
আমার দাদা ছিলেন জমিদার। মানুষের জমিজমা জবরদখল করে নিজের করে নিয়েছেন। আব্বা, একাই ছেলে। যখন যা চান তাই হাজির। আবার পড়াশোনায় ভালো। ১৯৫০ সালে তৎকালীন সরকার ছবি আঁকার এক প্রতিয়োগিতার আয়োজন করেছিলেন। আব্বা, অংশগ্রহণ করে প্রথম হয়েছিলেন। বিষয়বস্তু ছিলো : আজ হতে ৩০ বছর পর মেয়েরা বাজারে যাবে, ছেলেরা ঘরে রান্না করবে। এইচ. এস. সি দেয়ার পর সুগার মিলে তাঁর চাকরী হয়। আমার দাদা এসে নিয়ে যান। বলেন, কৃষকের কাজ করতে হবে না; আমার জমি এমনি পরে থাকে। খাবার লোক নাই।
প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ির আঙ্গিনায় বিচার বসতো। বিচার সাথে সাথেই। মারধর না হলে জমি।
এসব দেখে, আব্বা পালিয়ে আসেন বাড়ি থেকে। তারপর সরকারি চাকরি নিয়ে রংপুরে জয়েন করেন।
আব্বা বলতেন, এমনও রাতে দেখেছি : বেশি ঝামেলা করলেই বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হতো। সে কি আহাজারি! আর আমাদের বলতেন, ” কখনো ঐ জমি নিতে যাবে না। ওখানে মানুষের রক্তের দাগ।”
তখন, শুনতাম খুনাখুনির গল্প। আর এখন তা হরহামেশায় শোনা যায়। রাস্তা ঘাটে, মানুষ খুন হয়ে পরে আছে। কেন ভ্রুক্ষেপও নেই। বাহিরে বের হলেই কতো গল্প শোনা যায়। খুব জমিয়ে গল্প করে, জানো ; কাল রাতে আমাদের বাসার পাশে মার্ডার হয়েছে। ঐ যে দেখো রক্তের ফোটা! দোকানে, হাটে, বাজারে একই গল্প। চা খাইতে খাইতে কেউ বলে, ” ও আচ্ছা!” মানে, মৃত্যু গা সওয়া হয়ে গেছে।
বিজ্ঞান বলে, মৃত্যুই হলেই সাথে সাথে মানুষের মস্তিষ্ক অচল হয় না। ১০ মিনিট সচল থাকে। তখন তার মাথার নিউরনে সুন্দর সুন্দর স্মৃতি ভেসে ওঠে।
কাল রাস্তায় মৃত মানুষ দেখে আমারও মনে হলো, তার স্মৃতিতে হয়তো খেলা করছে স্কুলবেলার স্মৃতি। পড়া পারেনি বলে, মাস্টার মশাই তাকে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো। তার রোল ১। মান সম্মানের প্রশ্ন! অথচ মাস্টার মশাই একবারও জিজ্ঞেস করলোনা কারণ কি? নানা বাড়িতে গিয়েই তো এই ঘটনা! চোখের জল, নাকের পানি সব একাকার করে পড়া মুখস্থ দিয়ে, তারপর বসেছিলো।
ঐ ছেলেটাই যখন হোস্টেলে থাকতো। একদিন খুব জ্বর তার। কোনরকমেই কমছে না। রুমমেটরা মাথায় পানি দিলো। জ্বরের ঘোরে, মা মা বলে ডেকেছিলো। পরদিন সকালেই মা হাজির। জ্বরের মাঝেই মায়ের গায়ের সুগন্ধ পাচ্ছে। মাকে দেখে জ্বরও জানালা দিয়ে পালালো।
আচ্ছা, স্মৃতি কি বর্তমান না ভবিষ্যৎ? না কি মনের ভেতর লুকানো আবছা ছবি?
ছেলেটি খুব ভালো গান গাইতো। স্কুলের প্রতিটা অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়েও তা ধরে রেখেছিলো। বিকেলে, টি এস সির আড্ডায় তার সুরেলা কণ্ঠ থামিয়ে দিয়েছিলো নীলপদ্ম নামের একটি মেয়েকে। আর আশেপাশে যারা থাকতো, তারাও সমস্বরে গাইতো। গান শেষ হলে, বাদাম, ঝালমুড়ি, চা চলতো।
বাড়ির কেউ নাম নিলে নাকি হেঁচকি ওঠে। ঐ ছেলেটিরও সেদিন তাই হয়েছিলো। পানি, পানি লাগবে। তার চিৎকারে শুনে, নীলপদ্ম পানির বোতল এগিয়ে দিয়েছিলো।
পরের দিনগুলো রঙিনই কেটেছিলো।
হঠাৎ সকালের পেপার পড়তে গিয়ে নীলপদ্মের চোখ আটকে যায় হেডলাইনে। যেখানে ছেলেটির নাম লিখা। এতো ভালো ছেলেরও শত্রু হয়! নীলপদ্ম স্তব্ধ হয়েছিলো। কথা না, শুধু কান্না ঝরছিলো নীরবে। আজ তাদের ১০০ গোলাপ হাতে দেখা হওয়ার কথা।
ছেলেটিকে সমাধিস্থ করা হলো বনানী কবরস্থানে।
হয়তো, এতক্ষণে ছেলেটি মৃত্যুর পর আবার যাদের বন্ধুরূপে খুঁজে পেলো; তারা ও তার বন্ধু ছিলো। গত সোমবার সিলেট যাওয়ার পথে ট্রেনের যে বগি দুটা উল্টে গিয়ে কিছু মায়ের বুক খালি করেছিলো। আর কিছু বুদ্ধিজীবি, যাঁরা করোনায় মারা গেছেন।
৩৪টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
গল্পের ছলে যা শোনালেন হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। মৃত্যু অবধারিত তবুও ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। একদিন চলে যাব , পিছনে পড়ে রবে সবকিছু। জানিনা তখন স্মৃতি বলে কিছু থাকবে কিনা! শুভ কামনা রইলো
আরজু মুক্তা
বিজ্ঞান বলে স্মৃতি কিছুক্ষণ কাজ করে।
ভালো থাকবেন
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আমিও জানি বিজ্ঞান বলে প্রতিটি অঙ্গ ই কিছু সময় সচল থাকে। সত্যি মিথ্যে মরার পর জানবো। আর জানলেই বা কি তখন তো সবার কাছে মৃত হয়ে যাবো, মুখে কোন শব্দ থাকবে না, কাউকে ধরতে পারবোনা।
খাদিজাতুল কুবরা
আপু নির্মম বাস্তবতায় চিত্রিত গল্পটি আপনার অসাধারণ লেখনীতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।
শুভেচ্ছা রইলো আপু
আরজু মুক্তা
শুভকামনা।
ভালো থাকবেন
ইঞ্জা
অকাল মৃত্যু কখনোই কাম্য নয়, গল্পের বর্ণনা হৃদয়গ্রাহী, মনটা ভারি হয়ে গেলো আপু। 🥺
আরজু মুক্তা
হুম। মন ভারি করা গলপ
ইঞ্জা
হুম 😌
ছাইরাছ হেলাল
আপনি আপনার লেখায়ে তো অন্য মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছেন!
বুঝলাম না, কোন পানিপরা পেলেন না কী!!
রোজ রোজ লিখুন।
আরজু মুক্তা
আপনার পানি পরাটা কুরিয়ারে পাইছি।
কেউ আবার শুনলেন নাকি?
চুপিচুপি বললাম।
ধন্যবাদ
ফয়জুল মহী
একরাশ মুগ্ধতা । একরাশ ভালো লাগার ভালোবাসা ।
আরজু মুক্তা
শুভকামনা ভাই
জিসান শা ইকরাম
মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথেই তার সমস্ত অংগ অচল হয়না। কিছু কিছু অঙ্গ চল্লিশ মিনিট পর্যন্ত সচল থাকে। আমি এ নিয়ে একটি লেখা লিখতে চেয়েছিলাম, মনে পরে গেলো তোমার গল্প পড়ে।
গল্প দিন দিন ভালো হচ্ছে। নিয়মিত লেখো।
শুভ কামনা।
আরজু মুক্তা
আপনার কমেন্ট পড়লেই লেখার আগ্রহ জাগে।
ধন্যবাদ, আপনাকে
প্রদীপ চক্রবর্তী
হৃদবিদারক গল্প।
অকালমৃত্যু কাম্য নয়!
আরজু মুক্তা
তা ঠিক। কিন্তু বিশৃঙ্খল সমাজ বোঝে না
শিরিন হক
একরাশ ভালোলাগা লেককের লেখনীতে।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ আপি
তৌহিদ
ভীন্নধারার একটি লেখা পড়লাম। লেখার প্রথম থেকে একনাগাড়েই পড়ে গেলাম। আপনার লেখার তারিফ না করে পারছিনা। জীবনের গল্পগুলি এরকমই নির্মম।
নিয়মিত আপনার লেখা চাই। ভালো থাকুন আপু।
আরজু মুক্তা
অবশ্যই অনুপ্রাণিত হলাম।
এই বিশৃঙ্খল সমাজে মানবিকতা ফিরে আসুক
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
খুব সুন্দর গল্প । বেশ ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ ।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ ভাই
সুপায়ন বড়ুয়া
এই ভয়ঙ্কর রূপটাকে কত সহজ ভাবে তুলে আনলেন।
ভাল লাগলো। শুভ কামনা।
আরজু মুক্তা
এটা লিখে অনেক খারাপ লেগেছিলো।
তবুও যদি সমাজটা ঠিক হতো।
ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার জন্য।
হালিম নজরুল
চমৎকার লিখেছেন। বর্ণনা পড়ে তো ভয়/ কষ্টে কাতর হচ্ছিলাম।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ, ভাই
মোহাম্মদ আলী
অসাধারণ লেখেছো
মুগ্ধতা রেখে গেলাম দিভাই।
ভালোবাসা নিয় 😍😍 সুস্থ থেকো
আরজু মুক্তা
মনে হচ্ছে, আপনি আমার ক্লাসমেট অথবা বন্ধু। খুব সুন্দর করে অনুমতি না নিয়ে তুমি বললেন। অপরিচিতকে আপনি বলতে হয় এই নূন্যতম ভদ্রতা শিখে কমেন্ট করতে আসিয়েন।
সাবিনা ইয়াসমিন
প্রতিদিনের ঘটনায়/ দুর্ঘটনায় ঘটে যাওয়া মৃত্যু গুলোকে নিয়ে এখন স্বাভাবিক গল্প করেই মানুষ সময় পার করে দেয়। যান্ত্রিকতা মানুষের ভেতর থেকে আবেগ-অনুভূতি সব কেড়ে নিচ্ছে। কিন্তু যার মৃত্যু হয়, সে সব জেনে-বুঝেও তার প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করতে পারে না। মৃত্যুর/ ভাগ্যের প্রতি নির্লিপ্ত কারীদের সাথে নিয়তি এভাবেই প্রতিশোধ নেয়।
যদিও লেখাটি মন ভারাক্রান্ত করেছে, তবুও আপনার উপস্থাপনা খুবই ভালো লাগলো।
নিয়মিত লিখুন,
শুভ কামনা 🌹🌹
আরজু মুক্তা
কমেন্ট পড়ে শান্তি লাগলো।
শুভকামনা
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
বাহ্! খুব সুন্দর একটি লেখা পড়লাম। গল্পের ছলে ক্রমান্বয়ে অনেক বাস্তবতা উঠে এসেছে।
অনেক ধন্যবাদ এতো সুন্দর একটি প্রকাশনার জন্য।
আরজু মুক্তা
আপনাকেও ধন্যবাদ সুন্দর কমেন্ট আর পড়ার জন্য।
আমি অনুপ্রাণিত।
সঞ্জয় মালাকার
অকাল মৃত্যু কখনোই কাম্য নয়,
পড়ে বেশ ভালো লাগলো দিদি, ভালো থাকবেন সবসময়।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ দাদা