেই সব আন্টিদের সাথে মিশত না।
আমাদের বাসায় ছোটবেলায় দেখতাম অবজারভার পত্রিকাটা আসত, এরপর আমাদের জন্য আসা শুরু হল ইত্তেফাক। বই পড়ার অভ্যাস আব্বার কাছ থেকেই পাওয়া। সুন্দরবন উপকূল এলাকা বলে পানির সমস্যা ছিল প্রচুর হাসপাতালের রোগিদের। কিন্তু আমাদের ছিল অনেক বড় ট্যাংকি। রোগীরা সব আমাদের বাসায় আসত পানি নিতে। মাঝে মাঝে আমি বিরক্ত হয়ে যেতাম, দেখা যাচ্ছে ঘুমাইছি তখন এসে ডাকছে। মা আস্তে করে উঠে পানি দিত। কখনো যদি দেখত কারো সাথে খারাপ আচরন করেছি, বলত ” মনটাকে বড় করো দেখ কতো প্রশান্তি”। আব্বার সহকারিকে নিজের মামার মতোই মনে হতো। আমি যে কতো ঘাড়ে উঠেছি বাবুল মামার ! লাস্টবার দেখতে গেছিলাম মামাকে, দেখি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। আমার হাত ধরে কেঁদে উঠল।
আমি কি লিখব গেলাম কোথায় । মা আমার দাদিকে খুব ভালোবাসত অথবা আমার দাদীই মাকে খুব ভালবাসত। আব্বা অনেকবার মাকে শহরে নিতে চেয়েছে, সে কখনো যেতে চায়নি। দাদীর ছিল যানবাহনে প্রচন্ড ভীতি। তাই তাকে আর শহরে আনা হয়নি। আব্বা কখনোই গ্রামের পরিবেশটা পছন্দ করত না। কারণ সে দেখেছে গ্রামে থেকে পড়াশুনার কি কষ্ট। আব্বাতো বাবাকে খুব ছোটবেলায় হারায়। তাদের ছিল প্রচুর জমি। কোথায় কতটুকু আছে তাও বলতে পার না। অথচ সে মানুষের জমির ধান কেটে, সেই মুজুরি দিয়ে ১৬০ টাকা দিয়ে মেট্রিক পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ করে। অনেক কষ্ট করে লজিং থেকে আজ সে মেডিকেলে পড়ে এসেছে। কষ্টের কথা তার মধুর স্মৃতির কথা তার মুখে ও বাড়ির মানুষের কাছ থেকে শুনেছি।
জীবনে প্রতিটা পদে যার কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছি, আজ কখনো কখনো মনে হয় কিছুটা স্বার্থপরতা কেন শিখালো না, কেন কিছু নেগেটিভ মানসিকতা মনে ঢুকালো না। আব্বা বলত কুয়ার ব্যাঙের কুয়া ও ডোবা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। জগৎটা বাড়াও, লেখ পড়, মন ভাল না থাকলে ঘর থেকে বের হয়ে ঐ মাঠে চলে যাও, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেও। কলেজে যখন উঠলাম, প্রেমের ব্যাপারে আব্বা আলাপ করত। আমরা একটা বড় পরিবারে বেড়ে উঠেছি, অনেক ভাইবোন, মামি, চাচিরাও আমাদের বান্ধবী। আমি গির্জায় গেছি, মন্দিরের ভিতর না গেলেও প্রসাদ খেয়েছি। মা অনেক যত্ন করে কোরআন পড়ানো শিখিয়েছেন। ধর্ম নিয়ে তাই কোনো নাক সিটকানো শিখিনি। কিন্তু জীবন সব সময় এক রকম চলে না। জীবনের মোড় ঘোরে। অন্য একটা পরিবেশে মেয়েদের খাপ খাওয়াতে হয়, মা তাও শিখিয়েছিল।
আমি কেন জানি অযথা অকারণে কারো সাথে খুনসুটিতে মেতে উঠতে পারিনা। মহিলাদের দেখি সিরিয়াল দেখছে গতানুগতিক একটা জীবন যাপনের। এক মূহুর্তে ঝগড়া করছে আর এক মুহূর্তে গল্পে মেতে উঠছে। সারাক্ষণ সমালোচনায় মুখর তারা। শাশুড়িকে এক গ্লাস পানিও দেখেছি ঢেলে খাওয়াতে রাজি নয়। সেদিন এমনি একটা কথা কানে আসতে অবাক হলাম। কথাটা তীরের মতো বিঁধে গেল “যখন একটু সময় পায় বই পড়ে, কি যে করে ! জামা কেনার টাকায় বই কেনে”? এটা কোনো ভবিষ্যতে কাজে লাগবে না। বাড়ির অন্য বৌরা অনেক সাদাসিদে। আচ্ছা সাদাসিধেরা কি গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো পারেনা ?
ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় গোঁড়ামি দেখিনি। উল্টো স্রোতে হেঁটেও আসতে পারিনা। এ যেন অদ্ভুদ আমি।
আজ একটু এলোমলো আমি। অবাক করা কথাগুলো গিলে ফেলতেই হয়। তাছাড়া যে সমাজ বলবে বড়ই বেয়াড়া।
৩৪টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
অনুভূতির সাচ্ছন্দ্য প্রকাশ দেখে ভাল লাগল,
জীবনের আনাচে কানাচে অনেক বাঁক, তবুও জীবন আপন নিয়মে আমাদের নিয়ে চলে।
মৌনতা রিতু
হুমম, একদম। জীবন তার আপন গতিতেই চলে।
শামীম আনোয়ার আল- বেপারী
কি মন্তব্য করবো বুঝতাছি না লেখছি আর ডিলেট করছি
মৌনতা রিতু
এই তো লিখে ফেললেন। পড়েছেন ধৈর্য্য নিয়ে এটাই তো মূল কথা। ধন্যবাদ।
শামীম আনোয়ার আল- বেপারী
🙂
লীলাবতী
কথা লিখলেন আসলেই? আমারতো মনে হচ্ছে আপনি আমি দুজনে বসে আছি পাশাপাশি, আর আপনি বলে যাচ্ছেন নিজের কথা।
আপনার আব্বা আম্মাকে শ্রদ্ধা জানাই, কত উদার ছিলেন ওনারা।
দেখলাম ইদে পাওয়া টাকা দিয়ে অনেক বই কিনেছেন। আপু আপনি এত ভাল কেনো? 🙂
মৌনতা রিতু
লেখার সময় দেখলাম তো পাশেই বসে ছিলে। কতোবার বানান ঠিক করলে বলো তো ! উৎসাহ দিলে, গুতালেও কি কম !
মিষ্টি জিন
আমার মা এবং দাদীর মধ্যে ও খুব সুন্দর সম্পক ছিল.. মা বলতেন মায়ের রূপে শাশুডী পেয়েছি..হ্যা আপু অনেক সমঁয় এলোমেলো ভাবনা অনেক অবাক করা কথা গুলো গিলে ফেলতে হয় শুধু সমাজের কাছে বেয়াডা হওয়ার ভয়ে..
মৌনতা রিতু
গিলে আসলে ফেলতেই হয়। বাবা বলত জেগে থাকা মানুষকে জাগানো যায়না। ঠিক এমন মূর্খদের সাথে তর্কেও যেতে নেই। এখানে নিরবতা পালনই উত্তম।
আবু খায়ের আনিছ
জীবনের প্রতিটি বাকেঁ যে শিক্ষা গ্রহণ করেছে সেই ত প্রকৃত শিক্ষিত।
সময় বদলাইছে, বই পড়ার অভ্যাস এখন অনেক কমে গেছে মানুষের।
মৌনতা রিতু
বই পড়ার অভ্যাস থাকলে সমাজে, পরিবারে এতো ঝগড়া হত না। তাদের মানসিকতা অনেক বড় হত।
আমাদের তিনজনেরই খুব বই পড়ার অভ্যাস। জুলি তো ঈদ সংখ্যা অফিসেই রাখে, আগে পড়বে বলে।
আবু খায়ের আনিছ
হা হা হা, বই কিনি, আগে নিজে পড়ি তারপর অন্যদের দেই, ছোট বোনদেরকেও তাই করি।
মৌনতা রিতু
আগে স্কুলে যেতে আসতে ২০ টাকা পেতাম। প্রথম কিনেছিলাম লিও টলস্টয়ের বই। তারপর কাকাবাবুর বই। আর একটা কিনেছিলাম চাঁদের পাহাড়।
এখনও সেই নেশা আছে। ছেলের ভিতরও ঢুকাইছি সেই নেশা। আমার বড় বাবা তো জাফর ইকবালের ভক্ত। এখন ও নিজেও লেখে। মুগ্ধ হই ওর লেখা পড়ে।
ঘুমের ঘোরে কেটে যাওয়া অনন্ত পথ
জীবনটাই একটা শিক্ষা কেন্দ্র। প্রতিটা পদে পদে শিক্ষা নিতে হয় আমাদের। সময়ের পরিক্রমায় নিজেকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করতে হয়। কিন্তু তাই বলে পুরোটা না হলেই ভাল।
পোস্টে ভাল লাগা
মৌনতা রিতু
ওই তো জীবন। না, পুরোটা পাল্টালে আর মানুষ থাকলাম কোথায়। তবুও কিছুটা তো খাপ খাওয়াতেই হয়। এটা উচিৎ।
ধন্যবাদ ভাই।
অপার্থিব
অনুভূতির প্রকাশ ভাল লেগেছে। ঈদের জামা কেনার টাকা বাঁচিয়ে বই কিনতে অনেক বড় একটা সাহস বা বই প্রেমী মানসিকতার প্রয়োজন হয় যেটা হয়তো আপনার আছে।
মৌনতা রিতু
সাধারণত ঈদের টাকাতেই দামি বইগুলো কিনি। তাছাড়া বাজেটে কুলায় না। বই যে আমার অহংকার। ঐ তো আমার বসন।
আমার অবসরের সংগি।
ধন্যবাদ ভাই পড়ার জন্য।
জিসান শা ইকরাম
পরিবার থেকে এমন শিক্ষা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
অনেক পরিবারই আছেন, বাব অসৎ কিন্তু সন্তানদের সৎ হবার পরামর্শ দেন।
এমন অবস্থায় সন্তানরা বাবার কথা শুনবে না, কারণ বাবা অসৎ।
আপনার বাবা, মা কে অসীম শ্রদ্ধা জানাই,
সাথে আপনাকেও।
এমন আদর্শ পরিবারের মাঝে বড় হয়েছেন বলেই আপনি ভিন্ন রকম, অন্য সবার থেকে আলাদা, অনুসরণীয়।
চমৎকার, সাবলিল উপস্থাপনা
মৌনতা রিতু
ওটাই সম্পদ ভাইয়া। ছেলে দুটাকে যেন এই শিক্ষাটা দিতে পারি। মেমন রিয়ান যেন ভালো মানুষ হয়। জাফর ইকবাল স্যারের সাথে ফোনে কথা বললে মেমন যেন চাঁদ হাতে পায়। স্যারের বড় গিফট ও তার কাছ থেকে বই পেয়েছে। তাও কুরিয়ারের মাধ্যমে। সে এখন পত্রিকাতেও লিখছে। আমি মেমনকে নিয়ে গর্ব করি। ওর ইচ্ছা বিজ্ঞানি হবে।
শুধু দোয়া করবেন ভাইয়া।
জিসান শা ইকরাম
অবশ্যই দোয়া করি আপনার দু সন্তানের জন্য,
ওরা যেন স্বপ্নের চুড়ায় উঠতে পারে বাস্তবে।
ইঞ্জা
বাবা মারা যা শিখিয়েছে আপনাকে, আমাদেরকে তা আজকালকার বাবা মাদের আবারো শিখা উচিত, আজকালকার বাচ্চারা এই ডিজিটালাইজেশনের যুগে আমাদের প্রাপ্ত শিক্ষা হতে আসলেই বঞ্চিত।
মৌনতা রিতু
ভাই দোয়া করবেন এটা যেন আমার দুই সন্তানের মাঝে দিতে পারি। আমার ছেলেকে জাফর ইকবাল স্যার ও বই পাঠায়। ছেলেটাও ছোট গল্প লেখে। ওর লেখা দেখে মুগ্ধ হই আমি।
শুধু দোয়া করবেন, যেন ভালো মানুষ হয়।
ইঞ্জা
দোয়া রইল।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা, একই জীবন-যাপন আমারও ছিলো। শুধু বই পড়ার ধাঁচটা পেয়েছি মামনির থেকে। এই যে লেখালেখি সেও মামনি। তবে বাপির সাথে আমার চরিত্রের ভারী মিল। মাঝে-মধ্যে আমিও ভাবি কেন আমি এমন বড়ো মনের পরিবারের অংশ হলাম? না হলে সহজেই পারতাম জোড়াতালি দিয়ে কোনো না কোনো ভাবে শুধু নিজের কথাই ভাবতে।
মন ভালো থাকুক। -{@
মৌনতা রিতু
যেদিনগুলোতে আমার মন খারাপ হয়, বাইরে যাই।
মন কেন কথা শুনবে না, শুনতে ওকে হবেই।
ধন্যবাদ আপু।
ব্লগার সজীব
আপু নিজের কথা এত সহজ ভাবে প্রকাশ করা খুবই কঠিন, অত্যন্ত সাবলীল ভাবে উপস্থাপন করেছেন আপনি। আপনি যে অন্য সবার থেকে বেশ আলাদা তা এই লেখার মাঝেই ফুটে উঠেছে।
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ, হাসমুখ ভাই। এতোদিন বহু ফাঁকি দিছেন। স্কেচ পোষ্টখান হেব্বি হইছে।
ব্লগার সজীব
আপনাকেও ধন্যবাদ আপু -{@
মেহেরী তাজ
আপনার নিজের কথা গুলো পড়তে ভালো লাগলো। কথার এতো স্বাচ্ছন্দ্য,স্বচ্ছতা থাকলে ভালো না লেগে যাবে কোথায়??? ভাবি ইউ আর অসাম! 😀
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ, ননদিনি, জানুয়ারিতে মোংলা, মনে থাকে যেন। 🙂
শুন্য শুন্যালয়
অন্যের কথা কি যায় আসে আপু? নিজের ভেতরে এমন খুঁড়ে খুঁড়ে দেখবার সময়ের বড্ড অভাব আমাদের। মাঝে মাঝে এমন এলোমেলো হয়ে যাবেন নইলে এমন করে লেখা সবে কি করে? বই, আহ্ বইএর মত এমন শান্তি খুব জায়গাতেই পাওয়া যায়। কতদিন নতুন বইএর ঘ্রাণ নেইনা 🙁
গান শোনা, বই পড়া, লেখা আপুরই তো দিন দেখি!! আত্মকথা আরো আরো চাই। -{@
মৌনতা রিতু
অনেক সময় অন্যের কথা একটু এলোমেলো করে দেয়। আসলে গান, বই ছাড়া জীবন আমার অপূর্ণ।
বস্তাপচা লেখা আরো চাই ? ওকে, তুমি ধৈর্য্য নিয়ে পড়লে, লিখব না হয়।
ধন্যবাদ।
মুহাম্মদ আরিফ হোসেইন
অনুভূতিও এত দারুনভাবে বনর্ন করা যায়!!!
আমি এটা ঠিক মতো পারি না।
এলোমেলো হয়ে যায়।
একান্ত অনুভূতি আমি সাধারনত নিজস্ব ডায়রিতে লিখি। লেখার পর আর পড়া হয় না কি লিখছি!
যখন মন বিষন্ন থাকে তখন লেখাগুলা পড়ি আর হাসি!!! কি যে লেখলাম!!
মৌনতা রিতু
এই জন্যই তো কবিরা বলেছেন কাগজের বুকে যা সয় মানুষের তা সয় না।
ধন্যবাদ। শুভকামনা রইল।