একসময় নারায়ণগঞ্জকে প্রাচ্যের ড্যান্ডি বলা হতো। কেনো বলা হতো জানি কি? স্কটল্যান্ডের ড্যান্ডির নামানুসারে এই নামকরণের কারণ, বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাটকল আদমজী পাটকলের অবস্থান ছিল নারায়ণগঞ্জে। অর্থাৎ শুধুমাত্র পাটের জন্যই নারায়ণগঞ্জ ’প্রাচ্যের ড্যান্ডি’ হিসেবে পরিচিতি পায়। আর পাটকে বলা হতো ‘সোনালী আঁশ। এই পাট বিক্রি করে তৎকালীন বাংলাদেশে সে সময় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হতো। পরবর্তীতে স্বাধীন দেশে শুধুমাত্র পরিকল্পনার অভাবজনিত মনযোগহীনতার কারনে পাটের দুর্দিন শুরু হয়। পাটের জায়গায় প্লাস্টিক আর পলি জায়গা করে নিলে কালের আবর্তে হারিয়ে যায় সেই সুনাম আর এই খাতটি ধীরেধীরে লোকসানি খাতে পরিণত হতে থাকলে, এই উছিলায় একটা সময় তা বন্ধ করে দেয়া হয়। অথচ চাইলেই সেটাকে ধরে রাখা যেতো।
১৯৫১ সালে শুরু হওয়া আদমজী পাটকলের উৎপাদন থেকে প্রতি বছর সেসময় প্রায় ৬০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো(উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে)। আদমজী জুট মিল থেকে উৎপাদিত পণ্য চীন, ভারত, কানাডা, আমেরিকা, থাইল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। আদমজী জুট মিল ছিলো তখন পৃথিবীর অন্যতম জুট মিল এবং এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ কারখানা।
তবে বোধহয় সেই সুদিন আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। দেশ ও জাতির প্রতি কমিটেড সরকারপ্রধান সেইদিকেই এগুচ্ছেন।
বিশ্বায়নের এই যুগে ”সোনালি আঁশের সোনার দেশ, পাটপণ্যের বাংলাদেশ” এই প্রতিপাদ্য নিয়ে দেশে গত দুদিন আগে প্রথমবারের মতো পালিত হলো জাতীয় পাট দিবস।
বলা যায় বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের হাত ধরেই পাট আবার “Golden Fibre of Bangladesh” নামের হারানো সোনালি ঐহিত্য ফিরে পেতে যাচ্ছে। যদিও মাকসুদুল আলম এখন আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। ২০১৪ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।
নভেম্বর ২০০৯, ‘প্রথম আলো’তে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন- #পেঁপের_পর_রাবারের_জিন_নকশা_উন্মোচন_করলেন_বিজ্ঞানী_মাকসুদুল_আলম_উন্মোচিত_হোক_আমাদের_পাটের_জিন_নকশা” তাতে চোখ পড়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় মাকসুদুল আলমকে তিনি দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে দায়িত্ব দেন পাটের জীবন-নকশা উন্মোচনের।
বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তা পেয়ে বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম একদল তরুণ বিজ্ঞানী নিয়ে তোষা পাটের জিন নক্সা উন্মোচন করতে নেমে পড়েন।
৪২ জনের একদল চৌকশ তরুণ বিজ্ঞানী, যাদের মূল নেতৃত্বে ছিলেন মাকসুদুল আলম, রাতদিন পরিশ্রম করে তিন বছর মেয়াদের প্রস্তাবিত সে গবেষণার ফল প্রায় এক বছরের মাথায়ই বের করে নিয়ে আসেন। ২০১০ সালে বাংলাদেশের হয়ে তোষা পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করে দেশে-বিদেশে সাড়া ফেলে দেন।
২০১২ সালে উন্মচিত হয় পাটের জন্য ক্ষতিকর একধরণের ছত্রাকের জিননকশা। আর পরেরবছর, ২০১৩ সালে উন্মোচিত হয় সাদা পাটের জিননকশা।
মাকসুদুল আলমের জন্য মাসে ১৬ লাখ টাকা পারিশ্রমিক ধরা হয়েছিল। তিন বছরে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় পৌনে ছয় কোটির টাকা। কিন্তু দেশের কাজে সে পারিশ্রমিক তিনি গ্রহণ করেননি।
যাহোক, ২০১৩ সালের ১৮ আগস্ট পাটের জীবন রহস্য উন্মোচনের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ। বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমকে পাশে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওই ঘোষণা বিশ্বের চেখে এক বিস্ময়। একই সময়ে পাটের জীবন রহস্য নিয়ে কাজ করছিল পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও। তাদের টেক্কা দিয়ে মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা এ সাফল্য অর্জন করেছিলেন (যদিও বদনাম আছে, হাসিনা সরকার ভারতস্বার্থকে বিবেচনায় রেখেই কাজ করেন)।
২০১৩ সালে পাটের জীবন রহস্য উন্মোচিত হলেও বাংলাদেশ পাটের তিনটি জিনম কোড বরাদ্দ পায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। এর মাধ্যমে অর্জিত হয় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
যেকোন জীবের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল কার্যক্রমই নিয়ন্ত্রিত হয় তার জিনোম বা কিছু ক্রোমোজোম বা অনেক অনেক অনেক জিনের দ্বারা। জিনগুলি তৈরি DNA দ্বারা। তাই কোনো জীবের এই জিনোম এর পারস্পরিক বিন্যাসটা আবিষ্কার করা মানেই সেই জীবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলির অবস্থান ও ফাংশন সম্বন্ধে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া।
পাটের জীবন রহস্য উন্মোচনের ফলে জিনতত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে পাটের হারানো সোনালি ঐহিত্য ফিরিয়ে আনা-ই নয়, বাংলাদেশ ছিনিয়ে আনতে চায় বিশ্বমানের আরও একটি সুনাম। সরকারের লক্ষ্য রয়েছে পাটকে ক্রিকেটের সমপর্যায়ে নিয়ে বিশ্বজয়ের পর্যায়ে পৌঁছা।
পাটকে শীঘ্রই এক ফসলি থেকে তিন ফসলিতে রূপান্তরের কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। অতিশীঘ্রই দেশে শীতকালীন, গ্রীষ্মকালীন ও বর্ষাকালীন পাটের আবাদ শুরু হবে। এমনকি জীবনচক্র আবিষ্কারের ফলে পাটগাছ বৈরী পরিবেশেও টিকে থাকতে পারবে ।
বর্তমানে ১৭টি পণ্যে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক। এই বাধ্যবাধকতার কারণে বছরে ১২০ কোটি পিস পাটের বস্তার প্রয়োজন পড়বে।
প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ তৈরি করতে যাচ্ছে পলিথিনের ন্যায় পাটের তৈরি শপিংব্যাগ। পাট দিয়ে তৈরি এ পলিথিন পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
দেশ জাতির প্রতি কমিটেড নেতৃত্ব একটা জাতিকে অনেকদূর নিতে পারে সেটা আমরা গত কয়েক বছরে খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছি, যদিও প্রশাসনের রন্দ্রেরন্দ্রে লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতা বিরোধীরা একের পর এক কালো ছায়া ফেলে সবকিছু নস্যাৎ করে দেবার ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে।
তারপরও সত্য এই যে, চালকের আসনে বসা মানুষটি যদি হয় কমিটেড তো, এবড়োখেবড়ো, খানাখন্দ পেড়িয়ে অবশেষে গাড়ী সঠিক পথেই ফিরবে।
জয় বাংলা…..
৯টি মন্তব্য
মেহেরী তাজ
জুওলজি আমার সাবজেক্ট হলেও সেটা আমার মোটেই পছন্দ নয়। শুধু মাত্র জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং টা আমার কাছে খুব মজার লাগে। কাজের মধ্যে একটা সুন্দর ধারাবাহিতা আছে। সেই ভালো লাগা থেকেই সম্ভবত আপনার পোষ্ট টা এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম।
আপনার এই পোষ্ট পড়তে পড়তে আমি মোট তিনবার ওয়াও বলছি। মাকসুদুল আলম সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না আপু। জেনে ভালো লাগলো।
আর চালকের আসনে থাকা মানুষটাকে আমি বিশ্বাস করি মন প্রাণে ………
মারজানা ফেরদৌস রুবা
যাক, বিখ্যাত একজন মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারলাম। ভালো লাগছে।
হ্যাঁ, আমিও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি আর দোয়া করি আমাদের (জাতির) জন্য তিনি বেঁচে থাকুন।
নীলাঞ্জনা নীলা
বাহ! আবার ফিরে আসছে পাট? একসময় মনে পড়ে সিলেট থেকে ময়মনসিংহ যেতাম ট্রেনে চড়ে। কখনো বাপির কোলে, তো কখনো সিটে বসে। রেললাইনের দু’পাশে লম্বা লম্বা গাছগুলো পাটগাছ শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ভুলে গেছি কোন সিজনে জানি গিয়েছিলাম, কেমন একটা পঁচা গন্ধ আর পাটগাছগুলোও নেই। মামনির কাছে শুনেছিলাম কিভাবে জলে ভিঁজিয়ে রেখে, শুকিয়ে পাটের দড়ি বানানো হয়ে থাকে। সেই পাট আবার ফিরে আসছে, আর আমার একেবারে ছোট্ট শৈশববেলাটা চোখে ভাসছে।
বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলেন!
রুবা’পু ভালো থেকো।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
শুধু ফিরে আসছেই না গো। বিশ্বব্যাপী জয়জয়কার নিয়ে দাঁড়াবে। পাটের জীবনরহস্য একমাত্র আমাদেরই জানা হয়ে গেছে।
নীলাঞ্জনা নীলা
অপেক্ষায় আছি রুবা’পু।
ব্লগার সজীব
খুব ভাল এবং আশা জাগানিয়া একটি লেখা দিলেন আপু। ধন্যবাদ আপনাকে। পাট ফিরে পাক তার ঐতিহ্য।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
স্বাপ্নিক মানুষটা কেবল স্বপ্ন দেখাচ্ছেনই না, স্বপ্নের বাস্তবায়নও করে চলেছেন।
নীহারিকা জান্নাত
অনেককিছু জানলাম। বিশেষ বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের মত এত বড় মাপের বিজ্ঞানী এবং তার আবিষ্কার জেনে বিস্মিত হলাম।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ আপু।