আজ কবিতার খাতা শূন্য। কলম আজ কেঁপে উঠছে। আমি বিরক্ত, আমি হতাশ, আমি কেন যেন তলিয়ে যাচ্ছি, ঐ আকাশ থেকে কেউ শূন্যে আমায় ছেড়ে দিচ্ছে। আমি পড়ে যাচ্ছি ঢুকে যাচ্ছি কোনো এক অন্ধকার গহ্বরে।
গুলশানে জঙ্গি হামলার পরবর্তী ফেসবুক স্ট্যাটাস ও মন্তব্যেই কেন যেন বেশি হতাশ লাগছে আমার। কেউ ক্রাশ খাচ্ছে, কেউ সমবেদনা জানাচ্ছে, কেউ সাংবাদিকদের উৎসাহ দিচ্ছে এই খবর সরাসরি লাইফ দেখাতে।
আমি প্রথমে এই ক্রাশ খাওয়া কিউট ছেলেদের কথা বলি—- এরা নাকি ভদ্র ঘরের ছেলে, উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলে! আসলে এসব নষ্ট হয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের জন্য বাবা মা অবশ্যই দায়ী। তারা বয়স না হতেই ছেলেমেয়ের হাতে দামি স্মার্ট ফোন ধরিয়ে দিচ্ছে, হাতে টাকা গুজে দিচ্ছে, বন্ধুদের সাথে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আড্ডা দিতে দিচ্ছে। বাচ্চা কোচিং গেল কিনা সেই খোঁজটুকু নেয় না। মোড়ের দোকানে বসে টিভি দেখছে না হয় কোনো ফাস্টফুডের দোকানে বাজে আড্ডা দিচ্ছে। তাদের এই উন্মুক্ত চলাফেরাকে আমরা স্বাধীন বলে উড়িয়ে দিচ্ছি। কিছুদিন আগে, কোনো এক স্কুলের বাচ্চাদের দেখলাম স্কুল ড্রেস পরে রাস্তায় ওপেনে প্রপোজ করছে, চুমু খাচ্ছে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরছে। তা আবার অনেক সুশীলরা উৎসাহ দিচ্ছে। এই অপরিণত প্রেমে অবশ্যই আমার আপত্তি, এমন চলাফেরায় আমার আপত্তি।
একটা ঘটনা বলি—- উনি তখন ধানমন্ডিতে সেকেন্ড অফিসার হিসেবে। আমি থানায় কখনোই তেমন যাইনা। এক বাবা প্রচন্ড কান্নাকাটি করছে। মা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে, পাশে নামকরা এক স্কুল ড্রেস পরা এক বাচ্চা দাঁড়িয়ে। নাইন টেনে পড়ে। বাচ্চাটাকে মারা মারছে খুব। আমি অবাক এবং বিরক্ত হয়ে বললাম,” কি হইছে ? কেন মারছেন “? তারা কেঁদেই যাচ্ছে। উত্তর দিবে কী ! পরে জুলির সহকারি বলল,” মেয়েটি একটা কম্পিউটার সেন্টারে কম্পিউটার শিখত, ওখানে এক ছেলের সাথে ওপেন সম্পর্কের ছবি মেয়েটির বাবার কাছে দিয়ে ব্লাকমেইল করছে। তখন এই ব্যাপারগুলো মিডিয়াতে খুব আলোচনার বিষয় ছিল। পরে ধানমন্ডির পুলিশ এই বিষয়গুলো দেখেছিল। কিন্তু যারা এর সাথে জড়িত প্রত্যেকেই উচু ঘরের সন্তান।
ঘটনা ২— ঢাকা থাকতে পাশের ফ্লাটে গ্রাম থেকে এক কিশোর এসেছিল বেড়াতে। বয়স তখন তার চৌদ্দ পনেরো। সিঁড়ি ঘরে আমার ছটকু খেলত। আমার বাচ্চাকে দেখে খেলতে আসত। গল্পে গল্পে জিজ্ঞেস করলাম,” ঢাকা বেড়াতে এসেছ “? ও সহজ সরল ভাবে উত্তর দিল,” বাইরে পড়তে যাব”। ছেলেটি খুবই সহজ সরল, তাই বলে দিল, হুজুর বলতে নিষেধ করেছে। সংগে সংগে আমার মাথা ঘুরে গেল। ওর খালাকে বললাম। ওর খালা সাথে করে ছেলেটিকে গ্রামে রেখে আসল। পরবর্তী পদক্ষেপ উনি গ্রহন করেছিলেন।
আসলে সন্তান পালনে ও সমাজ গঠনে আমাদেরই ঘরোয়াভাবে সচেতন হতে হবে। আমি সত্যি এখন মোড়ে বা জড়ো হয়ে যেসব ছেলে ফোনে মগ্ন থাকে তাদের সামনে হেঁটে যেতে অস্বস্তিবোধ করি। আমার মনে হয় সময় এসেছে ফোন ব্যবহারে বয়স নির্ধারনের। আমার মেমন, ক্লাস সিক্সে পড়ে। অনেক সময় ক্যাডেট কোচিং করার জন্য ও নিজে থেকে নেট থেকে অনেক তথ্য বের করার চেষ্টা করে। এখন সে জিনিসটা এড়িয়ে যাচ্ছে। একদিন বলেই ফেলল, “মা নেটে খুব খারাপ জিনিস বের হয়ে আসে”। আমি তো এমন ধাক্কা খেলাম কি বলব!
আমি অনেক বাবা মায়ের মোবাইল ফোনে অনেক খারাপ জিনিস সেভ করে রাখে। এটা আমায় অবাক করে। আমার এক আপামনির দুই ছেলেমেয়েই ডাক্তার। আপামনি আমাকে বলে,” মনা, ছোট থাকতে ছেলেদের সাথে তোর স্কুলে না গেলেও চলবে, বড় ক্লাসে উঠলে যাস”।
আমি এই ঘটনায় আমার ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা কয়েকজনের স্ট্যাটাস দেখে ও আমার পোস্টে মন্তব্য দেখে অবাক হলাম। তাদের অনেকেই পোষাক পরার সময় পাকিস্তানি *লন* কাপড়ের থ্রী পিস্ ও ইন্ডিয়ান থ্রিপিস ছাড়া চলেই না তারা যখন এসব পোস্ট করে সত্যি আমি অবাক হই। নিজেকেই ধাক্কার দেই এরা আমার ফ্রেন্ড লিস্টে। গুলশানের ঘটনায় ইন্ডিয়া সেনা পাঠাতে চাইছে বলে অনেকেরই গায়ে ফোসকা পড়েছে। বাংলাদেশ নাকি ইন্ডিয়া নিয়ে নিচ্ছে! সৌদি আরবের মক্কা শরিফের রক্ষায় বাংলাদেশ সেনা পাঠাতে চাইছে, তবে কি এরা তখনও বলবে? ওটা আমাদের বাপের দেশ ! অবশ্য এসব সাইকোদের নিয়ে আমি কিছু বলতে চাইনা।
ধর্ম কখনো কারো ভালোবাসার উপর জোর করেনি। আমি মানবতায় বিশ্বাস করি। এই ধর্মই সব থেকে বড় ধর্ম। ইসলাম আমার ধর্ম। আমি অবশ্যই এই ধর্মকে ভালবাসি। অন্য ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাতে আমাকে শেখানো হয়নি। হিন্দুকে হিন্দু, খ্রিষ্টানকে খ্রিস্টান বললে কি সমস্যা জানিনা। এরা সবাই আমার সহপাঠি। আর এক আন্টি ছিল। উনি আমাদের হাসপাতালের লানা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রধান ডাঃ বরেন কুমারের মিসেস ছিলেন। আন্টির কাছ থেকে যে ভালোবাসা আমি পাইছি তা কখনো মুখে বলতে পারব না। আমি ছিলাম মনে হয় আন্টির আর একটা মেয়ে। আমার বিয়ের পরে আন্টি ঢাকা কল্যাণপুরে ছিল। প্রায়ই ওখানে যেতাম। আমার যা যা পছন্দ তাই তাই আন্টি রান্না করত। মায়ের গন্ধ আন্টির মধ্যে ছিল। কিন্তু আমি এক হতভাগা আন্টিকে ধরে রাখতে পারিনি। ঐ না ফেরার দেশে চলে গেছ। তার মুখটাও দেখতে পারিনি। এই ভালোবাসা তো কোনো ধর্ম মানে না।
আজ কেন যেন কোনো এক মন্তব্যে আমায় এলোমেলো করে দিছে। ব্লগ, ফেসবুক অর্থহীন লাগছে। আমরা কি আসলে সামাজিক ? আমরা কি জ্ঞান নিয়ে বেড়ে উঠেছি ?
১৮টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
সত্যিই আজ সব কিছু অর্থহীন মনে হচ্ছে,
কোন গন্তব্যে আমরা যাচ্ছি!
মৌনতা রিতু
অর্থহীন আসলেই সব কিছু। সন্তানের মাঝে নিজেকে দেখাও মনে হয় অর্থহীন।
জিসান শা ইকরাম
সন্তান লালন পালন আসলেই আজকাল কঠিন হয়ে গিয়েছে।
তাদের বন্ধুদের সাথে চলার সমান স্টাটাস বজায় রাখার জন্য প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে।
মোবাইল, মটরবাইক কিনে দিতে হচ্ছে, সন্তানের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে।
ফেইসবুকে সবাই বিদ্যান, এমন কোন বিষয় নেই যে জগতের সবচেয়ে অভিজ্ঞ মতামত বাঙ্গালিদের কাছে পাওয়া না যায়।
রুচি বিকৃতির চরমে পৌছে গিয়েছে ফেইসবুক।
আপনার মত সবারই মন বিক্ষিপ্ত।
মৌনতা রিতু
ফেইসবুকে ৯০ ভাগ লোকেরই মনে হয় মাথায় সমস্যা।
যার যার সন্তান তার তার ভাল রাখার এই প্রতিযোগিতায় আজ সব কিছু নষ্ট হচ্ছে। এর কারনে কার উপর কি প্রভাব পড়ছে বুঝতেই জেন চাচ্ছি না। ছেলেমেয়েদের মধ্যেই আমরা আমাদের ফুটানি তুলে ধরছি।
লীলাবতী
মন খারাপ আমাদের সবারই। মন খারাপ করে কি হবে আপু? আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে যেনো ভাল রাখেন।
মৌনতা রিতু
আল্লাহর উপরই সব ভরসা।
মেহেরী তাজ
ভাবি কিচ্ছু ভালো লাগতেছে না কিচ্ছুনা। মাথার জ্যাম ছাড়াতে পারছিনা কিছুতেই!
মৌনতা রিতু
ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু।
তবুও বেঁচে থাকা।
আবু খায়ের আনিছ
ঘটনার দিন এতটাই বিরক্ত হয়েছিলাম ফেইজবুকের প্রতি যে শেষ পযন্ত বলতে বাধ্য হয়েছি ভাই তোর চুপ কর। একদিকে আতংক উদ্বেগ অন্যদিকে এদের অত্যাচার।
বাংলাদেশে ফেইজবুক সহ মোবাইল ব্যবহারকারীর একটা বড় অংশ অপ্রাপ্ত বয়স্ক। এরা আবার খুব গর্বের সহিত বলে আমি এত বছর বয়সে মোবাইল পেয়েছি, এত দিন আগে থেকে ফেইজবুুক ব্যবহার করছি। ভালো খারাপ দুটোই আছে, কিন্তু আমরা কোনটা গ্রহণ করছি? ভালোটা বেশি নাকি খারাপ টা বেশি।
সঙ্কিত,স্তব্ধ আমি।
মৌনতা রিতু
আসলেই ভাল লাগছে না।
ঘুমের ঘোরে কেটে যাওয়া অনন্ত পথ
জানি না সামনে আর কি অপেক্ষা করছে।
আর ভাল লাগছে না এসব। একটু শান্তি নাই কোথাও
মৌনতা রিতু
শান্তি তবুও খুঁজতে হবে। নতুন প্রজন্মকে শান্তির বানী শুনাতে হবে।
অনিকেত নন্দিনী
একটা প্রশ্ন করবো। হয়তো ভালো লাগবেনা, তাও করবো। শিল্পায়ন, শহরায়ন আর প্রযুক্তির সর্বোচ্চ উৎকর্ষের এই স্বাধীনচেতা যুগে ১৮ পেরিয়ে যাবার পর সন্তানকে কতোটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়?
“উনি আমাদের হাসপাতালের লানা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রধান ডাঃ বরেন কুমারের মিসেস ছিলেন” – এখানে মিসেস কথাটা বড্ড বেমানান লাগছে, স্ত্রী বললেই বেশি মানানসই হতো।
মৌনতা রিতু
ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ। সঠিকভাবে মানুষ করলে আঠারোর পরে আর দেখতে হয় না। ভালমন্দ ওরাই বুঝতে পারে। তখন শুধু খেয়াল রাখতে হয় কারা তার বন্ধু। তার আগেই যদি স্বাধিনতার নামে সবই উন্মুক্ত করে দেই ঘুড়ি তো উড়তেই থাকবে।
শুন্য শুন্যালয়
স্যোশাল সাইটের সবার অবস্থা দেখে আমি সত্যিই শংকিত আপু। ঘটনাটির চাইতে বেশি আতংকিত করেছে আমাকে সবার মন্তব্য, স্ট্যাটাস। 🙁
মৌনতা রিতু
একি অবস্থা আমার। আসলে কোথায় যাচ্ছে এই প্রজন্ম ? ব্যার্থতা কি আমাদের ? কখনো কখনো নিজেদেরই দোষি করি।
শামীম আনোয়ার আল- বেপারী
লেখাটা পরে অনেক কিছু শিখলাম,
থ্যাংকস আপনাকে অসাধারণ একটা লেখার জন্য
মৌনতা রিতু
অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনাদের উৎসাহেই এই চেষ্টা আমার।