
তিন সন্তানের জননী আছিয়া বেগম। তার দুই ছেলে ঢাকায় সোয়েটার কোম্পানিতে চাকরি করেন। গত মার্চে তার ছেলেরা বাড়িতে চলে এসেছেন। দুই ছেলেকে দেখে মায়ের মন
অনেক খুশি। কিন্তু এটাও প্রশ্ন করে, “দুইজন একসাথে ক্যান বাজান? চাকরি কী চইল্যা
গেছে ? ” ছেলেরা কথা কয়না শুধু দুই ঠোঁটের মাঝখানে একটা শব্দ উচ্চারণ করেন একজনে। এর মানে আছিয়া বেগম বোঝে না। কেমন নীরব হয়ে তাকিয়ে থাকে, ভাতের ডেকচি চড়ায় চুলোয়।
ছেলেদের প্রিয় মাসকলাইয়ের ডাল রান্না করেন মাছের মাথা দিয়ে। পরদিন সকালে মা ছেলেদেরকে বলেন, “তোরা দুইজন যহন আইছছ বাড়িতে তাইলে আমার মেয়ডারেও একটা ফোন কর সেও আয়ুক। সবাই একসাথে হই” বড় ছেলে রুবেল বাদ দাও তো, আর তুমিও কোথাও যাইবা না” বলে আবার সেই শব্দটি উচ্চারণ করেন। এই শব্দটা শোনলেই আছিয়ার মাথা ঝিমঝিম করে, চোখের আলো ঝাপসা হয়ে ওঠে কিন্তু শব্দটার মানে সে বোঝে না। কিন্তু ছেলেদের সে জিজ্ঞেস ও করে না। ছেলেরা এখন কামাই রোজগার করেন। কিছু বললেই বাঁকা তেড়া কথা কয়। আছিয়া ভয় পায় তাদের তাই মানে টা আর জিজ্ঞেস করে না।
কিন্তু মানে ডা তো জানতে অইব। আছিয়া মনে মনে ভাবে, একবার মিল্লাত মাষ্টারের কাছে যাই। আছিয়া সন্ধ্যায় মিল্লাত মাষ্টারের কাছে যায় এবং শব্দটার মানে সে জেনে আসে। মানুষ এইভাবে মরতে পারে! আছিয়ার মনে বিশ্বাস হয় না। আছিয়া বলেন, “মিতরো যদি কফালে লেহা থাহে মরতে ত অইবই এই তা কিছু না”। আছিয়ার কথা শোনে মিল্লাত মাষ্টার দুই ঠোঁটে মিটমিট হাসে। আর বলে ” না গো সোহেলের মা সচেতন থাকতে হবে বার বার হাত ধোঁতে হবে। “মিল্লাত মাষ্টারের বাড়ির পরেই বাজারের গলি, গলির মোড়ে একটা চায়ের দোকান।
এই গলিটা দিয়ে বের হলেই আছিয়ার বাড়ির পথ। আছিয়া দ্রুত গলিটা পার হতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ ছোট ছেলে সোহেল চায়ের স্টল থেকে বের হয়ে সামনে পড়ে মায়ের। মা তো ভয়ে ছোট হয়ে যায়। যেমন ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে পড়লে আত্মা দৌড়াতে থাকে তেমন তাড়া নিয়ে এদিক-ওদিক করে কেটে পড়তে চায় মা। সোহেল দাঁত কিড়মিড় করে বলেন, ” কই গেছিলা? তোমারে না করছি না কোন হানো না যাইতে। যাও বাড়িতে আজ। শয়তান মহিলা “।
আছিয়া দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ি চলে আসে। আছিয়ার শরীরটা আজ বেশ খারাপ রাতে ছেলেদের খাবার দিয়ে আগেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। পরদিন সকালে আছিয়া ঘুম থেকে উঠতে পারে না তার শরীরে মারাত্মক জ্বর ও কাশি। সোহেল ও রুবেল এক সাথে হয়, রুবেল বলে “এই মহিলারে না করছিলাম কোনো হানে যাইতে।”
অহন হে নিজেও মরব আমরারেও মারব” সোহেল ন্যায় শাস্ত্রের মতো বলেন , “হের লাইগ্যা আমরা মরতাম ক্যা? হে আমরার কতা হুনছে না। অপেক্ষা কর রাইতটা অইতে দে তারে আমরা জঙ্গলে রাইখ্যা আইমু।”
রুবেলও সোহেলের কথায় সম্মতি দেয়, এবং রাতে মা ঘুমিয়ে গেলে তাকে বস্তায় ভরে জঙ্গলে রেখে আসে। মায়ের চিৎকার কান্না কোনকিছুই তারা শোনে না। অসহায় মা দুই চোখের জল নীরবে ছাড়ে বলে, “আমারে এই জঙ্গলে ফালাইয়া কই যাও তোমরা?”
এক কান থেকে দুই কান এভাবে পুরো গ্রামে খবরটা ছড়িয়ে যায়। পরদিন সকালে হাতে মাইক্রোফোন, ক্যামেরা নিয়ে সাংবাদিক আসেন। কিছু স্বেচ্ছাসেবী মানুষ আছিয়া বেগমকে নিয়ে যান হাসপাতালে। কেউ কেউ থুথু দেয় তাদের কাজে। আবার কেউ কেউ বলেন, কী করবে আর এছাড়া। রাতে এই ঘটনা টেলিভিশনে প্রচার হয়। চায়ের দোকানে আজ একটাই কথা। “দুনিয়াডা কী অয়া গেলো!”
রুবেল ও সোহেল ভয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু কোথায় যাবে, আত্মীয় স্বজন সবাই খবরটা জানে। এমন নিমক হারাম সন্তানকে কে থাকার জায়গা দেয়! তাছাড়া যারা ঢাকা থেকে এসেছেন তাদের প্রতি মানুষের আচরণ , যুদ্ধপরবর্তী রাজাকারদের মতোন। কোথাও থাকার জায়গা না পেয়ে বনে জঙ্গলে দুদিন ঘুমিয়ে তাদের ঠাণ্ডা লাগে ও জ্বর আসে। শেষমেশ তারা অসুস্থ শরীর নিয়ে ফিরে আসেন বাড়িতে।
পনেরো দিন পর আছিয়া বেগম সুস্থ হলে, থানার পুলিশেরা তাকে বাড়িতে নিয়ে যায়। এ কোন বাড়ি! বাড়ি তো ফাঁকা। আছিয়া বেগম নিরাশ হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “আমার ছেলেরা কই” পাশ্ববর্তী লোকেরা তখন আঙুল উঁচু করে দেখিয়ে বলেন, আপনার বাড়ি “লকডাউন” করা হয়েছে। “আপনার দুই ছেলেই করোনা আক্রান্ত । তারা ঢাকা থেকেই আক্রান্ত হয়ে এসেছেন। তাদের কাছে যাওয়া নিষেধ আছে।”
আছিয়া বেগম কাউকে কিছু না বলে কাঁদতে কাঁদতে নিজের ছেলেদের কাছে এগিয়ে যান এবং বলেন, “কী অইছে বাবারা আমার।”
কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই , ভেতরের দরজা খুলতেই বিকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মানুষ যে যার মতো নাক চেপে সরে যায়। কিন্তু মা’কি কখনও সন্তানের লাশের গন্ধ পায় ?
তার বিলাপ আহাজারিতে কোন কৃত্রিমতা নেই। নেই সন্তানদের প্রতি অভিযোগও শুধু একটাই অভিযোগ ছিলো তার, “হে আল্লাহ এইডা তুমি কী করলা?” আছিয়ার এখন কেউ নেই। শূন্য ভিটার উপর থুউর কাটা কলাগাছের মতো, তারা বাড়িটা মাথা থেকে শুকিয়ে আসছে, মাঝখান দিয়ে ভেঙে পড়ছে , আবেগ আর বাস্তবতায় ভেজা
বাঁশের চাটাইগুলো। এরপর থেকেই আছিয়া বেগমের নাম হয়েছে , আছিয়া পাগলী। এখন তিনি গলির মোড়ে, দাঁড়িয়ে থাকেন হাতে নিয়ে বাংলাদেশের ছোট্ট একটি ফ্লাগ কোন মানুষ গাড়ি যানবাহন দেখলেই তিনি সামনে দাঁড়ান ফ্লাগ দিয়ে সিগন্যাল দেন, আর বলেন, লকডাউন! লকডাউন।
দালান জাহান
২৮.০৪.২১
১৪টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
চমৎকার গল্প। মায়েরা বুঝি এমনই। যে সন্তান সমস্যা, বিপদের কথা বলে বাবা-মাকে পর করতে একমুহূর্ত ও সময় নেয় না সে-ই সন্তানের বিপদে , লাশের পাশে বাবা-মাকে ই আগে পাওয়া যায়। হায়রে করোনা আরো যে কত নির্মমতা দেখাবে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা অবিরাম
দালান জাহান
ধন্যবাদ আপু কষ্ট করে গল্পটি পড়েছেন বলে আমি অনুপ্রাণিত….
জিসান শা ইকরাম
করোনায় এমন মৃত্যু কাম্য নয়,
সচেতনতা জরুরী খুবই।
মা কখনো সন্তানকে দূরে রাখতে পারেন না।
শুভ কামনা।
দালান জাহান
সত্যিই পারে না। কী করে পারে মা তো মা-ই
আরজু মুক্তা
বাস্তবতা।
মাস্ক পরতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই। নিজে সচেতন হই। অন্যরে সচেতন করি।
শুভ কামনা ভাই
দালান জাহান
হা মাস্ক পড়ার গল্পটা লিখিনি কবি এখনো তবে লিখে ফেলব শীগ্রই।
সুরাইয়া পারভীন
বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে লেখা হৃদয় বিদারক ঘটনা উঠে এসেছে গল্পে। একমাত্র সচেতনতায় পরে এই মর্মান্তিক পরিস্থিতি থেকে মুক্ত রাখতে।
দালান জাহান
অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা
সাবিনা ইয়াসমিন
মায়ের কাছে সন্তানের লাশের গন্ধ পৌছায় না।
মা এর তুলনা শুধু মাটির সাথে দেয়া যায়। মাটি যেমন করে সব কিছু নিজের উপর বহন করে, তেমনি মা।
করোনা এসে মানুষকে বাস্তবতা শিখিয়েছে। করোনা অনেক মানুষকে অমানুষ বানিয়েছে।
সমসাময়িক ঘটনার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে গল্পে।
আরও লিখুন, শুভ কামনা 🌹🌹
দালান জাহান
বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত হয়েছে আপনার কথায়। আসলে আমি যা বলতে চেয়েছি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
হালিমা আক্তার
বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে হৃদয় বিদারক ঘটনা। সন্তান মাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু মা কখনো সন্তানকে ফেলে দিতে পারে না। আল্লাহ সকলকে এই অতিমারি করোনা থেকে রক্ষা করুন। শুভ কামনা অবিরাম।
দালান জাহান
ধন্যবাদ আপু। ভালো থাকুন সবসময়
নার্গিস রশিদ
বর্তমান ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লেখা এই গল্পটা খুব সুন্দর হয়েছে। আশা করবো এই করোনার উপরে আরও গল্প আপনার কাছ থেকে। ভালো থকবেন ।
দালান জাহান
শ্রদ্ধা সহ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আপু। আমি অবশ্যই চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ