গ্লাসে পানি ঢেলে খাচ্ছি, এমন সময় ফোনটা বাজছে। কে কল করতে পারে এসময়? পানি রেখেই দৌড়ে গেলাম কোন জরুরী ফোন ভেবে। গিয়ে দেখলাম অচেনা নাম্বার থেকে কল। ফোনটা ধরে জিজ্ঞেস করলাম কে তিনি? উত্তর এলো,
: আমাকে চিনতে পারছ না?
: আমি দুঃখিত। আপনার পরিচয়টা বলবেন কি?
: আমি অরণ্য।
আমি কিছুক্ষণ থমকে রইলাম। কিন্তু ঐ পাশ থেকে আবারও কথা ভেসে এলো…
: এখনও চিনতে পারনি?
এই সেই অরণ্য, যার জন্য আমি দিন রাত এক করে তপস্যা করেছি। আমাদের পারিবারিক সিদ্ধান্তে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের আগের প্রেম বলতে ছিল তাহসান খান, জন আব্রাহাম, রনবীর কাপুর প্রমুখ। বিয়ে নিয়ে কত সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন ছিল স্বামী এবং সংসার নিয়েও। কিন্তু তাহসান, জন, রনবীরকে ছাড়া কাওকে পছন্দ করতে পারতাম না। বিয়ের কয়েক বছর আগে নতুন করে পছন্দের তালিকায় একজন যোগ হলো: অরিজিত সিং। দিন যায়, রাত আসে, ভাবি শুধু তারই কথা, অরিজিত, অরিজিত… আমার পৃথিবী তখন অরিজিতময়। এরই মাঝে হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসলো অরণ্য। যেহেতু আমার কারও সাথে কোন প্রেমের সম্পর্ক ছিলো না, তাই তাকেই অনেক বড় একটা জায়গা দিয়ে বসলাম। মনের যেটুকু আসন শুণ্য ছিল, তার পুরোটাই তাকে দিয়ে দিলাম। কিন্তু সে কতখানি আমায় দিয়েছে তা বোঝা গেল না।
যত দিন যায় তত অবাক হই। খাওয়া, ঘুম আর ২ মিনিটের আয়েশ ছাড়া জীবনে যেন আর কিচ্ছু নেই! না কোন রোমান্স, না কোন বিনোদন, না তো কোথাও একসাথে ঘুরতে যাওয়া। সারাক্ষণ একা একাই নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকা ছাড়া আর যেন কিছুই করার নেই। কার সাথে কথা বলব? সে হয়ত ঘুম নয়ত ফোনে ব্যস্ত। দিনকে দিন অবহেলার পাল্লাটা যেন আরও ভারী হতে লাগল। আমি আর নিতে পারছিলাম না। তাই সরে এলাম।
কত দিন গেছে একা রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজেছি! কত দিন গেছে বহু পথ হেঁটে টিউশন পড়িয়েছি শুধু একটু খেয়ে পড়ে বাঁচার জন্য, একটা ছাদের জন্য। একটা সময় টিউশন পড়াতাম শখের বশে, আর পরেরবার পড়িয়েছি বাঁচার তাগিদে। নিজের একটা ছোট্ট ভাঙা কুটির ছিল, যার জন্য মাসে গুনতে হত তিন হাজার টাকা। পড়ানো শেষে এই ভাঙা কুটিরে বসে চোখের জল, নাকের জল এক করে পড়তে বসেছি। কেউ নেই এ জল দেখার। কোথাও কেউ ছিল না।
: হ্যালো, শুনতে পাচ্ছ?
: হ্যাঁ, পাচ্ছি।
: কিছু বলছ না যে?
: কি বলব?
:কিছুই কি বলার নেই?
একটা সময় ছিল, যখন কত কিছু বলতে চাইতাম আমি এই অরণ্যকে। কিন্তু সে বাসায় ফিরেই সারাদিন মোবাইল নিয়ে সময় কাটাত, নয়ত ঘুমিয়ে থাকত। মাছের মুখে যেমন লবন দেয়, আমার মুখেও তেমনি লবন পরত। আমিও থাকতাম আমার মত, আর না বলা কথাগুলো হারিয়ে যেত একসময়।
বিয়ের পর যখন নতুন বাসায় উঠি, তখন মনে আছে আমি সারাক্ষণ তার পাশে বসে থাকতাম একটু গল্প করার জন্য, নিজেদের নিয়ে দুটো অনুভূতি শোনার জন্য। আমি আমার অনুভূতিগুলো তার কাছে বলতাম, কিন্তু সে শুনেও না শোনার ভান ধরত, আর নিজেরটা প্রকাশ করা তো দূরে থাক। আমি বুঝে নিতাম সে আসলে ভালোবাসে না। বিয়ে করতে হয়, বংশবৃদ্ধি করতে হয় বলে, এটুকুই বোঝে। যাই হোক, এরকম একটা শূণ্যতা বুকে নিয়ে হাহাকার করতে করতে কিছু দিন টিকে রইলাম ঠিকই, কিন্তু এমন একটা অসুস্থ পরিবেশে কোন নতুন মুখ আনার ভরসা পেলাম না। ফলে আমাকেও আর তার দরকার হলো না। আমি চলে এলাম, খুঁজে নিলাম নিজের পথ।
সৎ পথে একটা চাকরি খুঁজতে গিয়ে কত নাকানি চোবানি খেয়েছি তা আমি জানি। অবশেষে টিকে থাকার মত একটা চাকরিও পেয়ে গেলাম, জীবন ঘুরে দাঁড়ালো। কিন্তু আর কারও ভালোবাসা পেতে মন একটুও ছটফট করে না। আজ আর কাওকে ভেবে অযথা সময় নষ্ট করতেও ইচ্ছে করে না… তাহসানকেও না, অরিজিতকেও না।
কী আশ্চর্য, যার ফোন কলের অপেক্ষায় দিন কাটত, একটু বেশি সময় কথা বলার আকাঙ্ক্ষায় বিভোর হতাম, আজ তার কল পেয়ে আমি কোন অনুভূতির সারা পাচ্ছি না। আমার কোন অনুভূতিই হচ্ছে না।
: কি হলো, তুমি কি বাক প্রতিবন্ধী?
ঠিক এই কথাটা একসময় আমি তাকে বলতাম। তার অনুভূতির কোন বহিঃপ্রকাশ ছিল না বলে রেগে গিয়ে আমি তাকে এসব বলতাম। তবুও সে নিশ্চুপ, নির্লিপ্ত থাকত। আজ তার মুখে এই কথা।
: শুনছি, বলুন।
: আমি তোমাকে আজও…
আর কিছু শুনতে মন চাইলো না বলে ফোনটা কেটে দিলাম।
৫টি মন্তব্য
আলমগীর সরকার লিটন
খুব সুন্দর অল্পকথাগুলো অনেক শুভেচ্ছা রইল ভাল থাকবেন
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
খাদিজাতুল কুবরা
জীবনের পরিভাষা এতোই কঠিন যে তা একসময় আর বলতে বা শুনতে ইচ্ছে করেনা। খট করে লাইন কেটে দিতে হয়।
মনির হোসেন মমি
প্রেম পাগল।
পুরুষ মানুষের ভালবাসা প্রকাশে ভিন্নতা থাকে সবায় হয়তো ভালবাসার কথামালা সরাসরি বলে না,রোমাঞ্চে যায় না।এসব পুরুষের ভালবাসা মনের ভেতরে সুপ্ত থাকে তবে তার গভীরতা অনেক।
চমৎকার অনুগল্প।
হালিমা আক্তার
জীবন একসময় যা পেতে চায়, তখন তা পায়না। পরবর্তীতে পেলে আর ইচ্ছে জাগে না। শেষ টা খুব ভালো লাগলো।