মালিটোলার নাদের।

নাদের ছিল গুন্ডা, পুরান ঢাকার গুন্ডা। আজকের দিনের ছ্যাচরা মাস্তান না। নাদের গুন্ডা দেখিয়েছিল এই দেশের জননীরা কাপুরুষ জন্ম দেয়না, জন্ম দেয় নাদেরের মতো দুঃসাহসী বীর।

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের আতঙ্ক নাদেরের অসীম বীরত্বগাথা আজ খুব কম লোকেরই জানা। বংশালের বয়োবৃদ্ধ প্রাচীন লোকেরও ভাসা ভাসা মনে করতে পারেন সেই সময়ের কাহীনি। সুসজ্জিত পাকিস্তানী আর্মি ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে শহীদ নাদেরর অসম লড়াইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন দুলু গুন্ডা (চিত্র নায়ক ফারুক )।২৫ মার্চের রাতে পাকি জানোয়ার বাহিনী যখন ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙ্গালীর ওপর হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে তখন ঢাকার মানুষের পালাবার রাস্তাও ছিলনা।

কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল নাদের। চারিদিকে গুলি, কামান আর মর্টারের গোলাগুলিতে নাদের বুঝতে পারে কি ঘটছে সাথে সাথে সে নিজের মতো করে তৈরি হয়ে যায়। পাকি আর্মির কনভয় বংশালে ঢোকার সাথে সাথে নাদের একটি দেশী বন্দুক নিয়ে ছাদ টপকে টপকে ঈসা ব্রাদার্সের ছাদে গিয়ে পজিশন নয়। বন্দুকের রেঞ্জের মধ্যে আসার সাথে সাথেই নাদেরের গুলিতে লুটিয়ে পড়ে কয়েকজন পাক আর্মি। অবিশ্বাস্য এই আক্রমনে পাক আর্মি ততক্ষনাত ফিরে যায়। নাদেরর আক্রমনে হায়েনার মতো ক্ষিপ্ত পাকি আর্মিরা শক্তি সঞ্চয় করে ঝাপিয়ে পড়ে বংশাল, নয়াবাজার, আবুল হাসানাত রোড, কাজী আলাউদ্দিন রোডের বিভিন্ন বাড়িতে।

প্রথম দিকে তাদের টার্গেট শুধু হিন্দু বাড়ির প্রতি হলেও প্রতিরোধের সম্মুখীন হওয়ায় তারা নির্বিচারে বাড়ি ঘরে আগুন দিতে থাকে। সে যাত্রা নাদের পালিয়ে গেলেও পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বন্ধু বান্ধব আত্নীয় স্বজনের সহায়তায় তার গেরিলা অপারেশন অব্যাহত রাখে। নাদেরর অস্ত্রের যোগানদাতা ছিলা সংগ্রাম নামে এক পাঞ্জাবী। অর্থের বিনিময়ে এসব অস্ত্র সংগ্রহ করে দিত।

ইতোমধ্যে শান্তিকমিটির দালালরা সংঘটিত হওয়ায় এলাকায় ঘোরাফেরা সমস্যা হয়ে দাড়ায়। মে মাসের শেষের দিকে আরমানীটোলায় পাকিস্তানী দালালদের প্রধান খাজা খায়েরউদ্দিনের সভায় আক্রমনেরর প্রস্তুতি নেয় নাদেরর দল। এই সভায় আক্রমনের জন্য দরকার অনেক অস্ত্র। সংগ্রাম অস্ত্র সাপ্লাইয়ের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং সেমতে নাদের তার বাহীনি নিয়ে আর্মেনীয় চার্চে অবস্থান নেয়। যথাসময়ে সংগ্রাম হাজির হয় অস্ত্রের চালান নিয়ে । কিন্তু নাদেরের ওয়াচ গার্ডরা দেখতে পেল অস্ত্র নিয়ে আসছে সংগ্রামের লোকজন নয়, পাক আর্মিরা। সাথে সাথে নাদের সংগ্রামকে গুলি করে মেরে ফেলে।
ততক্ষনে পাক আর্মীরা চারিদিক দিয়ে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। নাদের তার বাহীনী নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। নাদের-হারুণ দুই সহোদর এবং বন্ধু সোহরাব পাক আর্মীর ওপর গুলি চালিয়ে বাকীদের কভার দেয়। একপর্যায়ে হারুণ ও সোহরাবকে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখে নাদের সড়ে পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু দেয়াল টপকানো অবস্থাতেই পায়ে গুলিবিদ্ধ হয় সে। আহত নাদের আশ্রয় নেন বেচারাম দেউড়ির বস্তিতে।

চারিদিকে চিরুনী অভিযান করতে করতে পাক আর্মিরা বস্তিতে হাজির হয়। বস্তির লোকজন জানের ভয়ে আহত নাদেরকে ধরিয়ে দেয়। নাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। পাক আর্মির বর্বর নির্যাতনের মুখেও নাদের নিজের ও সহযোগীদের পরিচয়ের বিষয়ে মুখ খোলেনি। তারপরই বংশালের আরেক রংবাজ শান্তি বাহিনীতে যোগ দেয়া খুনি গেদা গুন্ডাকে নেয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে গেদা সনাক্ত করে নাদেরকে। সেনারা উল্লসিত হয়, পৈশাচিকভাবে গেদার সামনেই হত্যা করে নাদেরকে যার বিবরণ পুরা বংশাল জুড়ে প্রচার করে গেদা। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে পুরানো ঢাকার পাকি আর্মি ও রাজাকারদের আতঙ্ক নাদেরের।

জগতজ্যোতি দাস

সহযোদ্ধাদের রক্ষার জন্য একাকী লড়ে প্রাণ দিয়ে যাওয়া বাংলা মায়ের আরেক সূর্য সন্তান, ভাটির মাহানায়ক শ্যামা ।

যার শাহাদাৎ বরনের পর স্বাধীন বাংলা বেতারে ঘোষিত হয়েছিল তাকে দেয়া হবে সর্বোচ্চ খেতাব। কিন্ত ভাটির মহানায়ক শ্যামাকে আজোও দেয়া হয়নি সেই সর্বোচ্চ খেতাব। আইনের ম্যার প্যাচে সরকার ঘোষিত বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি শুধু ঘোষনাই রয়ে গেল। হবিগঞ্জের আজমীরিগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামে এক অখ্যাত নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম দুঃসাহসী এই মুক্তিযোদ্ধার।
ভাল নাম জগতজ্যোতি দাস।
ডাক নাম শ্যামা।

১৬ নভেম্বর ভোরে ঘুঙ্গিয়ারগাঁও থানা [বর্তমানে শাল্লা উপজেলা সদর] সদর আক্রমণের ত্রিমুখী যুদ্ধে শহীদ হন জগৎজ্যোতি দাস। পাক ক্যাম্প থেকে মাত্র ২০০ গজ দুরে রাজাকার/পাক সেনাদের আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে দাস পার্টি। রণাঙ্গণে পরিস্হিতির ভয়াবহতা চিন্তা করে এক পর্যায়ে জ্যোতি তার দলকে বাচানোর জন্য রিট্রিট করার নির্দেশ দিয়ে একটি মাত্র এলএমজি নিয়ে নিজে কাভারিং ফায়ার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন । এজন্য জ্যোতি সহযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী মমিনকে নির্দেশ দেন যাতে অন্যরা তাদের জীবন বাঁচিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যায় । এরপর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন মাত্র দুইজন, জ্যোতি ও ইলিয়াছ। তারা যুদ্ধ করতে থাকেন একটানা কিন্তু হঠাৎ ইলিছাস পাঁজরে গুলিবিদ্ধ হন। জ্যোতি পিছু না হটে তার মাথার লাল পাগড়ি খুলে শক্ত করে ইলিয়াসের বুকে‌ এবং পিঠে বেঁধে দেয়, যাতে তার রক্তক্ষরণ থেমে যায়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে জগতজ্যোতি দাস বিকেল ৩টায় নতুন ম্যাগাজিন লোড করে পজিশন নিয়ে শত্রুর অবস্থান দেখার জন্য মাথা উঁচু করতেই একটি বুলেট তার বুকে বিদ্ধ হয়। জগতজ্যোতি তখন ‘আমি আর নাই আমি গেলাম’ বলে কৈয়াবিলের পানিতে ডুবে যান।

পাকবাহিনীর সহযোগী রাজাকারেরা রাতে জ্যোতির লাশ খুজে পেয়ে পাকবাহিনীকে খবর দেয় এবং জ্যোতির মৃতদেহটি আজমিরীগঞ্জ বাজারে নিয়ে যায়। রাজাকাররা জ্যোতি হত্যার ঘটনা ছড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য জ্যোতির মৃত দেহ কে আজমিরীগঞ্জ গরুর হাটে একটি খুঁটির সঙ্গে ঝুলিয়ে পেরেক মেরে জনসমক্ষে রেখে দেয়। হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরা জ্যোতির নিথর দেহটি কোন সৎকার ছাড়া ঝুলে থাকে । এক সময় জ্যোতির দেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয় কুশিয়ারা নদীতে। দুঃখিনী বাংলা মায়ের বীর সন্তান মিশে যান তার মায়ের বুকে।

 

ফ্লাইং অফিসার ওয়ালীউল্লাহ
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের দাফন হয়েছিলো পাকিস্তান করাচির মাসরুর বেসের চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থানে। কবরের সামনে লেখা ছিলো- ‘ইধার শো রাহা হ্যায় এক গাদ্দার’। প্রায় ৩৫ বছর ওখানে ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান।

ফ্লাইট ল্যাফটেনেন্ট মতিউর রহমান শহীদ হবার আগে ভারতের সীমান্ত থেকে মাত্র তিন মিনিটের দূরত্বে ছিলেন। স্বাধীনতাও ছিল মতিউরের কাছ থেকে মাত্র তিন মিনিটের দূরত্বে।

এই ঘটনার পরে পাকিস্তানে অবস্থানরত, বিশেষ করে পাকিস্তানের বিমান বাহিনীতে কর্মরত বাঙালিদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। পাকিস্তানিরা বাঙালি অফিসার ও কর্মচারীদের দেখলে বিদ্রুপ এবং তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলতো। কেউ কেউ মুখ খিস্তি করেও গালি দিত। জাত গোলামরা প্রভুদের গালিগালাজে তেমন কিছু মনে করেনা, এমন কিছু বাঙালিও পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে ছিল। যদিও তাদের সংখ্যা ছিল খুবই কম।

এমন অবস্থায় পাকিস্তানের প্রতি একান্ত অনুগত বাঙালি অফিসার উইং কমান্ডার সাইদ আহমেদ বেগ পাকিস্তান বিমান বাহিনী প্রধানের বাণী নিয়ে উপস্থিত হল। করাচির ড্রিগরোড বিমানঘাঁটির সকল বাঙালি অফিসার এবং কর্মচারী একত্রিত করে দারুণ এক বক্তৃতা রাখলো। তার মূল প্রতিপাদ্য ছিল , ‘ভাইসব, আমাদের বাঙালিদের উচিত পাকিস্তান নামক রষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকা। মতিউর রহমানের মত বিশ্বাসঘাতকতা না করে পাকিস্তানের প্রতি যাদের আনুগত্য নেই তাদের উচিত হবে বিমানবাহিনী থেকে পদত্যাগ করা’ । পাকিস্তান-প্রেমিক উইং কমান্ডারের বক্তব্য শুনে বেশিরভাগ বাঙালি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের মনে যথেষ্ট বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলেও কেউ তা প্রকাশ করতে সাহসী হলেন না। সবাই চুপ করে রইলেন।

শুধুমাত্র এক জন ছিলেন এর ব্যতিক্রম।

সাইদ আহমেদের বক্তব্য শেষ হলে, হালকা পাতলা গড়নের চুপচাপ স্বভাবের মানুষ ফ্লাইং অফিসার ওয়ালীউল্লাহ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “Sir, I owe my allegiance to Bangladesh and not to Pakistan. I want to resign from my service.” পরের দিনই তিনি চাকুরি থেকে পদত্যাগ করলেন।

ফ্লাইং অফিসার ওয়ালীউল্লার সাহস দেখে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল। বর্তমান অবস্থায় চিন্তাও করা সম্ভব না যে, একাত্তর সালে পাকিস্তানে অবস্থান করে সমবেত জনতার সামনে কোনো বাঙালি অফিসার বলতে পারে, “I owe my allegiance to Bangladesh and not to Pakistan. ”

সামাদ বীর উত্তম?!!!

ক্রাক প্লাটুনের গেরিলাদের ধরিয়ে দেওয়া সামাদ বীর উত্তম উপাধি পায়, তার জবানবন্দিতে নির্মমভাবে মরতে হয়েছে ক্র্যাক প্লাটুন খ্যাত দেশের সেরা তরুণদের। রুমী ,আজাদ,আলতাফ মাহমুদদের… আম্মার ভাষ্য সামাদ মিলিটারির সঙ্গে গিয়ে সবার বাসা দেখিয়ে দিয়েছে… শিমুল ইউসুফের ভাষ্য – আলতাফ মাহমুদ কে সনাক্ত করে সামাদ, এবং উঠোনে পুতে রাখা অস্ত্রের ট্রাঙ্কও দেখিয়ে দেয়…… আর সামাদের ভাষ্য আমার পরিবার সন্তান…… যেন রূমী আজাদ আলতাফ মাহমুদদের পরিবার বাঃ সন্তান ছিলোনা,যেন নাক মুখ কেটে বিকৃত করে দেয়া সেলিনা পারভীনের সন্তান ছিলোনা পরিবার ছিলোনা… এই দেশে অনেক কিছুই হয়েছে……………

কিন্ত

শত্রুর ঘাঁটিতে বসে এমন অসীম সাহসী বাণী উচ্চারণকারী এ বীর ফ্লাইং অফিসার ওয়ালীউল্লাহ বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে কেবল উইং কমান্ডার পদ প্রাপ্ত হয়ে অবসর গ্রহন করেন। আর পাকিস্তানের প্রতি একান্ত অনুগত, পদলেহনকারী এবং বীর শ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে বিশ্বাসঘাতক বলে সম্বোধনকারী উইং কমান্ডার সাইদ আহমেদ বেগ বাংলাদেশে এসে বিমানবাহিনীতে গ্রুপ ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় উন্নিত হয়। তারপর বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণ সেক্রেটারির পদমর্যাদায় পৌছে অবসর গ্রহন করে।

আর প্রাণের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমিতে মাত্র সাড়ে তিনহাত জায়গা পেতে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের লাগে ৩৬ বছর।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম গেরিলা শহীদ নাদের কিন্তু তার ভাগ্যে বীরত্বের জন্য কোনো খেতাব জোটেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়ও তার নাম নেই। কোন বিজয় উৎসবে ধ্বনিত হয়না নাদেরর নাম।

এবং যুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও আকাশবাণী থেকে জগতজ্যোতিকে মরণোত্তর সর্বোচ্চ খেতাব ঘোষণা দিলেও পরে বীরউত্তম খেতাব দেওয়া হয়েছে।

এই সব বীরদের জন্যই আমাদের লাল সবুজের পবিত্র পতাকা আমাদের প্রিয় দেশ, বাংলাদেশ।

এই দেশ তাদেরই দান , এই সব অনুচ্চারিত অকুলীন বীরদের ভুলে যাবেন না, মনে রাখুন ইতিহাস মোছা যায়না , নতুন করে লেখা যায়না। শহীদ নাদের, জগতজ্যোতি, ফ্লাইং অফিসার ওয়ালীউল্লাহর মতো বীরদের আপনার প্রার্থনায় রাখুন। ভালোবাসায় রাখুন।

কৃতজ্ঞতা –

লাকী আখন্দ
দৈনিক সমকাল বিজয় দিবস সংখ্যা (২০১১)
একাত্তরের দিনগুলি

১জন ১জন
0 Shares

৪০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ