চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল, বাঁশঝারের ছায়াকেও আর ভরসা করা যায় না। তারাও কেমন যেন বৈরি আচরণ করছে। আমার ক্লাস সিক্সে পড়া বান্ধবীরা বলল,” চল আমরা মেঘ নামামু”। আমি বললাম,”সর্বনাশ, আমারে বাড়ি হতে বাইর হইতে দিব না—”। বান্ধবীরা কইল,” তুই তোগো বড়লোকী নিয়া থাক, আমরা মেঘ নামামু আর মজা করমু”। আমি মাকে, বড় ভাইকে রাজী করালাম।
দুই দিন পরে উদাস কাঁঠফাটা দুপুরে সবাই আমাদের পুকুর পাড়ে একত্রিত হলাম। আমাদের সাথে ছোটবড় মেয়েরাও যোগ দিল। সকলেই একটা করে কুলা নিলাম, দুইজন দুটো বড় কাঠা নিল চাল, ডাল ইত্যাদি সংগ্রহের জন্য। আমরা সবাই সাদার সাথে লাল পারওয়ালা শাড়ী পরলাম। পায়ে আলতা — হাতে কাঁচের লাল চুড়ি। তারপর দল বেঁধে চললাম —-। প্রতিটি বাড়ির কিষাণ কিষানীসহ অন্যান্য সদস্যরা কি খুশি। মনে মনে যেন তারা আমাদেরই খোঁজ করছিলেন। আমরা প্রতিটি বাড়ি যেয়েই গোল হয়ে মাথায় কূলা নিয়ে ঘুরে এক জায়গায় দাড়াতাম। তারপর গান শুরু করতাম—
”আল্লাহ মেঘ দে পানি দে
ছায়া দেরে তুই
আল্লাহ মেঘ দে।
আসমান হইল টুডা টুডা
জমিন হইল ফাডা
মেঘ রাজা ঘুমাইয়া রইছে
মেঘ দিব তোর কেডা
আল্লাহ মেঘ দে।
আলের গরু বাইন্দা
গেরস্থ মরে কাইন্দা,
ঘরের রমনী কান্দে
ডাল খিচুরী রাইন্দা
আল্লাহ মেঘ দে —।
প্রতিটি বাড়ির সকলেই কূলার উপরে পানি ঢেলে দিত। সেই সাথে চাল, ডাল ইত্যাদি দিত। এভাবে তিন দিনে আমরা এলাকা/গ্রাম কভার দিলাম। তিন দিন পর — আমরা বাঁশ ঝাড় হতে অনেক কষ্ট করে খুঁজে দুটো ব্যাঙ ধরলাম। তারপর ব্যাঙ এর গাঁয়ে হলুদ দিল গ্রামের বৌঝিরা। তারপর সেই ব্যাঙকে গোসুল করানো হলো। ওমা ব্যাঙটা ভারী বেয়াদব–খালি লাফালাফি করে—তারপর বিয়ে পড়ানো হলো— বিয়ে পড়ালো ৭ বছরের ছেলে আরিফ !!!! ও বললো,” এই ব্যাঙ কবুল কও”। ব্যাঙ কবুল কয় না– শুধুই লাফাতে থাকে — আরিফ বলে ব্যাঙ কথা কয় না, খালি লাফ দেয়—- গ্রামের বৌগণ বললো ওতেই হইব—-। আমরা সবাই মিলে আনন্দ করতে করতে দুটো ব্যাঙকে বাঁশ ঝারে ছেড়ে দিলাম। তারপর আমাদের বাড়ির সাথে লাগোয়া জমিতে খিঁচুরি রান্না করলাম। গ্রামের ছোট ছেলেরা কলাপাতা কেটে ছোট টুকরা করে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখলো। অনেকে বলছে– ইস ! কলাপাতায় খিুচুরী খামু– আমাকে একটু বেশিই দিতে হইব—। আকাশে তখন মেঘের ঘনঘটা। আমাদের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক — মেঘ ভাসছে আকাশে—-, রোদের তাপ নেই, বাতাসটা ঠান্ডা হয়ে গায়ে লাগছে। সেকি শান্তি !!! আমরা ভাবলাম— এই রান্না গ্রামের সবাইকে একটু একটু করে খাওয়াব। রান্না করেই পুকুরে সকলেই নামলাম। সেকি ডুব সাঁতার আর ঝাপ দেয়া। মেঘ নেমে এল বৃষ্টি হয়ে। তুমুল বৃষ্টি!! আমরা সবাই মিলে রান্না করা খাবারের কাছে গেলাম। ইস! সব বৃষ্টির পানিতে একাকার হয়ে গিয়েছে। সবাই মিলে জোরে জোরে চিৎকার করে কান্না করতে লাগলাম। আমাদের কান্না দেখে ভাই বলল,’ তোমরা যদি কান্না কর তাহলে আবার বৃষ্টি শুকিয়ে রোদ হয়ে যাবে, আর কোন দিনই বৃষ্টি নেমে আসবে না এই গ্রামে”। আমরা কান্না থামালাম। আশেপাশের বউঝিরা এসে বলল,” মেঘ আইছে এইডাই বড় কতা, খাওন দাওন বড় কতা নারে মাইয়ারা’। কিন্তু এত কষ্ট কইরা সবাই মিলা রান্না করলাম !!!! আমার গ্রামের এক বড় বোন বলল,” ভালই হইছে । খিচুরীতে নুন দিতে ভুইল্যা গেছিলাম ———-। আমার চোখ কপালে উঠল –বললাম,” তাইলেতো ভালই অইছে —-আর এইড্যাও কইলাম— আর কোন দিনই মেঘ নামামু না——–”। ভাই বলল,” তোমাদের কথায় বৃষ্টি নামে না— বৃষ্টি নামে তার আপন গতিতে— এখানেই প্রকৃতির লীলাখেলা !!!—-ভূগোল বইটা তোমরা ভাল করে পড়বে—–”। এখানেও আবার ভাইয়ের পড়া পড়া— আমি বাড়ির দিকে হাটা শুরু করলাম । কিন্তু বার বার ঐ কষ্ট করে রান্না করা খাবারের দিকে তাকাচ্ছিলাম । তখন আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে গাছের ডালে, টিনের চালে, রাস্তাঘাটে। পুকুরের পানি বৃষ্টির পানি সাথে যেন লুকোচুরি খেলছে অনেক দিন পরে— আমার সব কষ্টগুলো যেন গলে বৃষ্টির পানির সাথে একাকার হয়ে গেল।
লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৯ মার্চ,২০১৪
২২টি মন্তব্য
নীহারিকা
বৃষ্টি নামানোর গল্পটা মজা লেগেছে। ইস এমন করলে সত্যি যদি বৃষ্টি নামানো যেত!!
স্বপ্ন নীলা
ছোটবেলায় মনে হতো এমনটা করলেই হয়তো বৃষ্টি নেমে আসবে পৃথিবীতে —— আসলে তো নয় ———–গল্পটা ভাল লাগার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ
লীলাবতী
ভালো লিখেছেন আপু -{@ (y)
স্বপ্ন নীলা
অনেক অনেক ধন্যবাদ লীলাবতী । ভাল থাকবেন সব সময়
স্বপ্ন
নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসলো আপু। আপনি নিয়মিত হয়ে এত সুন্দর পোস্ট পড়ার সুযোগ দিন 🙂
স্বপ্ন নীলা
হুমমম — ছোটবেলার কত স্মৃতি !! এখন মনে হয় আমাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মেকি মেকি সবের মধ্যে বড় হচ্ছে ——- এখনকার ছোটদের জন্য ভীষণ খারাপ লাগে
ছাইরাছ হেলাল
বৃষ্টি নামানোর এই পদ্ধতি জানলাম ।
আর কল্পনায় পুকুরের পানির সাথে বৃষ্টির পানি লুকোচুরি খেলা দেখার চেষ্টা করলাম।
এত্ত দিন পর লিখলেন ?
স্বপ্ন নীলা
আসলে সময়ের অভাবে লিখতে পারি না।
মাঝে মাঝে মনে পড়ে কত কথা — ইস আবারও যদি ছোট বেলায় ফিরে যেতে পারতাম
শুভকামনা সব সময়ের জন্য
প্রহেলিকা
এই পদ্ধতি কি তাহলে আপনারা বেড় করেছেন ??? মারাত্মক তো। তবে লিখা পরে খানিকের জন্য শৈশবে বিচরণ করলাম। অনেক ভালো লাগলো লিখাটি শ্রদ্ধেয়া। সালাম ও শুভেচ্ছা জানবেন। -{@
স্বপ্ন নীলা
প্রহেলিকি — এটা আমাদের এলাকার একটা রীতি । কবে থেকে এটার নিয়ম চালু হয়েছে তা জানা নেই। তবে দেখেছি— এবং নিজেরাই করেছি —-।
অনেক অনেক শুভকামনা
জিসান শা ইকরাম
ছোট বেলার কথা মনে পরে গেলো। সুন্দর
ভাবে উপস্থাপন করেছেন।
স্বপ্ন নীলা
ছোট বেলার কত ছোট খাট কথা স্মৃতির পাতায় রয়ে গেছে। মাঝে নিজেই পড়ি—-ভাল লাগায় মনটা ভরে যায় ভাইয়া———–ভাল থাকবেন নিরন্তর
হতভাগ্য কবি
চমৎকার, স্মৃতিময় আবেগী লিখা, পড়ে খুবই ভালো লাগলো, আরো লিখুন, শুভ কামনা।
স্বপ্ন নীলা
পোস্টটি ভাল লাগার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
নিরন্তর শুভকামনা
হতভাগ্য কবি
😀
স্বপ্ন নীলা
হুমমম — ছোটবেলার স্মৃতি বলে কথা ——–
এক রাশ শুভকামনা
বনলতা সেন
এখন আবার হলে আমাকে জানাতে ভুলবেন না ।
ফিরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে ।
স্বপ্ন নীলা
হুমম—- আবার সেই ছেলেবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে—-কত আনন্দের দিনগুলো———–
নীলাঞ্জনা নীলা
অসাধারন উপাস্থপনা। বৃস্টি নামাবার প্রস্তুতি জেনে চমকিত।
মিস করি ছোটবেলা।
আপনিও নীলা 🙂
স্বপ্ন নীলা
পোস্টটি ভাল লেগেছে জেনে আমার ভাল লাগলো
হুমমম—— আমিও নীলা
শুভকামনা সব সময়
প্রত্যাবর্তন
বৃষ্টি নামানোর অদ্ভূত পদ্ধতি তো !!
স্বপ্ন নীলা
হুমম ছোট বেলায় আমরা মনে করতাম যে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করলে বৃষ্টি আসে — ছোট বেলায় আমরা কত কি করতাম ——–
শুভকামনা রইল