যখন আমি একটু বড়ো হলাম, আমাকে কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে সরিয়ে ভর্তি করানো হলো গার্লস স্কুলের চতুর্থ শেনীতে। সকাল সাতটায় ক্লাস, পনেরো মিনিট আগে পিটি করতে হতো। তাই স্কুলে রওনা দিতে হতো সকাল সাড়ে ছ’টায়। স্কুল একটু দূরেই ছিলো, বেশির ভাগ সময় আব্বার হাত ধরে যেতাম। কিন্তু বড়োস্কুলে ভর্তি হবার পর বান্ধবীদের সাথে যেতে বেশি ভালো লাগতো। ওদেরকে একা-একা যেতে আসতে দেখে আমিও ওদের মতো সাহসী হতে চাচ্ছিলাম। আব্বা আমার এত প্রত্যয় দেখে একা স্কুলে যেতে অনুমতি দিলেন। আমিতো মহাখুশি।

পরপর কয়েকদিন বাসা থেকে একাই বের হলাম।
আমাকে কেউ কিছু বললো না। যাওয়ার সময় পথে স্কুলগামী আরও কয়েকজনকে সাথে পেলাম। একই স্কুলে তারাও পড়ে। তাদের সাথে যেতে-আসতে অনেক নতুন নতুন রাস্তা চিনলাম। সেই সময়ে একেকটা বাড়ির সাথে অন্যান্য বাড়ির সংযোগ পথ ছিলো। বাড়িগুলো টপকে-টাপকে দ্রুত মেইন রাস্তায় যাওয়া যেতো। আমার ভালোই লাগছিলো শর্টকাট যাওয়া-আসা করতে।

একদিন এভাবেই যাচ্ছিলাম, একা। শীতকাল, কুয়াশার কারণে সময় বুঝতে পারিনি, আর ঘড়ির দিকেও খেয়াল করিনি। অর্ধেক পথ পার হওয়ার পর বুঝলাম সেদিন অনেক আগেই বের হয়েছি। যাইহোক, ভাবলাম যাওয়ার সময় কাউকে না কাউকে পেয়েই যাবো। চার-পাঁচ টা বাড়ি পার হওয়ার পর দেখি, একটা বড়ো মেয়ে একটু দূরের বাড়ির পিছনে একটা পেয়ারা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে। আবার গাছের ডাল ধরে একটু একটু দোল খাচ্ছিলো।

আমার কাছে ব্যাপারটা দারুণ মনে হলো। ভাবলাম স্কুলের এখনো অনেক দেরী, যাই আমিও একটু তার সাথে গাছে ঝুলে দোল খেয়ে আসি। স্কুল ব্যাগটা কাধ থেকে নামিয়ে একদৌড়ে গেলাম গাছের নীচে। গিয়ে দেখি, মেয়েটার গলায় একটা লাল গামছা প্যাচিয়ে আছে, তার চোখগুলো অনেক বড়ো আর জিহ্বা মুখ থেকে বাইরে!! তার পা গুলো মাটি উপরে, পা দুটি কালচে নীল হয়ে ছিলো। আমি কি করেছিলাম ঠিকঠাক মনে নেই, কিন্তু পরে শুনেছি আমার চিৎকার শুনে ঐ বাড়ির মানুষের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আর আমার আব্বা আমায় বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। প্রচন্ড ভয় পেয়ে অসুস্থ ছিলাম কিছুদিন।

আব্বা আমার কাছ থেকে একটু দূরেই ছিলেন। আমি তাকে দেখিনি। আসলে তিনি আমায় একা স্কুলে যাওয়ার পারমিশন দিয়েছিলেন আমার মন রাখার জন্য। কিন্তু প্রতিদিনই তিনি আমার পেছনে-পেছনেই যেতেন। সেসবের কিছুই আমি জানতাম না। তারপর থেকে আমি ভালোমতো জ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত একা স্কুলে বা অন্যকোথাও যাওয়ার পারমিশন পাইনি।

ছোটবেলায় দেখা ঐ মেয়েটি আত্মহত্যা করেছিলো প্রেমে ব্যার্থ হওয়ার কারনে। তার পরিবারের মানুষদের থেকে সে মানসিক কোনো সাপোর্ট পায়নি, যার কারণে আত্মহত্যা করে নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলো। এখানে নাকি মেয়েটারই দোষ ছিলো।

বেশ কিছুদিন আগে আমাদের এলাকায় অল্পবয়সী একজন ছেলে আত্মহত্যা করেছিলো। কারণ জানতে গিয়ে শুনলাম পারিবারিক কারণে এই আত্মহত্যা। ছেলেটা নতুন বিয়ে করেছিলো, প্রেমের বিয়ে। কিন্তু তার পরিবার মেয়েটিকে মেনে নেয়নি, মেয়েও ছেলেটার ফ্যামিলির সাথে এ্যাডজাস্ট হতে পারেনি।
প্রতিদিনের ঝগড়াঝাটি, মানসিক চাপ ছেলেটা আর নিতে পারছিল না। নিজ জীবনের মায়া ত্যাগ করতে বাধ্য হলো। সবাই দোষ দিলো বউটার।

কেউ আত্মহত্যা করেছে শুনলেই আমাদের মন ব্যাথিত হয়ে যায়। চেনা-অজানা যেই হোক, আত্মহত্যাকারীর জন্যে করুণা আসে আমাদের মনে। তার কষ্ট গুলো যেনো না বলতেই উপলব্ধিতে চলে আসে। কারণ কেউ খুশি মনে নিজেকে হত্যা করে না। কতটা অভিমান, নিঃসঙ্গতা, হীনমন্যতা, বেদনাক্রান্ত হয়ে মানুষটি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলো সেটাই ভাবনায় ঘুরপাক খেতে থাকে। কিন্তু আত্মহত্যা কি আসলেই কোনো সমাধান হতে পারে?

ব্যাক্তিগত ভাবে আত্মহত্যাকারীকে আমার প্রচন্ড রকম স্বার্থপর মনেহয়। মনেহয় এরা শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে আর নিজের কথাই চিন্তা করে বাঁচে।
একটা মানুষের জীবন কি শুধু তার একার? তাকে ঘিরে থাকা মানুষগুলো থেকে সে দুঃখ/ কষ্ট পেতেই পারে, তাই বলে ঐ ব্যাক্তি সঠিক সমাধানের পথে না গিয়ে আত্মহত্যা করবে কেন?
ক্ষুধায়, রোগে, দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করে যে মানুষ গুলো বেঁচে থাকে, তাদেরকে দেখে কেন কিছু শিখতে পারে না?

এরা কেন শুধু নিজের দুঃখেই জর্জরিত হয়!
বেঁচে থাকার উদ্যেশ্য তো শুধুই নিজের জন্যে বাঁচা নয়! যদি আত্মহত্যা করতেই হয় তবে মানুষের কল্যাণে আত্মত্যাগ করা ভালো। নিজের মতো করে হয়তো বাঁচা যাবে না, কিন্তু বাঁচিয়ে রাখা যাবে মানবতাকে।

১৫০৮জন ১১৯৪জন

২৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ