সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে আর সবার মত আমার রাত হয় না। আমার খোঁজের শুরুটাই হয় ঐ সময়টাতে। আমি প্রশান্তির গল্প গুলি খুঁজে বেড়াই এই শহরের কোলাহলের ভীরে। পরিচিত মুখ গুলি যখন আপন আলয়ে ফিরে যাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ছুটাছুটি লাগায় তখন আমি তাদের মাঝেই দাড়িয়ে সময় কাটাই। আমার তো আপন আলয় বলতে কিছু নেই। যা আছে তাকে বড়জোর একটা মাথা গোজার ঠাই বলা চলে। অবশ্য আমার মত অনেকেই সেই মাথা গোজার ঠাইয়ের দিকেই ছুট লাগায়। আমি তাদেরও ব্যস্ততা দেখি। একবার কোনোমত আপন ঠিকানায় পৌছাতে পারলেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচে এরা।
সন্ধ্যার পর রাতটা কেউ আর উপভোগ করে না। সবাই সেই সময়টাতে বিশ্রাম জিনিষটাকে খুঁজে বেড়ায় নিজ নিজ ঘুমের দেশে। যদিও এই শহরে কেউ সত্যিকার অর্থে ঘুমাতে পারে কি না তা নিয়ে আমর যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখি এদের ঘুম নামের সেই অভিনয়। যে অভিনয় করে এরা নিজেকে বুঝ দেয় যে, এরাও শান্তিতে রয়েছে।
মাস শেষে যখন সবাই যখন হিসেব করতে ব্যস্ত সময় পার করে, আমি তখনও তাদের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখি। কি নিপুণ ভাবে কষ্ট সহ্য করে এরা সঞ্চয় করে চলেছে। আধ বেলা খেয়ে পূর্ণ এক বেলার শান্তি কি করে যোগায়! তা দেখলে আশ্চর্য হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। যখন আপনজনদের সাথে দূরালাপনিতে তারা যোগাযোগ করে, তাদের আবদার আর বায়না গুলি শোনে, তা নিয়ে কথা বলে। তখন কিন্তু তাদের চোখে মুখে একটা বিরক্তির ছাপ দেখা যায়। তবে সেই বিরক্তিটাকেও আমি তাদের উপভোগ করতে দেখি। এরা প্রতিটা জিনিষই উপভোগ করার এক অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়।
এরপর যাদের এই শহরে একটা ছোট্ট হলেও আপন ঠিকানা বলতে কিছু আছে, আমি তাদেরও দেখে সময় পার করি। ক্লান্তিতে পরিশ্রান্ত হয়েও এরা আপন আলয়ে প্রবেশ করে সেই বিশাল একটা করে হাসি দেয়। সেই হাসির মূল্য এদের আজীবন কষ্টের পারিশ্রমিক থেকেও বেশি মনে হয়। ছোট্ট ছেলেটা কিংবা মেয়েটাকে কোলে জড়িয়ে সকল ক্লান্তি থেকে কেমন করে যেন পিছু ছাড়িয়ে নেয় এরা। চোখের পলকে যেন এদের শক্তি ফিরে আসে। নতুন উদ্যম নিয়ে এরা আনন্দে মেতে উঠে সেই ছোট্ট আলটার মধ্যে।
আমি চেয়ে চেয়েই দেখি। হাজারও ঝঞ্ঝা পেরিয়ে যখন কোন অপরিচিত রিকশাওয়ালা তার ছাউনিতে ফিরে যায়। আধো অন্ধকার আধো আলোর ঘরগুলিতে কেমন যেন একটা খুশির আমেজ ফিরে আসে। আমি দেখি তার সাত কি আট বছরের মেয়েটা কেমন করে তাকে জড়িয়ে ধরে। তার জন্যে কিছু একটা বোধয় আনার কথা বলেছিল, সেটা নিয়ে এসেছে কিনা তা জানতে চায়। রিকশাওয়ালা ক্লান্তির চেহারায় উজ্জ্বলতা ভরে সেই কাঙ্ক্ষিত বস্তুটা মেয়েটার হাতে তুলে দেয়। আর মেয়েটা সেই বস্তু নিয়ে ছুটে গিয়ে মা কিংবা পরিচিত কাউকে দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর রিকশাওয়ালা সেই ছুটাছুটি দেখেই কেমন করে যেন তার ক্লান্তিকে ভুলে যায়।
আমি দেখতে দেখতে সামনে এগিয়ে যাই। কোন এক ক্রসিঙের সামনে কিছু সময় অপেক্ষা করে দেখি পাশের ছাউনিটাতে লাইন ম্যান টেবিলটাতে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। আর সেখানেও এক প্রশান্তির ছাপ। যেন এভাবে ঘুমিয়েই শ্রেষ্ঠ ঘুমটা অর্জন করা যায়। তারপর যখনই একটা হুইসিল কিংবা ঘণ্টার শুনতে পায় ওমনি ছুট লাগায় ক্রসিঙের দিকে। আশে পাশে চেয়ে দেখে নেয় কোন লাইনটা থেকে ট্রেনটা ছুটে আসছে। কি বিরক্তিটাই না থাকে তার চেহারাটায় তখন। কিন্তু যখনই আবার ফুরসুত পায় সেই টেবিলটাতে মাথা রাখার। ওমনি তার সকল বিরক্তি কোথায় যেন ঢাকা পড়ে যায়।
আমি ক্রসিং পেড়িয়ে সামনে এগিয়ে চলি। এবার মাথা উঁচু কোন বিল্ডিং এর ছোট্ট বারান্দায় চোখ আটকে যায় আমার। সেখানে কেউ একজন জ্বলন্ত সিগার হাতে নিয়ে দোল কেদারায় বসে আছে। একটু একটু দুলছে আর একটু একটু করে আগুনে সিগার পুরিয়ে নিচ্ছে। আমি তার চেহারা দেখতে পাই না, শুধুমাত্র একটা ছায়া চোখে পড়ে। কিন্তু সেই ছায়াটাতে কোন প্রশান্তির ছাপ খুঁজে পাই না। আমি অপেক্ষা করি, অপেক্ষা করতেই থাকি একটা প্রশান্তি সেই ছায়ামূর্তিটাতে দেখার জন্যে। ওদিকে ভোর প্রায় হয়ে আসে। মসজিদের মুয়াজ্জিন “আল্লাহু আঁকবার” বলে মুসুল্লিদের ডাকতে শুরু করে। কিন্তু ঐ ছায়ামূর্তিটার ছায়ায় আমি প্রশান্তির ছাপ দেখতে পাই না……..
১৭টি মন্তব্য
খসড়া
সবাই ভাল থাকুক।
অলিভার
হ্যাঁ, নিজ নিজ অবস্থানে সবাই ভাল থাকুক, এটাই কামনা করি 🙂
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্যে 🙂
স্বপ্ন
আপনি অনেক কিছু দেখেন। আপনার চিন্তা এবং জীবন বোধ ভালো লাগলো।
অলিভার
আপনি যতটা ভাবছেন, আমার দৃষ্টি আসলে ততটুকু তীক্ষ্ণ নয়। জীবনটাকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখার বেজায় ইচ্ছে। আর ইচ্ছেগুলিই মাঝে মাঝে এলোমেলো ভাবনা এনে দেয়।
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্যে। শুভ কামনা জানবেন 🙂
ছাইরাছ হেলাল
আপনার পর্যবেক্ষন বোধ দেখে ভালো লাগল ।
আপনি নিজেও রাত জেগে থাকেন ।
অলিভার
পর্যবেক্ষণ বোধ ঠিক কতটুকু আছে আর কতটুকু থাকলে সেটা একটা অবস্থানে পৌঁছে তা আমারও জানা নেই। তবে হ্যাঁ, রাতজাগা এখন এক ধরনের নিয়ম হয়ে গেছে। অপ্রয়োজনেই রাত জাগি এখন।
ধন্যবাদ কষ্ট করে লেখাটা পড়ার জন্যে।
শুভ কামনা জানবেন 🙂
মশাই
চমত্কার বর্ণনা করেছেন আপনি যা নিজ ভানাগুলোর স্বচ্ছতা প্রমান করে। লিখে যান গল্পকার। অভিনন্দন আপনাকে।
অলিভার
সত্যিই কি চমৎকার বর্ণনা? কিছু জায়গা কিন্তু আমার নিজের কাছেই একটু অপূর্ণ মনে হয়েছে। আমি এই পর্বেও আশা করেছিলাম আমার এই দৃষ্টির সীমাবদ্ধতার কিছু আপনার কাছ থেকে জানতে পারবো। আপনি কিন্তু ঐ হিসেবে আমাকে হতাশ করলেন মশাই।
চেষ্টা করবো আপনাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে। একটু পিছু পড়ে গেলে আপনাদের উপর ভর করেই এভাবে চলবো :p
শুভ কামনা থাকলো ভাইয়া 🙂
মশাই
কেন জানি ভয় হল বলতে এবার, হয়তো বলা ঠিক হবে না ভেবেই চুপ ছিলাম কারণ এতে আপনি নিরুত্সাহিত হতে পারেন। যদি এমন মনে হয় তাহলে আমার কথা আমলে নেবার দরকার নেই ভাইয়া। আপনার লেখার হাত ভাল চর্চা যেন থেমে না যায়।
মশাই
তাল মিলানোর কোন দরকার নেই ভাইয়া, আপনি আপনার গতিতে এগিয়ে যাবেন। আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার জন্য চুপ করে থাকতে হয়, তবে যতটুকু জানি তা শেয়ার করি। এই সোনেলাতে অনেক ভাল ভাল লেখক রয়েছে তাদের মাঝে আপনিও একজন বলতে দ্বিধা নেই শুধু একটু সচেতনতা দরকার।আর তাছাড়া গল্প লেখাটাই অনেক কঠিন একটি ব্যাপার আমার কাছে, কেমন জানি গুলিয়ে ফেলি।আপনি শুরু করেছেন তাই এগিয়ে যেতে হবে। লিখতে থাকুন অবিরাম। সাথে মাঝে মাঝে সময় করে নিয়ে গল্প পড়ুন তাতে আর একটু ভাল হবে বলেই আশা রাখি।
আজিম
খুবই ভাল হয়েছে জনাব অলিভার। আপনার পর্যবেক্ষনের প্রতিফলন ঘটতে থাকুক।
ধন্যবাদ আপনাকে।
পুষ্পবতী
ভালো লাগলো ভাইয়া।
বনলতা সেন
আপনার দেখার চোখ তৈরী হচ্ছে দেখছি । দেখতে থাকুন ও লিখতেও থাকুন ।
মিথুন
শহরে প্রশান্তি খুঁজে আর পাওয়া যাবেনা। খুব ভালো লিখেছেন ভাইয়া।
লীলাবতী
কিছু লেখা মনে দাগ কেটে যায়। এটিও তেমন লেখা ।
সীমান্ত উন্মাদ
বেশ ভাললাগল দেখার বিষয় গুলোকে লিখার ভিতর আনার বেপারটা। কিছু বানান একটু দেখে নেবেন। শুভকামনা নিরন্তর।
জিসান শা ইকরাম
দেখাকে খুব ভালো ভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন।
ট্যাগ দিচ্ছেন ঠিকভাবে , অভিনন্দন এজন্য।
অনেকেই এর গুরুত্ব বুঝতে পারেন না।