আমার ভালবাসা
পর্ব ৪
প্রিন্সকে ফিরে পেয়ে আমার যে আনন্দ হয়েছিল,তার রেশ কাটতে না কাটতেই দেখি বড় প্রিন্সেসটা অসুস্থ হয়ে গেল। সকাল বেলা রুটি হাতে নিয়ে ছাদে উঠলাম খাঁচা খুলে তাদেরকে রুটি খাওয়াব এই ভেবে।খাঁচা খুলে দেখি প্রিন্সেস উঠে দাঁড়াতে পারছে না। তারপর যদিওবা দাঁড়াল,তারপরও হাঁটতে পারছে না। তাদেরকে রুটি খাওয়ালাম। রুটি খেয়ে প্রিন্স ও ছোট প্রিন্সেস নিচে নামলেও বড় প্রিন্সেসটা কোথাও যেতে চাইছে না। আমার পায়ের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকছে। তখন আমি বুঝতে পারলাম সে খুব অসুস্থ। তাই আমার বারান্দায় চট বিছিয়ে তাকে বসিয়ে রাখলাম। একটু পর পর গিয়ে তাকে দেখি আর পানি খেতে দেই। নিজে নিজে পানিটা খাবার মত শক্তি তার নেই। পানির সাথে ওষুধ মিশিয়ে রেখেছিলাম। একটু পর পর গিয়ে তার মুখের কাছে পানিটা ধরলে সে খেতে পারে। এভাবে দুপুর পর্যন্ত চলল। দুপুরের শেষ দিকে প্রিন্সেস আরো দূর্বল হতে লাগল। অামি মাথার কাছে গিয়ে ডাকি
“প্রিন্সেস…ও প্রিন্সেস…..”
সে একটু চোখ মেলে তাকায়, তারপর আবার ঘুম। এর মাঝে তার সারা গা ফুলে উঠল। সম্ভবত শরীরে প্রচুর ব্যাথা হচ্ছিল। কি জানি কি গভীর ব্যাথা সহ্য করে অমন চুপ মেরে একা বসে ছিল সে। তাদের কোন অসুখ হলে,তারা মুখে বলতে পারত না। চিৎকার চেঁচামেচি করত না, শুধু চুপ মেরে একা এক কোণে নিভৃতে বসে কাটাত। যত ব্যাথা বেদনাই হোক না কেন, তা আর কাওকে বুঝতে দিত না। নিজের মাঝে সকল ব্যাথা নিয়ে যন্ত্রনায় নীরবে বসে থাকত। এভাবে বসে বসেই কখন যে তার সকল বেদনার অবসান ঘটিয়ে গেল তা আর বলতে পারছি না।কারণ প্রিন্সেসের কাছে যাবার মত মনের জোর আর শেষ অব্দি আমার ছিল না। ওর শরীরে যেটুকু ব্যাথা ছিল,তার থেকে বেশি ব্যাথা ভর করেছিল আমার মনে।
প্রিন্সেসকে হারিয়ে, তার ব্যাথা ভুলতে পারছিলাম না। ২/১ জন কাছের বন্ধুকে বলার চেষ্টা করলাম,কিন্তু দেখি তারা কিছুই বুঝতে পারছে না,বরং মজা নিচ্ছে কিংবা এড়িয়ে যাচ্ছে।। যখন কোন ব্যাথা কারো সাথে ভাগ করার উপায় থাকেনা,একা হজম করতে হয়,তখন তার তীব্রতা আরো বেড়ে যায়। অনেকের কাছে আমার গল্পটিও খুব হাস্যকর,যেহেতু মুরগি একটা সাধারন সহজলভ্য প্রানি, যে কারো বাড়িতেই থাকতে পারে, সুতরাং এর কোন কদর নেই। কিন্তু একটি কাক পাখিও কারো কাছে অসাধারন হয়ে উঠতে পারে,যদি তিনি সেটিকে আদর, ভালবাসা,মমতা দিয়ে লালন করেন। সে যাই হোক, প্রিন্সেস চলে যাবার পর দুই দিন শুধু চোখের জল ফেলেই কাটালাম। সিদ্ধান্ত নিলাম প্রিন্সেস যেমন তার সমস্ত বেদনা একা নিজের করে নিয়ে চুপটি করে বসে ছিল, আমিও তাই করব। কাওকে কিছু বলব না, যারা বুঝবে না তাদেরকে বলে নিজেকে হাসির পাত্র করার কোন মানে হয় না। বরং নিজেরটা নিজেকেই সামলে নিতে হবে।
তারপরও বেঁচেছিলাম আরো দুটি প্রানির মুখ চেয়ে- প্রিন্স আর ছোট প্রিন্সেস। বিকেল বেলা ছাদে উঠে এদেরকে নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলাম।যদিও ভেতরে ভেতরে রক্তক্ষরণ হত ঠিকই, তবু কাওকে বুঝতে দিতাম না।কিন্তু পরদিন সকাল বেলাই শুনি প্রিন্স উঠে দাঁড়াতে পারছেনা। তাকেও বারান্দায় এনে বসালাম।খাবার খেতে চায় না, শুধু পানি খায়। সেই একই অবস্হা, আমি একটু পরপর পানি দেই মুখের সামনে। সে একটু পানি দিয়ে তার গলাটা ভেজায়। এভাবে থাকার পর একসময় অচেতন হয়ে গেল। প্রিন্স, প্রিন্স বলে ডাকলেও তার কোন সাড়া নেই। বুঝতেই পারছি, সেও আমাকে শূণ্য করে দিয়ে ওপারে চলে যাবে।
.
তখন বিকেল ৩টা বা তার কাছাকাছি হবে। মা ডাকছে আমাকে,
“দেখে যাও প্রিন্স কি করছে”
আমি কাছে গিয়ে দেখি ওর জ্ঞান ফিরেছে। ও ছটফট করছে, মুখ দিয়ে কষ্টে কেমন একটা চিঁচিঁ আওয়াজ করছে। শরীরে খিচুনী হচ্ছে, মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো। তার এ দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারছিলাম না।তার মাথার কাছে বসে ছিলাম আর ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছিল। প্রিন্স মুখটা একটু মেলে দিল, আমি তাতে একটু পানি দিলাম। তারপর ঘাড় উল্টে আমাকেই শুধু দেখছিল। পানি দিয়ে জিভটা ভেজানোর পর সে আমার দিকে তাকিয়েই রইল। এরই মাঝে কখন যে চলে গেল,তা বুঝতেই পারলাম না।
তারপর দিন চলে গেল ছোট প্রিন্সেস।
প্রিন্সেসের মত আমি সকল কিছু একা সইবার অসীম ক্ষমতা রাখি না। তাই সইতে না পেরে পাগলের মত যাকে পাই তাকেই বলে বেড়াই,এমন পরিস্থিতি হল। বেশিরভাগ মানুুষ আমাকে এড়িয়ে গেল। তবে সেটা গায়ে লাগার মত মানসিক অবস্হা আমার ছিল না। এরই মাঝে কিছু পাখিপ্রেমী, হৃদয়বান মানুুষ আমার অবস্হাটা বুঝতে পেরে পাশে এসে দাঁড়ালেন। নানা ভাবে শান্ত করার চেষ্টা করলেন তাঁরা আমাকে। তবু কি আর এত দ্রুত হৃদয়ের আর্তনাদ থেমে যায়? তাদের কথা মনে পড়লেই ভেতরটা হুহু করে উঠে।
এখনো আনমনে অজান্তে জানালার ফাঁক গলে পেছনে তাকাই, মনে হয় ওরা সেখানেই আছে।পরক্ষণেই মনে হয়, না, ওরা আর কোথাও নেই। এখন আর বিকেলে ছাদে যাই না, গেলেই তো দেখব ছাদটা খা খা করছে…..চারদিকে শুধু শূণ্যতা। এখন আর সকাল থেকে বিকেল হয়না কুক্কুরুক কুক কূজন শুনে। এখন আর কেউ আদরের ভাগ সমান না পেলে পায়ে কামড় বসায় না। আর কোলে ওঠার জন্য কেউ কুক কুক বলে বায়না করে না।কোল এখন শূণ্য পরে রয়। কেউ রুটি খাবে বলে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে হাতে করে রুটি আনতে হয় না।
এখন চারিদেকে শুধুই শূণ্যতা। ওরা কেউ নেই।
.
মহান সৃষ্টিকর্তার পাঠানো সোনালী অতিথিরা সোনারঙ বিলিয়ে ফিরে গেছে নিজ ভূবনে।
সমাপ্ত
১২টি মন্তব্য
নীহারিকা
মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেলো। এমন ঘটনা আমাদেরও ঘটেছে। তারপর থেকে আম্মা আর মুরগী পালেন না। একবার কোরবানির জন্য একটি খাসী কেনা হয়। বেশ কয়েকমাস পালার পর কোরবানি ঈদের দিন কি যে এক দৃশ্য বাসায়। এরপর থেকে আমরা আর কোন প্রাণী পালন করি না। যারা পেলেছে তারা এর কষ্ট বুঝে।
নীরা সাদীয়া
ঠিক বলেছেন,যারা পেলেছে, তারা কষ্টটা বোঝে।
আমার কষ্টটা আপনাদের সাথে ভাগ করে নিতে পেরে কিছুটা প্রশান্তি পেলাম।
শুভকামনা রইল।
ব্লগার সজীব
আপু, বুঝতে পারছি আপনি অত্যন্ত সংবেদনশীল একজন মানুষ। ভালবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতার অনেক উঁচু স্তরে আপনি বিচরন করছেন। যে স্তরে অনেকের পক্ষেই পৌছানো সম্ভব না। যে কারনে আপনার সমস্ত বন্ধুরা এ নিয়ে হাঁসি তামাশা করেছে। সব কিছু পড়ে মন আমারো আদ্র হয়ে গেলো। এদের সাথে আপনার সম্পর্ক খুব সাবলীল ভাবে তুলে ধরেছেন আমাদের মাঝে। আপনার হৃদয়ের কান্না আমাকেও স্পর্শ করছে। মনে হচ্ছে প্রিন্স, প্রিন্সেস আমারও সাথে থাকা ভালোবাসার এক একটি নাম।
নীরা সাদীয়া
gg আমার প্রিন্স প্রিন্সেসরা আপনার হৃদয়ে স্থান পেয়েছে জেনে আনন্দিত হলা।
পাশাপাশি আমার কষ্টটা আপনাদের সাথে ভাগ করে নিতে পেরে কিছুটা প্রশান্তি পেলাম।
শুভকামনা রইল।
নীলাঞ্জনা নীলা
মানুষ এসব আবেগ বোঝেনা নীরা। আমি আজ পর্যন্ত কুকুর বা বেড়াল পোষার কথা ভাবতেই পারিনা।
মনটা সত্যি খুব খারাপ হয়ে গেলো।
নীরা সাদীয়া
হুম। ঠিক বলেছেন। খুব কষ্ট হয়েছে আমার।
অনেক শুভকামনা রইল।
শুন্য শুন্যালয়
প্রিন্স প্রিন্সেস যেন আমার নিজের পোষা পাখির মতো হয়ে উঠেছিল। মনটা খারাপ হয়েছে ওদের চলে যাওয়াতে।
তুমি খুবই আবেগি একটা মেয়ে। লেখা হিসাবে খুবই উঁচু আর গোছালো পর্ব তিনটা। লেখালেখির চর্চা নিয়মিত করো।
নীরা সাদীয়া
আপনাদের মত অত ভাল লিখতে পারিনা,তবে চেষ্টা করি। এত সুন্দর মন্তব্য পেয়ে অনুপ্রাণিত হলাম। আমারো খুব কষ্ট হয়েছিল ওদেরকে হারিয়ে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছি।
অনেক শুভকামনা রইল। ভাল থাকবেন।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
যে ভাবে গল্পটি শেষ করলেন তাতে বাহবা দিতে হয় এমন সব প্রকৃতির প্রানীর প্রতি দরদ দেখে।লেখা পড়েতো সমস্যা হয়ে গেল আর মনে হয় প্রিন্সেসদের খাওয়া ঠিক হবে না। -{@
নীরা সাদীয়া
ওরা তো আর নেই। খাবেন কি কিকরে? তবে যাদের সাথে কখনো এমন আত্নার সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি, তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা আলাদা। তবে প্রতিটা প্রানিই বাঁচতে চায়। বাঁচার জন্য আকুল আবেদ জানায়।
ধন্যবাদ। শুভকামনা।
মেহেরী তাজ
সম্ভবত কক্সিডিওসিস ছিলো!
ভালো চিকিৎসা করানো দরকার ছিলো!
আপু আর একজন পাখি প্রেমী পেলো আমাদের সোনেলা!
লেখা গুলো পড়েছি সব। বেশ গুছিয়ে লিখেছেন সব কটা পর্ব।
নিয়মিত লিখুন।
ভালেগেছে এই কটা পর্ব।
নীরা সাদীয়া
ওদের গল্প এখানেই শেষ। সাধ্যমত চিকিৎসা করানো হয়েছিল। তবে যদি তাদের মৃত্যু লেখা থাকে তবে বাঁচানোতো সম্ভব নয়। মূলত, এর আগেও চিকিৎসার আর সেবার জোরে আরো কবার সুস্থ হয়ে উঠেছিল তারা।কিন্তু এবার আর তা হল না।
ধন্যবাদ। আবার দেখা হবে নতুন কোন গল্প নিয়ে। ভাল থাকুন।