মিনারা জাহান প্রায়ই অপরাধবোধে ভুগেন। সারাদিন মিছিল মিটিং এ শ্রেনী বৈষম্যের বিরুদ্ধে বয়ান দেন অথচ তাঁর নিজের ঘরেই কাজের মেয়ে- বুয়া- ড্রাইভার- দারোয়ান এর সাথে বৈষম্য ্মুলক আচরণ করা হয়। উনি উনার কলেজ পড়ূয়া ছেলে আর স্বামীকে ডেকে বললেন তিনি কালকের দিনটা বৈষম্য মুক্ত দিন পালন করতে চান। একদিনেরই তো ব্যাপার। তাই সবাই রাজী হল। এই সিদ্ধান্ত জানানো হল সবাইকে।
পরে দিন সকালে মিনারার স্বামী ঘুম থেকে উঠে দেখেন ঘর প্রায় অন্ধকার। কোনও শব্দ নাই। ঘড়ীতে সকাল আটটা বাইশ। ধড়মড় করে উঠলেন। সাড়ে নয়টায় জরুরী এপয়েন্টমেন্ট। অনেকগুলা টাকার ব্যাপার। কোনও রকম ব্রাশ করে টেবিলে এসে দেখন সুনসান চারিদিক। চিৎকার করে ডাকলেন বুয়াকে। বুয়ার নড়াচড়ার কোনও লক্ষণ নাই। বরং উঠে আসলেন মিনারা।
শ্রেনী বৈষম্য মুক্ত দিন কিনা, তাই দিনের শুরুতেই বুয়াকে উঠিয়ে ধমকি দেবার ইচ্ছা অনেক কস্টে দমন করলেন। নিজেই পুরানো পাউরুটি যেটা আসলে বুয়া আর ড্রাইভারকে খাওয়ানোর জন্য রেখেছিলেন সেটাই গরম করে সাহেবকে খাওয়ালেন।
কাজের মেয়েটা ঘুমাচ্ছে বেহায়ার মত। বুয়া আস্তে ধীরে উঠে বাথরুমে গেছে। অনেক্ষণ বের হবার নাম নাই।
সাহেব গেলেন গ্যারেজে। ড্রাইভার ঘুমাচ্ছে। শ্রেনী বৈষম্য দিবসের নিকুচি করে উঠালেন তাকে। কিন্তু সে মিন মিন করে বলতে লাগলো- “আজকে তো শ্রেনী বিন্যাস দিবস (!!!) আমি কাজ করব না ভাবছিলাম।”
তাকে ধমকি দিয়ে গাড়ীতে উঠিয়ে সাহেব রওনা হলেন। বেচারা ড্রাইভারের সকাল সকাল শ্রেনী বৈষম্য মুক্ত দিবসের বারোটা বেজে গেল।
ততক্ষণে বুয়া বের হইছে। বুয়াকে দেখে মহারানী আকলিমা চোখ পিট পিট করে জিগেস করতেছে- আজকে এত তাড়াতাড়ি রইদ উইঠ্যা গেছে গা?
হ, তোর মাথা। নয়টা বাজে।
ধড়মড় করে উঠতে গেল আকলিমা, বুয়া আশ্বস্ত করলো। আজকে কি জানি দিবস। আমরা আর ম্যাডাম আজকে সমান।
-তইলে নাশ্তা বানাইবো কে?
-কেন? আমরা যদি সমানই হই তাইলে প্রত্যেকদিন আমরা বানাই আজকে ম্যাডাম বানাইবো
বুয়া মিনারা কে বেডরুমে গিয়ে বলে দিয়ে আসল- ম্যাডাম আজকে আপনে নাশ্তা বানাইবেন, রান্না করবেন, ঘর মুছবেন, কাপড় ধুইবেন, বাসন মাজবেন। আমি আর আকলিমা বাইরে যামু।
– তোমরা বাইরে গিয়ে কি করবে?
-ওমা আপনে প্রইত্যেকদিন বাইরে বাইরে ঘুরেন। আজকে আপনে আর আমি সমান হইলে আজকে আমি যামু।
-কিন্তু আমি তো কাজে যাই
-আমরা কি তইলে আকামে যামু? আমরার ও কাম আছে।
বলেই আয়েশী ভঙ্গীতে ফোন তুলে কল দিল ড্রাইভারকে।
কিন্তু বুয়ার ভাগ্য এইদিকে ভাল না। ড্রাইভার আজকে তার গার্ল ফ্রেন্ড নিয়া গাড়ীতে কইরা বেড়াইতে যাবে আশুলিয়া। স্যার তো প্রায়ই যায়। :p
যাই হোক। আকলিমা আর বুয়া সেই পুরানো পাউরুটি দিয়ে নাশতা করে বের হল। এদিকে মিনারা কিছু খেতে পারছেন না। ইচ্ছা করছে না কিছু। ছেলেটার পরীক্ষা। ওর জন্য হলেও কিছু বানানো দরকার।
নাশ্তা বানাতে বানাতেই বেলা এগারোটা। ছেলে উঠে খেল কিনা খেয়াল রাখা সম্ভব না। কাপড় ধুতে হবে, রোদ চলে যাবে নাহয়।
মেজাজ ঠিক রাখা আর গেল না। বুয়া নিজের পেটিকোট- ব্লাউজ সমেত শাড়ি রেখে গেছে ধোয়ার জন্য।
ফোন করে সব জরুরী কাজ বাতিল করলেন মিনারা। যত যা ই হোক, ছেলেটার পরীক্ষা সামনে। বাসায় সব কিছু ঠিকঠাক চলা চাই।
অনেক কষ্টে সব ম্যানেজ করার পর এখন কিছু অফিসের কাজ ন্যে বসবেন- এমন সময় আকলিমা আর বুয়া আসল।
-ম্যাডাম চা বানান। অনেক কাহিল হইছি বাইরে।
চিবিয়ে চিবিয়ে জিগেস করলেন- কই গেছিলা তোমরা?
আকলিমা তা একটূ গাধা। সে গড়গড় করে বলতে লাগলো তারা আসলে তেমন কোথাও যায় নাই। বুয়ার বোন যে বাসায় কাজ করে সেই বাসায় আর একটু টেলিফোনের দোকানে বুয়ার আগের স্বামীর সাথে কথা। আকলিমা সম্ভবত বাইরে গেছে এতেই খুশি।
সাহেব বাসায় ফিরলেন এই সময় হন্তদন্ত হয়ে। ড্রাইভার কই জানি গেছে এখনো আসে নাই।
এমন সময় ফোন। আননোন নাম্বার।
-হ্যালো
-হ্যালো স্লামালেকুম
-মিনারা বলছেন?-জ্বি। কে বলছেনপ্লিজ
-ভাবী আপনি আমাকে চিনবেন না, আপনার বুয়ার বোন আমার বাসায় কাজ করে। আজকে এসেছিল, আমার বুয়ার কাছে নাম্বার দিয়ে গেছে আপনার ওর থেকে নাম্বার নিয়ে ফোন করলাম একটা কারনে।
-জ্বি প্লিজ
-আপনার বুয়ার সাথে একটা মেয়ে এসেছিল। মেয়েটা এখানে এসে খুব বিশ্রি একটা কাজ করে গেছে। বারান্দা দিয়ে পাশের বিল্ডিং এর ব্যাচেলর ছলেদের মেসে ঢিল মেরেছে। ওরা কমপ্লেইন করেছে।
-হোয়াট?
-আপা, একটা রিকোয়েস্ট। কিছু মনে করবেন না। ও ওর লেভেলের ছেলেদের সাথে এগুলা করলে নাহয় কিছু বলতে পারতাম। সে ভার্সিটির স্টুডেন্টদের সাথে এসব করে গেছে। ওকে আর কখনো এখানে পাঠাবেন না। আমি খুব বিপদে পড়বো।
– না না, ওকে আর যেতে দিব না। আমি খুব লজ্জিত ও আপনাকে বিপদে ফেলেছে।
-ঠিকাছে আপা, পরে কথা হবে। রাখি।
মিনারা’র আর কথা বলার মত মানসিক বা শারিরীক শক্তি নাই। বসে পড়লো ড্রইংরুমের কার্পেটে।
ছেলেটা সারাদিনে এই মাত্র ঘর থেকে বের হল।- মা আমি বাইরে যাচ্ছি। আসতে দেরী হবে।
-সে কি? তোমার না পরীক্ষা? সন্ধ্যাবেলা বইরে যাবে কেন তুমি?
-মা, তুমি ত শ্রেনী বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতেছো। একদিন বছরে সবদিনই আজকের দিনের মত হবে। তাহলে আমি পড়াশোনা করে এত ত্যাগ করে উচ্চশ্রেণীতে যাবার বা থাকার চেষ্টা করে কি লাভ? তারচে জীবন এনজয় করি, দিনের শেষে তো সবাই সমান। বাই মা, ডোন্ট ওয়েইট। আই’ল বি লেইট
(শ্রেনী বৈষম্যের সঠিক সংজ্ঞা জানা নাই। চোখ কান থাকার কারনে যতটূকু বুঝেছি তার উপর ভিত্তি করে লিখলাম। কেউ দুঃখ পেলে তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী)
১২টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
শ্রেনী বৈষম্যের কথা বলা যত সহজ , বাস্তবায়ন বা নিজের চারপাশে দেখতে চাওয়া অবাস্তব আসলে ।
আমরা আসলে আমাদের অধিনস্ত মানুষদের দিয়ে এত অতিরিক্ত কাজ করাই যে , আমরা সম্পুর্নই তাদের উপর নির্ভর হয়ে পরি ।
হাঁসির মাধ্যমে উপস্থাপন করলেও ভালো একটি বার্তা দিয়ে গেলেন ।
সিনথিয়া খোন্দকার
হয়তো শ্রেনী বৈষম্য মুক্ত সমাজের সঠিক চিত্র এটা নয়। তবে আমরা ভুঁইফোড় যত বিপ্লবীদের শ্রেনী বৈষম্য বিরোধী বক্তব্য দিতে শুনি তার মানে টা এমনই দাঁড়ায় যে “সবাই সবক্ষেত্রে সমান”।
এটা নেহাতই অবাস্তব একটা ধারনা। অসম্ভব আর অনুচিত ও বটে।
প্রহেলিকা
ভালই লিখেছেন কাল্পনিক হলেও সুন্দর করে বার্তা দিয়ে গেলেন। কিন্তু এই বৈষম্য কোনদিন দূর হবার নয় আসলে। সমাজের আদি থেকে অন্ত এটা থেকেই যাবে। এই ব্যপারে আমি আশা করতেই পারিনা।
সিনথিয়া খোন্দকার
সত্যি ই আশা নেই।
ছাইরাছ হেলাল
বক্তৃতাবাজির সাথে বাস্তবতা যায় না ।
সিনথিয়া খোন্দকার
অনেক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। হঠাত বিপ্লবে হয় না আসলে। (y)
যাযাবর
বিপ্লব আমাদের দেশে হয় না । সাম্যবস্থা নিয়ে আমাদের ধারনা অস্পস্ট । কেউ সঠিক ধারনা দেননি এখন পর্যন্ত ।
ফান হিসেবে ভালোই লেগেছে ।
সিনথিয়া খোন্দকার
সেটাই বলতে চেয়েছিলাম। নিম্ন শ্রেনী হিসেবে আমরা যাদের চিনি, তাঁদের ভেতরে উচ্চশ্রেনীর প্রতি ক্ষোভ আছে সঙ্গত কারনেই। হঠাত করে সাম্যাবস্থায় আনতে চাইলে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠবে। এটার পরিনতি ভাল হবে না। ভাল লেগেছে এজন্য ধন্যবাদ। 🙂
বনলতা সেন
নো মেসেজ তাতেই এমন !
আপনি নিয়মিত লিখুন । বেশ সুন্দর করে ভেবে গুছিয়ে লিখতে পারেন দেখছি ।
সিনথিয়া খোন্দকার
আপনার লেখার ভক্ত আমি। আপনার কমপ্লিমেন্ট পেয়ে ভালো লাগছে। 🙂
শুন্য শুন্যালয়
বেশ মজা করে লেখেন আপনি আপু..মেসেজ কিন্তু ছিলো 🙂
সিনথিয়া খোন্দকার
ছিল সেটা ঠিক। তবে ভেবেছিলাম সবাই ঠিকভাবে নিতে পারবে না মেসেজ টা। তাই সেইফ সাইডে গিয়ে শিরোণামটা দিলাম। 🙂