
আমাকে অনেক সময় অনেক লোকে বলে, ‘বাবু মুসলমান হয়ে যান’। আপনাদের এটা একটা ধর্ম হলো? কী যে করেন আপনারা? বুঝি না! এসব কথা শুনে আমি মনে মনে বলি, ‘আমিও তো দাদা কিছুই বুঝি না। না বোঝার কারণেই শুধু ভাবি। ভাবতেই থাকি। আসলে কি আমি হিন্দু? নাকি মুসলমান? না-কি ইহুদি খ্রিস্টান? কিন্তু বাবা এবং মাকে দেখেছি দেবমূর্তি পূজা করতে। তাঁদের দেখায় আমিও দেবমূর্তিতে পূজা দেই। আচ্ছা, আমি যদি অন্য ধর্মের সমাজে বড় হতাম? তখন আমি কি দেবমূর্তিতে পূজা দিতাম? এখন তো ইচ্ছে করলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে পারি। খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে পারি। বৌদ্ধ ধর্মও গ্রহণ করতে নিষেধ নেই। যদি ধর্মান্তরিত হই, তাহলে কি আমার মনুষ্যত্ব জীবনের সব ঠিক হয়ে যাবে?
এসব নিয়ে আমি অনেকসময় নীরবে বসে একা একাই ভাবি। ভাবি আমার জন্ম মৃত্যু আর ধর্ম নিয়ে। এসব নিয়ে শুধু আমি কেন, আমার মত এমন ভাবনা মনে হয় অনেকেই ভেবে থাকেন। তবে কে কেমনভাবে ভাবছেন, তা আমার জানা নেই। আমি ভাবছি এই নশ্বর ভবসংসারে আসার আগের অবস্থা থেকে শুরু করে মৃত্যুর পর পর্যন্ত। যখন আমি মাতৃগর্ভে আসার আগে কেমন ছিলাম, তখন আমার অবস্থা আর ধর্ম কী ছিল? যখন মা বাবার আনন্দের ফসল হয়ে মাতৃগর্ভে ছিলাম, তখন আমার অবস্থা কেমন ছিল এবং ধর্মটাই বা কী ছিল?
আর আমি যদি না আসতাম, তাহলে আমার বাবা কে, আর আমার মা-ই-বা কে হতেন? আমার মা কে, আর বাবাই বা কে? তাঁদের পরিচয়ই বা কী থাকতো? মাতৃগর্ভে থাকতেই যদি আমার বাবা মারা যেতেন, আর ভূমিষ্ঠ হবার পরপরই যদি আমার মায়ের মৃত্যু হতো? আর যদি আমার কোনও ভাই-বোন না থাকতো? আত্মীয়স্বজনও যদি না থাকতো? আমার পরিচয় এবং আমার ধর্মীয় পরিচয়ই বা কী হতো? আমার নামও কী বর্তমান নাম হতো? নাকি অন্য নাম হতো? আমার ধর্মীয় পরিচয় কি হিন্দু থাকতো? নাকি ইসলাম নাহয় বৌদ্ধ খ্রিস্টান হতো? এসব প্রশ্নের উত্তর মেলাতে গেলেই মাথা ঘুরে। আবার খুবই সহজ মনে হয়।
সহজ হলো এভাবে, যেমন: আমি মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হবার পর যদি কোনও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আমাকে লালন-পালন করে তাঁদের পরিচয়ে বড় করতো? তাহলে সোজা কথায় আমার নাম হতো মিস্টার হেমিলটন। আর ধর্মীয় পরিচয় হতো খ্রিস্টান। তখন আমি ছোটবেলা থেকেই খ্রিস্টান ধর্মের কিতাব বাইবেল পড়তাম। গির্জায় যেতাম। খ্রিস্টান ধর্মীয় আচার আচরণে বড় হতাম। তাঁদের ধর্মীয় নিয়ম-কানুন মেনে চলতাম। এখন যেমন সনাতন ধর্মের নিয়মকানুন মেনে চলি, তখন মানতে হতো খ্রিস্টান ধর্মীয় নিয়ম-কানুন। তাহলে এখানে দেখা যায় ধর্ম কোনও ব্যাপার না। জন্ম এবং কর্মই বাধ্যবাধকতা। জন্ম আমার যেখানেই হোক না কেন, কর্ম দিয়েই আমার পরিচয়–আমি একজন মানুষ।
আর যদি কোনও ইসলাম ধর্মাবলম্বী আমাকে তাঁদের পরিচয়ে, তাঁদের সন্তান মনে করে লালন-পালন করে বড় করতো, তাহলে আমার নাম হতো হালিম, নাহয় ডালিম। তখন আমি ছোটবেলা থেকে মক্তবে যেতাম। আরবি শিক্ষা বই বা কুরআন পড়তাম। মসজিদে যেতাম। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতাম। রমজান মাসে রোজা রাখতাম। ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদগাহে যেতাম।ঈদের নামাজ আদায় করতাম। ঈদুল আজহায় পশু কুরবানী করতাম। এখন যেমন পূজা করি। মন্দিরে গিয়ে দেবমূর্তিতে প্রণাম করি। সকাল সন্ধ্যা ঘরে বা মন্দিরে প্রার্থনা করি। হরিনাম জপ করি। রামায়ণ পাঠ করি। গ্রন্থ পাঠ করি। গীতা পাঠ করি। এখানেও দেখা যায় ধর্ম কোনও ব্যাপার না। জন্ম এবং কর্মই বড় ব্যাপার। তাহলে বোঝা যায়, জন্ম আমার যেখানেই হোক-না-কেন, কর্ম দিয়েই আমার পরিচয়– আমি একজন মানুষ।
আমি ছোটবেলা থেকে যদি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমাজে বড় হতাম বা ইহুদি সমাজে বড় হতাম, তাহলে তাঁদের ধর্মীয় নিয়ম-কানুন মেনেই আমি চলতাম। বৌদ্ধ মন্দিরে যেতাম। ত্রিপিটক পাট করতাম। ইহুদিদের ধর্মীয় কিতাব পড়তাম, শিখতাম। এখানেও একইরকম অবস্থার সৃষ্টি। এরকম হতো না, যদি আমি জানতাম আমার জন্ম হিন্দু ধর্মে। কিন্তু আমি তো জানি না আমার জন্মের ঠিকানা। তাহলে ধর্ম দিয়ে আর কী হবে? আমি যেই ধর্মে জন্মগ্রহণ করেছি, সেই ধর্মে কি আমি বড় হয়েছি? আমি বড় হয়েছি ইহুদিদের ঘরে। আমি বুঝের হয়েছি মুসলমানদের ঘরে। আমি লালিত পালিত হয়েছি খ্রিস্টানের ঘরে। তাহলে ধর্ম নিয়ে এতো বেদ-বিচার কেন?
আর মানুষের প্রতি এতো ঘৃণা কেন? সে হিন্দু। সে মুসলমান। সে খ্রিস্টান। সে বৌদ্ধ। সে ইহুদি। সে ডোম। সে চাঁড়াল। সে ধোপা। সে নাপিত। সে কুলু। এমন বৈষম্য কেন? আর ধর্ম নিয়েই বা এতো বাহাদুরি কেন, হীনমন্যতা কেন? আমি একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে ঘৃণাই বা করছি কেন? অন্য ধর্মের প্রতি আমার এতো ঘৃণা কেন? এটাই কি আমার ধর্ম? উত্তর আসে এটা আমার ধর্ম না। আমার ধর্ম হোক মানুষের ধর্ম। মানবতার ধর্ম। ধর্ম দিয়ে তো মানুষ চেনা যায় না। কর্মতেই মানুষ চেনা যায়। তাই জন্ম যেই ধর্মেই হোক-না-কেন, কর্ম দিয়ে পরিচয়–আমি একজন মানুষ।
ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ।
২২টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
দাদা এই সবের কিনারা তখনই করতে পারবেন যখন অন্য ধরম গ্রন্ধ আপনি পড়ে জানবেন। আপনার ধরম পড়ুন, কোরআন, বাইবেল, ত্রিপিটক ও অন্যান্য পড়ুন। কিন্তু আমাদের ধরম গ্রন্ধ যদি আমাদের মতই পড়তে হই তবে পরিস্কার পরিছন্ন এবং অযু অবশ্যই আবশ্যক। অযু ছাড়া কোরআন স্পরশ করা নিশেধ। অন্যান্য খবর বা নিয়ম আমার জানা নাই তত। আর অবশ্যই স্রিস্টিকরতা আছেন। তাকে সরন করা আমাদের উচিত। কোন মানুস কি করল সেটা মুখ্য নয় আমি ধারমিক হয়ে কি করছি সেটাই আমার কাছে মুখ্য।
আল্লাহ হাফেজ। আল্লাহ সবার প্রতি দয়ালু হোন আমিন।
নিতাই বাবু
আপনার সুন্দর মতামতের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় মজিবর দাদা। আশা করি ভালো থাকবেন।
ছাইরাছ হেলাল
আপনার জটিল কিন্তু মৌলিক প্রশ্নের উত্তরে যাচ্ছি-না।
তবে এইটুকু জানি/মানি প্রকৃত ধার্মিক কাউকে-ই ঘৃণা করতে পারে না।
নিতাই বাবু
জন্মসূত্রে ধর্মের কারণে প্রতিনিয়ত ঘৃণিত হচ্ছি। ধর্মই নাকি মানুষের আত্মসম্মান। ধর্মই নাকি সব। তাই আর কারোর সাথে প্যাঁচালো না জরিয়ে মাথা নত করে থাকি।
আপনার সুন্দর মূল্যবান মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, শ্রদ্ধেয় দাদা।
মোঃ মজিবর রহমান
এটা আমি মানিনা। ধরম পালন করি কিন্তু ঐ সব যদি হই লুইচ্চা, বদমাস, চোর বাটপার, খুনি, তাকে আমি স্বীকার করিনা।
প্রদীপ চক্রবর্তী
মর্মত্ত্ব…. আমার ধর্ম হোক মানুষের ধর্ম। মানবতার ধর্ম। ধর্ম দিয়ে তো মানুষ চেনা যায় না। কর্মতেই মানুষ চেনা যায়। তাই জন্ম যেই ধর্মেই হোক-না-কেন, কর্ম দিয়ে পরিচয়–আমি একজন মানুষ।
কর্মে অধিকার ধর্মে এবং ফলে নয়।
যে নিজের ধর্মকে সম্মান করতে জানে সে অপর ধর্মকে সম্মান করতে জানে।
ভালো উপস্থাপন দাদা।
মন্তব্য আপনার শেষের কথাগুলো তুলে ধরলাম।
নিতাই বাবু
আমি ধর্মতে নই দাদা। আমি জন্মতে ভক্তি রেখে কর্মতে বিশ্বাসী।
হিমু ভাই
জবাবটা ভালো ছিল ভাই সাহেব।
সাবিনা ইয়াসমিন
সব ধর্মেই শান্তি, মানবতা, অহিংসার কথা বলা হয়ে থাকে। প্রকৃত ধার্মিক কখনো অন্যের ধর্মকে হেয় করেনা। যেকোনো ব্যাক্তি যদি সঠিকভাবে নিজ ধর্ম পালণ করে, নিজ ধর্মের প্রতি অনুগত থাকে, তাহলে তার দ্বারা অকল্যাণকর কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কট্টরপন্থী দের চিন্তাধারা ভিন্ন, তারা মুলত ধর্মের অনুসারী না হয়ে, নিজ স্বার্থের আনুসারী হয়। যত বিশৃঙ্খলা এরাই সৃষ্টি করে।
ধর্ম যার যেটাই হোক, কাজ যেনো কল্যানের হয়। মানুষের কল্যানে নিজেকে নিয়োজিত রাখাতেই আত্মার সুখ থাকে।
শুভ কামনা দাদা 🌹🌹
নিতাই বাবু
আমি আমার জন্মের প্রতি ভক্তি রেখে কর্মেই বিশ্বাসী।
মনির হোসেন মমি
ধর্ম দিয়ে মানুষ বিচার করে তারাই যারা ধর্মান্ধ। আপনার কথার সাথে একমত পোষন করে একটু যোগ করব। সত্যিই যদি জন্মে আমাকে ধর্ম ইসলামে না হয়ে অন্য ধর্মে হত তবে আমি তাই করতাম যা আমার জন্মগত ধর্মে আছে।এখন বিষয়টা হল এক ধর্মে আছে ওমুক কাজ করা নিষেধ আবার আরেক ধর্মে একই কাজ জায়েজ ধর্মের এই ভিন্ন বিধি নিষেধে মানুষের কি করণীও দাদা! তাহলে মানুষ কেন হবে পাপী যেহেতু জন্মের ধর্মটা তার স্রষ্টার ইচ্ছায়।
তবে হ্যা আমাদের ইসলাম ধর্মে আল্লাহ বলে দিয়েছেন-আমি তোমাকে সৃষ্টি করে তোমাকে বিবেক বুদ্ধি ভাল মন্দ বুঝার ক্ষমতা দিয়েছি এবার স্বর্গ নরক বেছে নেবার পালা তোমার।
সুন্দর লেখা।
নিতাই বাবু
শ্বর্গ কোথায় আর নরক কোথায়? সবই আমার কর্মফলের উপর নির্ভর করে। আমি কিন্তু তাতেই বিশ্বাসী, দাদা।
আরজু মুক্তা
কোন ধর্মই বলেনা খারাপ কাজ করো, অসৎ পথে চলো। মানবতাই বড়।
নিতাই বাবু
হ্যাঁ, দিদি। আমি এতেই বিশ্বাসী। ভালো থাকবেন আশা করি।
তৌহিদ
ধর্ম নিয়ে আমি মন্তব্য করতে ভয় পাই। আমার ধর্মে যেসব বিধিনিষেধ আছে সেগুলো আমার কাছে সঠিক, তেমনি অন্যদের বেলায় তাদের ধর্ম।
তবে কোন ধর্মেই মানুষকে ছোট করে দেখার কথা বলা নেই মনে হয়, অন্তঃত আমার ধর্মে নেই।
নিতাই বাবু
সুন্দর মতামতের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানবেন, শ্রদ্ধেয় দাদা।
নাজিয়া তাসনিম
আমার কাছে মনে হয়, শুধু পড়ালেখা আর ডিগ্রি অর্জন করে মানুষ এতটা উদার হতে পারে না। সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করার শিক্ষাটা এজন্য পরিবার থেকে শিখানো উচিত। 🙂
নিতাই বাবু
একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষেরও মনোভাব কেমন জানি হয়ে থাকে। সত্যি আমরা ধর্মের সব সত্য বানীগুলো শুনেও এই পৃথিবীতে অসৎ কর্ম গুলো বেশি করে থাকি।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
ধর্ম নিয়ে আপনার বিশ্লেষণধর্মী লেখাটি পড়ে ভালো লাগলো। যারা স্রষ্টাকে অন্তর থেকে খুঁজে তারা অবশ্যই পায়।
নিতাই বাবু
আমার বক্তব্যের সাথে আপনার সুন্দর মন্তব্যে হুবহু মেলে যায়, শ্রদ্ধেয় দাদা। আপনার মূল্যবান মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
আকবর হোসেন রবিন
আমি একটা কোচিংয়ে পড়ায়। ওখানে শতকরা ৯০% স্টুডেন্ট হিন্দু ধর্মালম্বী। তো নতুন কোন স্টুডেন্ট আসলে কোন জানি প্রথমেই জিঙ্গেস করতো, ভাইয়া আপনি কি হিন্দু নাকি মুসলিম? যখন আমি বলতাম মুসলিম, তখন মুহুর্তেই তাদের চেহারায় অন্ধকার নেমে আসতো। পরে একটা সময় থেকে আমি ভিন্নভাবে জবাব দেওয়া শুরু করলাম। বলতাম সবার আগে পরিচয় আমি তোমাদের মতো রক্ত মাংসের একজন মানুষ।
দাদা আপনার লেখাটা অনেক অনেক ভালো লেগেছে। আমি সুন্দর করে মন্তব্য করতে পারিনা। তাই ভালো লাগাটাও সুন্দর করে ব্যাখ্যা করতে পারছিনা। ভালোবাসা নিবেন।
নিতাই বাবু
আপনার সুন্দর গঠনমূলক মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি, শ্রদ্ধেয় দাদা।