হিতৈষি খুব রেগে আছে। রাগার যথেষ্ট কারণ আছে। হিতৈষির বান্ধবী প্রেমা কাল সন্ধ্যায় নিজ চোখে দেখেছে আবিড় বন্ধুদের সাথে সিগারেট ফুকছিল আর চা খাচ্ছিল। আবিড় গল্পে এমনই মশগুল ছিল যে প্রেমা পাশ দিয়ে হেঁটে গেছে তাও খেয়াল করেনি।
প্রেমা স্কুল জীবন থেকে হিতৈষির বান্ধবী। আলাদা বিভাগে পড়লেও তাদের বন্ধুত্ব এখনো অটুট আছে। বান্ধবীর প্রেম ভেঙ্গে দেবার মতো মেয়ে প্রেমা না, এটা হিতৈষি ভালই জানে। তাই প্রেমার মিথ্যা বলার প্রশ্ন ওঠে না।
তবুও হিতৈষি আবিড়কে সাথে সাথে ফোন দেয়- হ্যালো, তুমি কি করছো?
আবিড় বলল- আমি তো এখন বাসে উঠেছি।প্রিতমের কাছে জব্বার স্যারের লেকচারটা নিতে এসেছিলাম। এখন আবার বাসায় যাচ্ছি।
হিতৈষি কিছু বলেনি আর। প্রেমা ততোক্ষণে আবিড়ের সিগারেটের ধোঁয়াময় সুখের স্মৃতি চুপ করে তুলে হিতৈষিকে এম এম এস করে দিয়েছে। এরপর আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
পরদিন ক্যাম্পাসে থমথমে মুখ নিয়ে হিতৈষি আসে, রাতে আবিড়ের ফোন ধরেনি সে, কোনো ম্যাসেজের উত্তর অবধি দেয়নি। ক্লাসে ঢোকা মাত্রই আবিড় বুঝতে পেরেছে আজ তার জন্য মহা বিপদ সংকেত। বিকেল পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারল না আবিড় কি অপরাধ করেছে সে। এতো জেদি মেয়ে আগে কখনো দেখেনি আবিড়। এতো ভালবাসে তবুও একটু ভুল হয়ে গেলে দুনিয়াটাকে নরক বানিয়ে ফেলে হিতৈষি। এমন গম্ভীর হয়ে বসে থাকে মেয়েটা, এর চেয়ে সে কড়া গালিগালাজ বা কয়েকটা থাপ্পড় দিলেও মনে হয় এতো খারাপ লাগতো না।
বিকেলে ক্লাস শেষে আবিড় হিতৈষির পথ আটকে রাখলো। কি হয়েছে, না বললে যেতে দেবে না। অনেক জোরাজুরির পর হিতৈষি মোবাইল বের করে ছবিটা দেখাল। সব রহস্যের জট খুলে গেল আবিড়ের কাছে। এখন যে করেই হোক ক্ষমা আদায় করতেই হবে। একরকম জোর করেই ক্যাম্পাসের শেষপ্রান্তে যেখানে মানুষের হাটাচলা একটু কম, সেখানে ঘাসে বসাল হিতৈষিকে। হাত জোর করে ক্ষমা চাইল অনেক, কিন্তু হিতৈষির মন গলাতে পারছে না সে।
মাগরিবের আযান হয়ে গেল, হিতৈষি অস্থির হয়ে গেল বাসায় যাবার জন্য। কিন্তু আবিড় নাছোড়বান্দা, ক্ষমা না দিলে ছাড়বেই না। হিতৈষির গলার আওয়াজ বেড়ে গেল, আর কতোক্ষণ এই অত্যাচার সহ্য করা যায়। আবিড়েরও মাথা গরম হয়ে গেল। সামান্য একটা সিগারেট খেয়েছে, মাতাল হয়ে মাতলামি তো করেনি। তাও সেজন্য বার বার ক্ষমা চাচ্ছে সে, একগুয়ে মেয়েটা শুনতেই চায় না।
হিতৈষির ঐ এক কথা- লুকালো কেন যদি চোর না হয়? ফোনে কেন মিথ্যা বলল, কেন বললো না যে সে সিগারেট খাচ্ছিল। ঝগড়া চলছে তো চলছেই।
একটু একটু আঁধার হয়েছে চারপাশে। জায়গাটায় গাছপালা বেশি, ঝি ঝি পোকাগুলো একনাগাড়ে ডেকে চলেছে। ৫টা নেশাখোর ছেলে গল্প করতে করতে হিতৈষি-আবিড়দের অতিক্রম করে গেল। ঝগড়ার গন্ধ পেয়ে তারা আবার ফেরত এলো হিতৈষিদের কাছে।
একজন জিজ্ঞেস করল আবিড়কে- কি ব্যাপার ভাই, এইখানে মেয়ে মানুষ নিয়া বইসা আছেন, ঝগড়া করতাছেন। জায়গাটাকি আপনাদের ঝগড়ার জন্য বানাইছে নাকি, এটা কি ঝগড়া উদ্যান?
এমনিতেই রেগে আছে আবিড়, এবার রাগের মাথায় বলেই ফেলল- আমরা এখানে গল্প করব নাকি ঝগড়া করব, সেটা আমাদের ব্যাপার। আপনারা বলার কে? আপনাদের বাপের খাই নাকি? আর এটা কি আপনার বাপের সম্পত্তি? এখানে আমরাও পড়ি।
হিতৈষির খুব ভয় করছে। সব রাগ-অভিমান ভুলে সে আবিড়ের হাত চেপে ধরল, গলা নামিয়ে আবিড়কে চুপ করতে ও এখান থেকে ঊঠে যেতে বলল। কিন্তু আবিড় নাছোড়বান্দা। হিতৈষিকে ধমক দিয়ে বলে উঠলো- তুমি চুপ কর। এরা যা ইচ্ছা করবে আর তাই মেনে নিতে হবে নাকি?
ছেলেগুলোর সাথে তর্ক করার পরিণাম ভাল হলো না। আবিড়কে তারা মেরে ধরাশায়ী করে ফেলল, একা আবিড় ৫ জনের সাথে পারার কথা না। হিতৈষি অসহায়ের মতো সাহায্য চেয়ে চ্যাচাতে লাগলো, কিন্তু কেউ এলো না তার কান্না দেখে। মানুষ কম ছিল আর যারা ছিল তারা দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেল, যেন এমন প্রতিনিয়তই হয়, এসব গায়ে লাগাতে নেই।
জ্ঞানহীন আবিড়ের পাশে গলা ছেড়ে কাঁদতে থাকে হিতৈষি। শয়তানগুলোর পায়ে পড়ে বলে যেন আবিড়কে একটু হাসপাতালে নেবার ব্যবস্থা করে। আবিড়ের হয়ে সে ক্ষমা চাচ্ছে বার বার। কিন্তু পিশাচগুলোর মন গলে না উল্টা হিতৈষিকেই টেনে পুকুরপাড়ে একটা ঝোপের আড়ালে নিয়ে যায় পাঁচজন মিলে। হিতৈষির চিৎকার যেনো কেউ না শোনে সেজন্য মুখে তারই ওড়নার একাংশ ছিড়ে মুখে গুঁজে দেয় আর আরেক অংশ দিয়ে তার হাত বেঁধে ফেলে ওরা ৫ জন। ক্ষুধার্ত বাঘ যেমন তার চোখের সামনে হরিণ দেখলে ঝাপিয়ে পড়ে মাংস খুবলে খায়, তেমন করে পুরুষ নামক এই পশুগুলো খুবলে খেতে থাকে হিতৈষিকে। রক্তাক্ত-মুমূর্ষু-জ্ঞানহীন হিতৈষিকে ফেলে রেখে যায় তারা খাওয়া শেষে।
কয়েকঘন্টা পর জ্ঞান ফেরে হিতৈষির, তখনো সে হাত বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে ঝোপের ধারে। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ায় হিতৈষি, কান্না করার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলেছে। তার চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে, মনে হয় বোবাও হয়ে গেছে। তবুও কষ্ট করে হেটে হেটে আবিড়ের কাছে যায়, আবিড় পড়ে আছে সেখানেই। আবিড়কে ছুঁয়ে কিছুক্ষণ দেখলো সে। আবিড়ের ব্যাগ থেকে খাতা-কলম বের করে একটাই কথা লিখে ব্যাগে রেখে দিল-“আবিড়, তুমি কখনো নেশা করোনা।”
পরদিন সবাই দেখলো, হিতৈষি ভুল করে বিছানায় না ঘুমিয়ে পানিতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। গভীর সে ঘুম ভাঙ্গেনি পাখির ডাকে, মা-বাবার ডাকে এমনকি আবিড়ের ডাকেও।
২৮টি মন্তব্য
নিশিথের নিশাচর
এই ভাবে কিছু নরপিচাশদের জন্য আমাদের মাঝ থেকে অনেক হিতৈষি হারিয়ে যাই।
কিন্তু আমাদের সমাজ এই নরপশুদের রুখে দেবার সাহস কি এই সমাজের নেই ???
কেন সমাজ দেখে ও না দেখার ভান করে ধিক্কার জানায় এই সব নরপশু ও এই অন্ধ সমাজ কে।
ফাহিমা কানিজ লাভা
আমাদের সমাজের মানুষগুলো শুধু নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। দিন দিন মানুষের বিবেকবোধ, মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সমাজটাকে বদলানো খুব জরুরি। ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
ছাইরাছ হেলাল
এমন অঘটন ঘটনে বাক্ রুদ্ধ স্তব্ধতা ছাড়া আর কী ই বা বলার থাকে ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
🙁
জিসান শা ইকরাম
প্রথম দিকে বেশ মজা লাগছিল পড়তে । অভিমান , খুনসুটি দারুন লাগছিল ।
শেষ দিকে এসে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম ।
নেশা থেকে মুক্ত থাকা উচিত সবার ।
ভাল লেগেছে খুব ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
নেশা ও বাজে সঙ্গ খুব খারাপ জিনিস। ধন্যবাদ ভাইয়া।
সিহাব
আপনি খুব ভাল লিখেন। আশা করি আরো অনেক লেখা পাব। (y)
ফাহিমা কানিজ লাভা
ধন্যবাদ সিহাব। আশা রাখি আপনার আশা পূরণ করব। 🙂
খসড়া
শেষের চমকটা অপ্রত্যাশিত। ভাল লাগা রেখে গেলাম।
ফাহিমা কানিজ লাভা
ধন্যবাদ। শুভ কামনা আপনাকে।
আদিব আদ্নান
পিশাচরা সব সময়ই দুষ্টগ্রহ হয়ে আমাদের কাঁদায় ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
আমরা চাই না সমাজে কোন পিশাচ থাকুক।
বনলতা সেন
এমন লেখা যেমন আমাদের কাঁদায় তেমনি সমাজের ক্ষতগুলোও উন্মোচিত হয় ।
আপনার লেখা পড়তে ভাল লাগে ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
ধন্যবাদ আপু। সমাজের ক্ষতগুলো না থাকলেই সবার মঙ্গল।
ব্লগার সজীব
আমার ক্ষমতা থাকলে আমি ধর্ষকদের স্পট শাস্তি দিতাম । সমাজ সচেতনতায় ভুমিকা রাখবে আপনার এই লেখা । (y) (y)
ফাহিমা কানিজ লাভা
ধন্যবাদ ব্লগার রাজীব ভাই। সবাই আপনার মতো না, আমাদের সমাজে ধর্ষকরা বুক ফুলিয়ে হাঁটে আর ধর্ষিতাকে কোণঠাসা করে রাখে। সবার শুভ বুদ্ধির উদয় হোক, এই কামনা করি।
তওসীফ সাদাত
অপ্রত্যাশিত ভাবে শেষ হল গল্পটা। বেশ মেজাজ খারাপ হল আবির এর উপর, তারপর.. নেশাখোর গুলোর প্রতি তিব্র ঘৃণা… তার চেয়েও বেশি ঘৃণা এবং মেজাজ খারাপ হল সমাজের যে মানুষ গুলো দেখেও না দেখার ভান করে অন্যায় কে প্রশ্রয় দেয় তাদের উপর।
ফাহিমা কানিজ লাভা
দেখেও না দেখার ভান করে, এই মানুষ গুলোই সমাজে বেশি
এম মশিউর
গল্পটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লাম।
শেষে দৃশ্যে এসে মর্মাহত হলাম। এই সব নরপশু গুলো তাদের পশুত্ব দূর করার জন্য একটি মেয়ের প্রাণ কেড়ে নিল?
সত্যিই সেলুকাস আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থা। হিতৈষির মত হয়তো অনেকেই এমন শিকার হয়। তারা অগোচরেই থেকে যায় তাদের প্রাণ দিয়ে।
ফাহিমা কানিজ লাভা
সত্যিই সেলুকাস!!
প্রিন্স মাহমুদ
ভাল লেগেছে ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
ধন্যবাদ।
আফ্রি আয়েশা
এমন মন খারাপ করা গল্প 🙁
ফাহিমা কানিজ লাভা
🙁 🙁
সীমান্ত উন্মাদ
লিখার ধরনটা চমৎকার।
আপনার জন্য শুভকামনা নিরন্তর।
ফাহিমা কানিজ লাভা
ধন্যবাদ। 🙂
বোকা মানুষ
শেষটা করুণ। আকস্মিক ধাক্কা খায় মন।
ফাহিমা কানিজ লাভা
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।