কিছু কথা কখনো বলা হয়ে উঠে না। যেমন___ জ্যাকসন হাইটস এর বাঙালী রেস্টুরেন্টে যখন খাই, আড্ডা দেই, তখন সেখানে কর্মরত বাংলাদেশী আপু’রা এগিয়ে আসে। কি লাগবে জানতে চায়। কখনোই বলা হয়ে উঠে না, “আপনি খেয়েছেন ?”। তবুও সুযোগ পেলে কাছে এসে আপনজনের মতই সুখদুঃখের গল্প করে। বৈধ কাগজপত্র হীন রুমা আপা তাঁদের একজন।
এক সকালে ছেলেকে স্কুলে দিয়ে ফেরার পথে দেখি রুমা আপা ছুটছেন। খুব তাড়া তাঁর। রেস্টুরেন্টের বাইরে এই প্রথম দেখি তাঁকে। চেঁচিয়ে বলি, ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন ? জানালেন, এক প্রতিবন্ধী শিশুকে দেখাশোনা করেন সপ্তাহের তিনদিন। বাকি চারদিন রেস্টুরেন্টে জব করেন। সাতদিনই ব্যস্ত। কষ্টার্জিত অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন। স্বামী বাড়ির কাজে হাত দিয়েছেন। চারতলার ছাদ ঢালাই দিয়েছে। বাড়িটি কমপ্লিট হলেই দেশে ফিরে যাবেন। স্বামী, সন্তানদের নিয়ে বাকি জীবন ভাল থাকবেন। ভাল লাগে শুনে। কতো গুছানো সুন্দর পরিকল্পনা।
গাড়িতে গান শুনতে শুনতে বাসায় ফিরছি। চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো___ দেশে ফিরে যাওয়া সংগ্রামী এক নারী, যিনি পরিবারের অনেকগুলো মানুষের সুখের জন্যে অনেকগুলো বছর হারিয়েছেন জীবন থেকে। আমি নিশ্চিত, নিজ পরিবারে, নতুন গৃহে তাঁর প্রত্যাবর্তন দৃশ্য হবে ___ পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দরতম দৃশ্য। সবচাইতে সুখকর গল্প। যে গল্প একজীবনে একবারই হয়…
বেশ ক’মাস বাদে আজ দুপুরে বাজার করতে গিয়ে ক্ষুদার্থ আমি পাশের রেস্টুরেন্টে যাই। খাবার অর্ডার দিয়ে কর্নারের টেবিলে গিয়ে বসি। রুমা আপা খাবার নিয়ে আসেন। জিজ্ঞেস করি, দেশে যাচ্ছেন কবে ? তিনি ছলছল চোখে বললেন, ” দেশে গিয়া কি হইবো… হেয় তো বিয়া করসে আবার… নতুন বউ লইয়া সংসার করতাসে…” দু’ফোটা জল গড়িয়ে পরার আগেই দু’হাতের তালু দিয়ে মুছে নেয়, পাছে কেউ দেখে ফেলে ! ততক্ষনে পাশের টেবিল থেকে কেউ একজন ডেকে উঠে টিস্যু লাগবে বলে। তিনি সেদিকে ব্যস্ত হয়ে উঠেন…
আমি সেদিকে তাকাই। একজন নারী ভেতরে কষ্ট পুষে কেমন করে একের পর এক টেবিলে ছুটে চলছেন। কারো কিছু লাগবে কিনা, হাসি মুখে জানতে চাইছেন। রুমা আপার সুখের আকাশে বিষাদের আঁধার ! জীবন জীবিকার তাগিদে প্রবলভাবে সংগ্রামী এক নারীর প্রতি নীরব প্রার্থনা জানাই। দৃষ্টি ফেরাই। জুড়িয়ে যাওয়া চা’য়ে চুমুক দিতে দিতে তাকাই টেবিলে পরে থাকা অসহায় একখণ্ড টিস্যু পেপারের দিকে। অতঃপর সেটি সযতনে কাছে টেনে নেই। সেখানে লিখি___ “সুখের আকাশে বিষাদ রাত “…
২৪টি মন্তব্য
আবু খায়ের আনিছ
এই ধরণের ঘটনাগুলো হামেশাই ঘটছে আমাদের দেশে। বিশ্বাস এর অভাব, আবার সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে,প্রতারণা করে যাচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষ। কোন বিচার হচ্ছে না, কোন কিছুই হচ্ছে না এদের। কষ্ট হয় যখন প্রবাসী এই মানুষগুলো দেশে হাসি মুখে ফিরার বদলি এক রাশ কান্না নিয়ে ফিরে।
রিমি রুম্মান
মানুষের জীবনে কত রকম ঘটনা ঘটে… তবুও মানুষ বেঁচে থাকার লড়াই করে যায়। কষ্ট লুকিয়ে হাসি মুখে যাপন করে অন্য এক জীবন। আমরা অনেকেই ভাল আছি। ঢের ভাল আছি। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
ভালোবেসেই মরে মেয়েগুলো। বিশ্বাস করে তার জীবনের সবকিছু দিয়ে দেয়। কষ্ট করে উপার্জন করা অর্থর বিনিময়ে পায় প্রতারণা। জাপানে থাকার সময় এমন একজন মেয়ের সাথে আমারও পরিচয় হয়েছিলো। নেপালি মেয়ে, অর্থের বিনিময়ে পেয়েছিলো প্রতারণা। সে টাকা জমিয়ে স্বামীকে নিয়ে আসে, আসার পর যা হয়। পুরুষকে বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হয়। আমি নারীবাদী নই, কিন্তু চারদিকের সবকিছু দেখে-শুনে ভরসা করতে ভয় হয়।
রিমি আপু আপনি জীবনের কথা নিয়ে যেভাবে লেখেন, অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু আমার থেকে আপনার যন্ত্রণা যে আরোও গভীর, সে বুঝি। তবুও লিখুন, শুনি-জানি আর অন্ততঃপক্ষে মেয়েরা বুঝুক। বিশ্বাস করুক তাদের আপনজনদের, কিন্তু নিজের হাতে নাটাইটা রেখে। -{@
রিমি রুম্মান
এমন ঘটনা মেয়েদের বেলায় যেমন ঘটছে, ছেলেদের বেলায়ও ঘটছে প্রতিনিয়ত। দীর্ঘশ্বাসগুলো আমরা দেখি না। কিছু কান্না একাকী, কেবলই একান্তই একজনের কান্না। আমরা কেবল বাইরের মানুষটিকে দেখি। ভেতরের অন্য মানুষটিকে দেখা যায় না সহজেই।
এসব নিয়ে লিখতে গিয়ে আসলে আমি নিজেই আবেগাপ্লুত হয়ে পরি। ভাল থাকুন। সৃষ্টিকর্তা সবাইকে ভাল রাখুন।
জিসান শা ইকরাম
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো
এমন একটি ঘটনা আমিও জানি,ভেবেছিলাম কোনদিন হয়ত লিখবো এই কাহিনী।
ভালো থাকুক আমাদের বোনেরা,মায়েরা।
রিমি রুম্মান
এমনটি ছেলে কিংবা মেয়ে উভয়ের বেলাতেই ঘটছে। আমরা দেখি কেবল বাইরের মানুষটিকে। প্রতিটি মানুষের ভেতরে আরেকজন মানুষের বসবাস। আমরা কেউ কেউ সেইসব মানুষগুলোকে দেখি। ভাল থাকুক সকলে।
আজিম
সাধারণভাবে ও সার্বিকভাবে নারীর চেয়ে পুরুষের চরিত্র বেশি খারাপ, বেশি কলুষিত।
রিমি রুম্মান
নারী কিংবা পুরুষ দুজনের বেলায়ই ভাল মন্দ আছে। সকলেই সুখি হোক নিজ নিজ ভুবনে।
অরুনি মায়া
নারী জাতির পরিচয় যতদিন না পর্যন্ত মেয়ে মানুষ থেকে শুধু মানুষে পরিণত না হয় ততদিন পর্যন্ত এই ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে,,,,,,
আবু খায়ের আনিছ
মায়া আপু খুব সুন্দর একটা কথা বলেছেন। অতি সাম্প্রতিক সময়ের একটা কথা মনে পড়ল। আমি ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলাম বেড়ানোর জন্য। ছোট বোন আর তার বান্ধবীরা আড্ডা দিচ্ছিল। আমাকে সেখানে জোর করেই ডেকে নেওয়া হল। কথা প্রসঙ্গে এই মানুষ নিয়ে কথা উঠে। সেখানে উপস্থিত সবগুলো মেয়েই ভার্সিটিতে পড়ুয়া, কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্রী সবাই। সেখানে তারা কথা বলার সময় মানুষকে দুইটা ক্যাটাগরিতে ভাগ করে। স্বাভাবিক ভাবেই একটা ছেলে অন্যটা মেয়ে। আমি বারবার তাদের বুঝানোর চেষ্টা করলাম আমাদের সবার পরিচয় আগে আমরা মানুষ তারপর ছেলে মেয়ে। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন ছিল নাম মুন্নী, পলিটিক্যাল সাইন্স এর ছাত্রী তার বক্তব্যটা হল এমন, ছেলেদের কথা বাদদিলাম, আমি একটা মেয়ে হয়ে যদি বাইরে কোন ব্যাবসা করতে যাই,বা ছেলেদের মত করে আড্ডা দেই বা কোন চাকুরি করি তাহলে কেউ কি বলবে একটা মানুষ চাকুরি করছে? বলবে না, বলবে একটা মেয়ে চাকুরি করছে? আর এই বলাটা শুরু করবে অন্য একজন মেয়েই প্রথমে। আপনি জানেন, আপনি যে সমাজের কথা বলে, মানুষের কথা বলেন,দেশের কথা বলেন এরাই আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় কে ছেলে আর কে মেয়ে। মানুষ নয় আমরা মেয়ে মানুষ।
প্রাসঙ্গিক আরো অনেক কথাই ছিল,কিন্তু সেইদিন তার সামনে থেকে আমাকে মাথা নিচু করেই ফিরতে হয়েছিল। আমি সেদিন ব্যার্থ হয়েছিলাম এটা বুঝাতে যে আমাদের সবার পরিচয় আগে মানুষ তারপর অন্যকিছু।
আমার ব্যাক্তিগত কথার এই অংশটা প্রকাশ করতাম না কিন্তু করেছি একটা কারণে। ইদানিং পত্রিকার পাতা, টেলিভিশন এর খবর দেখলেই একটা হতাশার খবর সব সময় পড়তে হয়। ধর্ষণ। প্রতিদিন দেশে কি পরিমাণ ধর্ষণ হচ্ছে তা সবাই জানে। আমি আর কিছু বলতে চাই না, শুধু বলব একটা মানুষের পরিচয় হোক সে মানুষ। সে ছেলে না মেয়ে এই পরিচয়টা পরে আগে সে মানুষ।
সীমান্ত উন্মাদ
পরবাসের এমন আরো হাজারো গল্প চাই আপু। অনেক অনুপ্রেরনা পাই। জীবন যুদ্ধের গল্পগুলোই আসলে বাস্তব জীবনে খেলায় জিততে সাহায্য করে বেশি।
অনেক অনেক শুভকামনা আপনার জন্য।
রিমি রুম্মান
এমন গল্প লিখছি, লিখবো। ভেতরের তাড়না থেকেই। জীবনের গল্পগুলো অনেককিছু শিখিয়ে দিয়ে যায় বলে। ভাল থাকবেন। শুভকামনা।
ব্লগার সজীব
এমন অবস্থা কল্পনাও করতে পারিনা।যে নারী সব কিছু ত্যাগ করে সবার সুখের কথা ভেবে একাকী এত কষ্ট করছেন,তারই উপার্জিত টাকায় তার স্বামী আর একটি বিয়ে করলেন।ধীক ও পুরুষকে।
রিমি রুম্মান
শুধু পুরুষকেই নয়, এমন ঘটনা নারী, পুরুষ উভয়ের বেলাতেই ঘটছে। যেমন, আমার খুব কাছের একজনকে জানি, যিনি তাঁর প্রবাসী স্বামীর পাঠানো কষ্টার্জিত সকল অর্থ নিয়ে ভেগেছেন অন্যের হাত ধরে। এদের ধিক্কার জানাই।
ছাইরাছ হেলাল
আমরা আসলে একটি ভয়াবহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
আপনার লেখায় যে চিত্র তা একদম ভিতরের যা বাইরে থেকে দেখা যায় না।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। ভেতরের গল্পগুলো কখনো কখনো আমরা জেনে যাই। কিছু করার থাকে না যদিও, তবুও কেউ তো বলে হাল্কা বোধ করেন।
মেহেরী তাজ
জাতি হিসেবে আমরা মহান। কিন্তু আলদা আলাদা মানুষ হিসেবে আমরা এতো খারাপ কেনো?? শুধু কি আমরাইই এমন নাকি এটা সব জায়গার পরিচিত চিত্র??!
সংগ্রামী সেই আপুর জন্য ভালোবাস আর শুভকামনা নতুন ভাবে বাঁচার জন্য।
রিমি রুম্মান
এটি সব জায়গার চিত্র। একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। এমন ঘটনা গুলো আমাদের আরও সচেতন হতে শেখায়।
মরুভূমির জলদস্যু
আপনার লেখাগুলি মনে হয় সব সময় ভিন্ন কোন জগত নিয়ে লেখা, যে জগতের সাথে আমি পরিচিত নই।
রিমি রুম্মান
আপনি ভাগ্যবান। মানুষের দুঃখগুলো কষ্টগুলো আপনাকে কখনো ছুঁয়ে না যাক্। ভাল থাকুন আপনজনদের মাঝে ভালোবাসায়। শুভকামনা।
শুন্য শুন্যালয়
আপনার লেখাটি অনুপ্রেরনা হিসাবে নিলাম, লিখতে চাই এমনি করে আরেকটি নারীর কথা।
ততক্ষনে পাশের টেবিল থেকে কেউ একজন ডেকে উঠে টিস্যু লাগবে বলে। তিনি সেদিকে ব্যস্ত হয়ে উঠেন…কতো সুন্দর করে আপনি লেখা ফোটান আপু।
রিমি রুম্মান
ঘটনাটি যেমন ভাবে ঘটেছিলো, ঠিক তেমনভাবেই লিখেছি। বাড়তি কোন শব্দ যোগ করিনি কিন্তু। ভীষণ বাস্তব।
নীতেশ বড়ুয়া
মানুষ চেনা বড় দায়…
রিমি রুম্মান
মানুষের জীবনের গল্পগুলো একেক রকম। এসব থেকে আমরা কখনো কখনো কিছু শিখি। সচেতন হয়ে উঠি।