মিনুর প্রথম পরীক্ষার দিনেই ব্যাপারটা এমন হবে কল্পনাতেই ছিল না। ড্রাইভার ফোন দিয়ে বলল গাড়ি নষ্ট, গ্যারেজে দিয়েছে। আকরাম সাহেব খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। ভেবেছিলেন মেয়েকে পরীক্ষার হলে দিয়ে তারপর অফিসে যাবেন। এখন বাজে সকাল পৌনে নয়টা। দশটায় পরীক্ষা। আকরাম সাহেব সরকারী কর্মকর্তা। অফিসে যাতায়াতের জন্য তিনি গাড়ি যতটা না ব্যবহার করেন, তার চেয়ে বেশী ব্যবহৃত হয় তার পরিবারের ক্ষেত্রে। মেয়েকে কোচিং এ আনা নেয়া, স্ত্রীর শপিং এর কাজে, ছোট ছেলেটাকে স্কুলে আনা নেয়া আরও কত কি। গাড়ি না আসার কথা শুনে তড়িঘড়ি করে নাস্তা সেরে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন আকরাম সাহেব।
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রিকশার অপেক্ষায় আছেন তারা। মেজাজটা বেশ খিটখিটে হয়ে আছে আকরাম সাহেবের। রিকশার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। হাতে সময়ও বেশী নেই। দু একটি রিকশা যা পাওয়া যাচ্ছে তার কোনটিই ঐদিকটায় যেতে চাইছে না। ইদানিং রিকশাওয়ালাদের শরীরে বেশ তেল জমে গেছে। রাস্তায় জ্যাম থাকলে হয় ভাড়া বেশী চাইবে অথবা যেতেই চাইবে না। আরও কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কে জানে! কিছুক্ষণ পর বেল বাজাতে বাজাতে রিকশা সমেত এক রিকশাওয়ালা তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো।
-“স্যার কই যাইবেন?”
-“সিটি কলেজ যাবো। যাবে?”
-“যামু। উঠেন”।
ভাড়া নিয়ে কোনও বাকচিত না করে বাবা মেয়ে রিকশায় উঠে বসলেন। যাক একটা রিকশা তো পাওয়া গেলো। ভাড়া যা চায় তাই না হয় দেয়া যাবে। রিকশায় উঠেই আকরাম সাহেব বিভিন্ন উপদেশমূলক জ্ঞান দিতে থাকলেন মেয়েকে।
-“প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে প্রথমেই প্রশ্নগুলো ভালমতো পড়বি। যেটা খুব ভাল পারিস সেটা আগে দিবি। লেখায় বেশী কাটাকাটি করবি না। অপ্রাসঙ্গিক কিছু লিখবি না। কি বললাম বুঝতে পেরেছিস?”
-“বাবা এগুলো তো কমন কথা বললে। আচ্ছা যা যা বললে সব মেনে চলবো”।
-“আর শোন, পরীক্ষা শেষে পুরো খাতাটা রিভিশন দিবি। ভুল হলে সংশোধন করবি”।
-“আচ্ছা বাবা করবো। চিন্তা করোনা”।
-“চিন্তা তো করতেই হয় আমাকে। সারাদিন মোবাইল নিয়ে বসে থাকিস। পরীক্ষায় কি যে করবি কে জানে! রেজাল্ট খারাপ হলে কোনও রিকশাওয়ালার ছেলের সাথে তোকে বিয়ে দিয়ে দিব। মনে রাখিস কথাটা”।
রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুড়িয়ে কয়েকবার পেছনদের দিকে তাকাল। বাবা মেয়ের কথা শুনে মনে হয় বেশ আনন্দ পাচ্ছে। অবশেষে রিকশা চলে এলো সিটি কলেজের সামনে। বাবা মেয়ে রিকশা থেকে নামলেন। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রিকশাওয়ালাকে বিদায় দিলেন।
মাস তিনেক পরের ঘটনা। আকরাম সাহেব অফিস থেকে বের হয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছেন। আজ গাড়ি নেই। ড্রাইভার গেছে ছুটিতে। তবে বেশীক্ষণ তার দাঁড়িয়ে থাকতে হল না। রিকশা পেয়ে গেলেন। ভাড়ার চুক্তি পর্ব সেরে উঠে বসলেন রিকশায়। রিকশা চলছে ধীর গতিতে। আকরাম সাহেব অদিক অদিক তাকাতে তাকাতে যাচ্ছেন। সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বাসার দিকে যাচ্ছেন। হঠাৎ রিকশাওয়ালা পেছনে ঘুরে একবার জিজ্ঞাসা করলো-
-“স্যার আপনার মেয়ের যে পরীক্ষা হইল, ঐডার খবর কি?” প্রশ্নটা করেই আবার সামনে দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
-“কোন পরীক্ষা?”
-“ঐযে আমি আপনেগোরে একদিন সিটি কলেজে নামাইয়া দিলাম। ঐদিন পরীক্ষা আছিল”।
আকরাম সাহেবের সেদিনের কথা মনে পড়লো। রিকশাওয়ালার স্মরণশক্তি দেখে বেশ অবাকও হলেন। তিন মাস আগের ঘটনা রিকশাওয়ালা আজও মনে রেখেছে। কিন্তু রিকশাওয়ালার অবয়ব তার মনে পরছে না।
-“ও আচ্ছা তুমি আমার মেয়ের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার কথা জিজ্ঞাসা করেছো? নাহ রেজাল্ট ভাল হয়নি। সামনের বছর আবারও দিতে হবে”।
-“তাহলে তো স্যার ব্যাপারটা আপনের লিগা খুব কষ্টের”।
আকরাম সাহেব কোনও কথা না বলে চুপ করে রইলেন। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
বাসার সামনে রিকশা এসে দাঁড়ালো। আকরাম সাহেব রিকশা থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করলেন।
-“স্যার একটা প্রস্তাব আছিল”। আকরাম সাহেব রিকশাওয়ালার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন।
-“কি প্রস্তাব?”
-“স্যার আমার একমাত্র পোলা এইবার বুয়েট থিকা পাস কইরা বাইর হইসে। একটাই পোলা আমার। অনেক কষ্ট কইরা পালছি। জীবনে কুনু সময় ফেইল করে নাই। ওর লিগা দোয়া কইরেন। আর আপনের মাইয়ার লগে আমার পোলার বিয়া দিবেন?”
রিকশাওয়ালার এমন প্রস্তাব শুনে আকরাম সাহেব আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলেন। বলে কি রিকশাওয়ালাটা! বেশ বিরক্ত এবং রাগ হলেন তিনি। কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। রাগকে সামলে নিয়ে বললেন-
-“তোমার সাহস কি করে হয় এই ধরণের প্রস্তাব দেবার? পাগল নাকি তুমি?”
-“না স্যার, আমি পাগল না। আপনিই তো সেইদিন আপনের মাইয়ারে কইলেন, পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হইলে রিকশাওয়ালার পোলার কাছে মাইয়া বিয়া দিবেন। আমার পোলা তো খুব ভাল। চাকরীও করতাসে। তাই আমি বাপ হইয়া প্রস্তাব দিলাম। আমার পোলায় আমার কথার অবাধ্য হইব না”। রিকশাওয়ালার মুখে আনন্দের হাসি।
আকরাম সাহেব এবার রাগে দাঁত কিটমিট করতে থাকলেন। আর কোনও কথা না বাড়িয়ে সোজা বাড়ির গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। রিকশাওয়ালা ভাড়ার টাকাটা পকেটে গুজে একটা মুচকি হাসি হাসল। অতঃপর রিকশা নিয়ে স্থান ত্যাগ করলো।
…… Rumon Ashraf
১০টি মন্তব্য
সুরাইয়া পারভিন
হা হা হা ,,, চমৎকার লিখেছেন। বুয়েট থেকে পাস করা কর্মরত ছেলের সাথে এইচএসসি ফেল মেয়ের বিয়ে দিতে চাইলো ,,,আর তিনি কি না রেগে মেগে একসার,,,হা হা হা
রুমন আশরাফ
হা হা হা। ধন্যবাদ পারভিন আপু।
জিসান শা ইকরাম
হা হা হা দারুন,
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটি রম্য,
কিন্তু উন্নত দেশে এটি রম্য নয়। সেখানে সব কাজকেই মুল্যায়ন করা হয়।
ভাল লেগেছে রম্য।
রুমন আশরাফ
ধন্যবাদ জিসান ভাই
মোহাম্মদ দিদার
বেশ ভালো লাগলো
রুমন আশরাফ
ধন্যবাদ দিদার ভাই
মনির হোসেন মমি
চমৎকার উপস্থাপনা। কখনো কখনো এমন বিকট পরিস্তিতিতে পড়তে হয়ে।
রুমন আশরাফ
অনেক ধন্যবাদ মনির ভাই
এস.জেড বাবু
অফার টা মন্দ ছিলো না,
দু বেয়াইয়ের অসমতা- সুন্দর প্রস্তাব নাম-মঞ্জুর হলো।
সুন্দর উপস্থাপন, ভালো লাগলো।
রুমন আশরাফ
ধন্যবাদ বাবু ভাই