
অনুগল্প বা ফ্লাশফিকশন সম্প্রতি সাহিত্যের জনপ্রিয় শাখা হয়ে উঠেছে। তাহলে অনুগল্প কেমন হবে, এমন একটা প্রশ্ন প্রায়ই সামনে এসে দাঁড়ায়।
অনুগল্পকে জোনাকির আলো বলা যেতে পারে। একটা বৃষ্টির ফোটা অনুগল্প কারণ এটাকে টেনে নদী বা সাগর বানানো সম্ভব নয়। কিন্তু বৃষ্টির ফোটা অনিন্দ্য সুন্দর একটি শিল্প যা স্বয়ংসম্পূর্ণ। এর শব্দ সীমাকে চীনা সাহিত্যে বেঁধে দেয়া হয়েছে। স্মোকলং ফিকশন বলে। অর্থাৎ একটি সিগারেট শেষ করতে যে সময় লাগবে তার ভেতর এ গল্প শেষ হয়ে যাবে। একে মাইক্রো ফিকশন, পোস্টকার্ড ফিকশন, সাডেন ফিকশন, সুপার শর্ট ফিকশন, ন্যানো ফিকশন কিংবা শর্ট শর্ট স্টোরি নামেও ডাকা হয় বিভিন্ন দেশে।
অনুগল্পে একটি কাব্যিক দ্যোতনা বা ভাব মুদ্রা থাকে। ভাষা হয় ঘন রূপকাশ্রিত। মার্কিন কবি গ্রেস পালে বলেছেন, ” অনুগল্প কবিতার মতো ধীরে পড়া উচিত। ” অনুগল্প বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝলক দিয়ে শেষ হবে। আর্জেন্টিনার কথা সাহিত্যিক লুইসা ভেলেনজুয়েলা বলেছেন, ” I usually compare the novel to a mammal, be it wild as tiger or tame as a cow; the short story to a bird or a fish ; the micro story to an insect. ”
অনুগল্প পোকা সদৃশ্য হওয়ার কারণে শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে অতি মিতব্যয়ী হওয়া প্রয়োজন। শেষে একটা চমক বা whip crack end থাকলে ভালো হয়।
অনুগল্পকার কে হতে হয় হ্যামিলনের বাঁশীওয়ালা — যে তার বাঁশীর বোলে যা খুশি তাই করে ফেলতে পারে। অনুগল্প হলো ছোট গল্পের নবজাতক শিশু। আধো আধো কিছু কথা বলবে আর পাঠক তা বুঝে নেবে।
বৈশিষ্ট্য :
১) অল্প পরিসরে অল্প কথায় অনন্য উন্মোচন।
২) কোন গল্প থাকতেও পারে কিংবা নাও থাকতে পারে।
৩) বর্ণনার বাহুল্য নেই।
৪) কিছু বা বলা কথা উহ্য রেখে এক দারুণ রহস্য তৈরি করা।
৫) পাঠ করার পর নিজের মতো করে অর্থ খুঁজে নেবে পাঠক।
৭) অনুগল্পে হাস্যরসের জায়গা নেই। তবে, এটি সবচেয়ে বেশি মনন বা বোধের জায়গা।
অনুগল্প সবটুকু বলে না। বেশির ভাগই থেকে যায় পাঠকের জন্য। জগদীশ চন্দ্র বলেছেন, ” সংকেতময় সংক্ষিপ্ত কয়েকটি বাক্যবিন্যাস পরিবেশ প্রস্তুত করে। উপসংহারে বাক্যে অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত অথচ অনিবার্যভাবে ভাব সত্যের বিদ্যুৎ বিকাশই এর বৈশিষ্ট্য।”
অনুগল্পে , অস্পষ্ট আলো আঁধারির মায়াভুবন অখণ্ড দেহ কান্তি দৃপ্তভাবে বিরাজমান। এক টুকরো আগুন বলা যায়। প্রতিটি শব্দ, বাক্য, বিরামচিহ্ন আগুনের স্ফুলিঙ্গ।
অনুগল্পে টুইস্ট থাকবে। পড়তে পড়তে মনে হবে লেখক অসচেতন। কিন্তু পাঠ শেষে পাঠক কিংকর্তব্য বিমুঢ় হবেন। এটাই অনুগল্পের নিঃশ্বাস। অনুগল্প পড়ে যেনো পাঠক স্তব্ধ হয়ে যায়।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অনুগল্পের প্রধানতম লেখক বনফুল। অনুগল্প লিখে বুকার পেয়েছেন মার্কিন লেখক লিভিয়া ডেভিস( ১৯৪৭)। আবার পুলিৎজার পেয়েছেন রবার্ট ওলেন বার্টলার ( ১৯৪৫) । অনুগল্প লিখেছেন কাফকা, হেমিংওয়ে, আর্থার সি ক্লার্ক, নগিব মাহফুজ, ডোনাল্ড বার্থলেম, আমব্রুস বিয়ার্স, কেট শপা, শেখবের মতো কথা সাহিত্যিক।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে প্রায় নয়শ শব্দে ” Cat in the rain ” অনুগল্প লিখেছেন। আবার, মাত্র ছয় শব্দে লিখেছেন, ” For sale, baby shoes never worn”
Augusto Monterrose সাত শব্দের একটি অনুগল্প এপিক বলেই বিখ্যাত। ডাইনোসর অনুগল্পে লিখেছেন “Upon waking, the dianosaur was still there.” আবার মেক্সিকান লেখক Guillermo Samperio “Fantasma ” নামে অনুগল্পে লিখলেন শিরোনাম। যেখানে শিরোনামের পর একটি খালি পৃষ্ঠা।
বনফুলের নিমগাছও একটি অনুগল্প।
সবশেষে বলবো, ছোটগল্পের সীমা ভেঙ্গে ক্ষিপ্র গতিতে রচিত হচ্ছে আজকের সব অনুগল্প। তাই এটা গল্পের জগতে টি টোয়েন্টি।
অনুগল্প লিখুন। অনুগল্প পড়ুন।
১৯টি মন্তব্য
বোরহানুল ইসলাম লিটন
গল্প উপন্যাসের চেয়েও
অনুগল্পের অন্তর্ণিহিত তাৎপর্যের
তীব্রতা অনেক বেশি হয়।
নামে বিন্দু কিন্তু গহীনে ধারণ করে সিন্ধু।
ভীষণ মুগ্ধতায় শুভ কামনা রেখে গেলাম নিরন্তর।
আরজু মুক্তা
নামে বিন্দু আর গহীনে সিন্ধু। লাইনটা ভালো লাগলো।
শুভ কামনা ভাই
আলমগীর সরকার লিটন
কবিতার মতোই এক ভাবনার চিত্র তুলে ধরতে হবে
সুন্দর মুক্তা অনেক শুভেচ্ছা রইল
আরজু মুক্তা
পড়ার জন্য ধন্যবাদ ভাই।
শুভ কামনা
ছাইরাছ হেলাল
খুব ই সুন্দর আর অতি প্রয়োজনীয় রূপ-রেখা অণুগল্পের,
লিখতে হলে জানতে-পড়তে হবে, সাহস করে দেখবেন এগুলো মেনে ঠিক-ই লিখে ফেলবো।
” For sale, baby shoes never worn” বেশ আগে পড়ে কত যে অবাক হয়েছি!! বড়রা এ জন্য ই বড়, সব সময়।
সোনেলা উপকৃত হলো আবার ও।
আরজু মুক্তা
আমি কিন্তু সেই প্রত্যাশায় থাকলাম।
আমি কিন্তু বয়সে বড়। মাথায় কিছু নেই।
সোনেলার জন্য নতুন কিছু দিলেই ভালো লাগে।
শুভ কামনা ভাই
হালিমা আক্তার
অনুগল্প কবিতার মতোই দুর্ভেদ্য। আপনার পোস্ট পড়ে অনুগল্প পড়ার আগ্রহ বেড়ে গেল। শুভ কামনা অবিরাম।
আরজু মুক্তা
আপা, ধন্যবাদ।
তবে, কথা সত্য। কনিতার মতো দুর্ভেদ্য।
জিসান শা ইকরাম
সাহিত্যের কত যে রূপ প্রকাশ হচ্ছে ধীরে ধীরে! অনুগল্প, অনুকবিতা– এসব একটু কঠিনই লাগে আমার কাছে। অনুগল্পে প্রায়ই ঝিম মেরে বসে থাকি, কি লিখলেন? এভাবেও ভাবা যায়? এমন সব ভাবনা মাথার মাঝে ঘুরপাক খায়।
ফিচার ফটোতে For sale, baby shoes never worn এটি দেখার আগেই এটি পড়েছি। খুব কষ্ট লেগেছিলো। বাচ্চার জুতো বিক্রি হবে, যার জন্য কেনা হয়েছিলো সে পৃথিবীতেই আসতে পারেনি, জন্মের সময়ই মৃত্যু হয়েছে তার।
ভালো পোষ্ট।
আরজু মুক্তা
হেমিংওয়ের দূরদর্শিতা আমাকে ভাবায়। এক লাইনে তথ্য অনেক।
শুভ কামনা সবসময়।
আর ধন্যবাদ
মোঃ মজিবর রহমান
নাম অণু কিন্তু অর্থ জগত বৃহৎ বহন করে । কয়েক দিন ধরে পড়ব পড়ব কিন্তু মনোযোগ দিতে পারিনা। যদিও এখনও অন্তরে ধারণ করতে ব্যার্থ। প্রিয়য়ে রেখেছি আবার পড়ব।
আরজু মুক্তা
আসলে আমাদের মনটাই বিচলিত করোনার কারণে। কোনকিছুতে মন বসে না।
নিশ্চয় সময় করে পড়বেন।
নিরাপদে থাকুন
মোঃ মজিবর রহমান
ধন্যবাদ আপু।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
বাপরে বাপ! অনুগল্পের আদ্যপান্ত জেনে খুব ভাল লাগল আপু। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন শুভ কামনা নিরন্তর। শুভ রাত্রি
আরজু মুক্তা
আপনিও ভালো থাকবেন। ভালো লাগলো জেনে খুশি হলাম
রোকসানা খন্দকার রুকু
এতোকিছু মাথাতেই কুলায় না। অনেক শিখতে হবে। শুভ কামনা সবসময়।
আরজু মুক্তা
আপনার মাথায় যে বুদ্ধি ! আপনি তো পড়ার সাথেই বুঝে নিয়েছেন।
শুভ কামনা সবসময়
তৌহিদুল ইসলাম
অনুগল্প নিয়ে অনেক কিছু জানলাম আপনার লেখায়। অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য। তবে সমস্যা হচ্ছে অনুগল্পকে পুঁজি করে কিছু লেখক যা লিখেন তাতে কোন মেসেজ খুঁজে পাওয়া যায়না। যেহেতু অনুগল্পে গল্প থাকতেও পারে নাও পারে তাই বিচারবুদ্ধিহহীন এইসব লেখা এবং লেখক কাউকেই দায়ী করাও সমীচীন হয়না।
শুভকামনা আপু।
আরজু মুক্তা
কার বই পড়বো? কেমন লেখা পড়বো? সেটা বরাবরি পাঠকের হাতেই। তাই ভালো মন্দ দুটোই থাক।
শুভ কামনা