মাটি ও অপেক্ষা…

সীমান্ত উন্মাদ ১১ ডিসেম্বর ২০১৫, শুক্রবার, ০১:১৩:৪০পূর্বাহ্ন এদেশ ১৬ মন্তব্য

সিরিজ না হয়ে স্বাধীনতার মাসে না হয় অন্য কিছুই হোকঃ

সূর্যের তেজে পড়েছে বয়সের ছাপ, বৈকালি আকাশের গায়ে। চারিদিকে একটা মন খারাপ করা আলো ছায়ার খেলা চলছে। ঠিক এমনি সময় একদল মানুষের কাফেলা ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে নিঝুম পুরের শত বর্ষী এক কবরস্থানে। আর ভেতর থেকে ভেসে আসছে, দুই গোর খোদক যুবকের মাটিকাটার আওয়াজ, যেন অবারিত ডাকছে শিতল দেহ আলিঙ্গনের আহ্বানে। ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, এগিয়ে আসছে মানুষগুলো লা ইলাহা ধ্বনিতে। এমনি সময় কবরস্থানের গেটের দিকে এগিয়ে গেল বয়সের ভারে নুয়ে পড়া আশিতিপর এক বৃদ্ধ, গেট খুলে দিতে। গোর খুড়তে থাকা যুবক দুজন তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো গেটের দিকে, বৃদ্ধ দুর্বলহাতে গেট খুলছেন, তা দেখে তারা হেঁসে গড়িয়ে পড়ছে, হঠাৎ এক যুবক বলে উঠল টিটকিরির ছলে, দেখ দেখ আইজ বুইড়া কেমন জানি ডরে মইরা যাইতাছে, তখন দ্বিতীয় যুবক হাঁসি আরো চওড়া করে বলে উঠলঃ বুইড়া হয়ত ভাবতাছে, আমার টাইম কি হইয়া গেছে কবরে যাওনের। হাঁ বৃদ্ধ রইস মোল্লা আজ ভীত, আতঙ্কিত কিন্তু সে ভয় আর আতঙ্ক মৃত্যুর নয়, তিনি ভীত ভিন্ন একটি কারনে। বৃদ্ধ ভাবছেন আজ আরো এক যোগ হল! আমাকে…! বৃদ্ধ ভাবছেন, ঠিক ঐ মুহূর্তে কবরস্থানের গেইটে চলে আসলো লাশ বহনকারী মানুষগুলো, বৃদ্ধ গেইটটি খুলে দিলেন,স্বাগত জানালেন লাশ হয়ে আসা জমির উদ্দিনকে, যার সাথে তার কয়েক দশক আগে এক গভীর একি সাথে গর্বের একটা সম্পর্ক ছিল! যে অদৃশ্য সম্পর্কের সুতো আজো ছিঁড়ে যায়নি! এ যে অনন্তকালের। হঠাৎ করে গেট খুলে দেওয়ার ডাকে, বুড়ো রইস মোল্লা কাঁপা হাতে কবরস্থানের গেইটটি পুরুপুরি খুলে দিলেন। লাই লাহা ধ্বনি উচ্চারন করতে করতে লাশবাহী কাফেলা এগিয়ে গেল সদ্য খোঁড়া কবরের পাশে দাফন সম্পূর্ণ করতে। এদিকে রইসের আতঙ্ক বাড়ছে যেন আজ আরো বৃদ্ধ দেখাচ্ছে তাকে। জমির উদ্দীনের লাশ দাফন শেষে ফিরে যাচ্ছেন তার স্বজনদের কাফেলা নিরব কান্নার রোল নিয়ে আর গোর খোদক দুই যুবক স্বাধীন ও মির বৃদ্ধের কাছে ফিরে এসে বলল, কাম শেষ করছি আমরা বাইরে যামু সেনেমা দেখতে, তুমি বইসা থাকো তোমার গাছ তলার আসনে, এই বলেই তারা হাসতে হাসতে চলে গেল।

রাত বাড়ছে, অন্ধকার গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে, বুড়োর ভাবনার জগতের তার হঠাৎ করে গেল এক অতি পরিচিত ডাকে। এই রইস, এই, এদিকে আয়। বুড়ো সদ্য কবর দেওয়া জমির উদ্দীনের কবরের দিকে তাকালেন, চোখ বড় বড় করে। বসে থাকার আপ্রান চেষ্টা করে চলেছেন, কিন্তু পারলেন না, কে যেন টানছে তাকে সদ্য দেওয়া কবরের দিকে। নিজের অজান্তেই তিনি এগিয়ে গেলেন সেদিকে, কেমন যেন একটা আড়ষ্ঠ ভাব নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন জমির উদ্দিনের কবরের পাশে, আচমকা তিনি দেখলেন তার চারপাশের কবর থেকে উঠে আসছেন তার পরিচিত অবয়বের মানুষ। সেই সাথে উঠে এলেন সদ্য মৃত জমির উদ্দীনও। বাকিরা ঘিরে ধরেছে বৃদ্ধ গোর রক্ষী রইসকে। ছায়াগুলো নড়ে উঠল আর হঠাৎ বৃদ্ধ চিৎকারে করে উঠে বলছে, না আমারে ছাইড়া দাও, আমি পারুম না, আমি পারুম না, আমারে ছাইড়া দাও, বলছে আর শিউরে উঠছে, যেন চাবুক মারছে তার পিঠে।এদিকে জদ্দিন বলছে ঐ তোরা ওরে মারিস কেন? সবাই তখন জমিরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো তোরেও শাস্তি দেওয়া দরকার শেষ প্রতিশোধ না নিয়া মইরা গেলি কেন? আমাগোরে তো একাত্তরেই মাইরা ফালাইছে! এখনো বাইচ্চা আছে রইস ও কিছু করে না কেন? এই বলেই আবার রইসের দিকে তাকালো সবাই আর রইস আগের মতই শিৎকার দিয়ে উঠতে লাগলো, বলতে লাগলো আমি পারুম না, আমার এই ক্ষমতা নেই। বৃদ্ধ রইসের চিৎকারের সাথে তারা চিৎকার করে বলতে লাগলো তোড়া যোদ্ধা তোড়া এখনও বাইচ্চা থাকতে রাজাকারগো গাড়িতে আমাগো পতাকা কেন? বৃদ্ধ রইসের চিৎকার চলছে আগের মতোইঃ আমি পারুম না, আমার ক্ষমতা নাই, ক্ষমতা নাই!

ঠিক এমনি সময় কবরস্থানের গেইট খুলে গেল, ভীতরে প্রবেশ করলো দুই যুবক গোর খোদক স্বাধীন এবং মীর। আর সাথে সাথে বৃদ্ধ লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। বিড় করে বলেই চলেছেনঃ না মাই পারুম না, আমি পারুম না, দৌড়ে এলো দুই যুবক বৃদ্ধের কাছে, এসেই অট্ট হাসিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো, বলতে লাগলো কি বুইড়া কবরে হান্দানের চেষ্টা করতাছোনি তুমি, মেলা রাইত হইছে যাও শুইতে যাও।

কবস্থানে এখন ভোর, ধীরে ধীরে আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। দুই যুবক উঠে চলে গেছে কিন্তু বৃদ্ধ এখনও গভীর ঘুমে অচেতন, ভোর থেকে সকাল গড়িয়ে প্রায় দূপুর হতে চলল। দুই যুবক এসে ডাক দিল বৃদ্ধকেঃ কি বুইড়া উঠো না কেন? মির বলল কিরে স্বাধীন তোর মায়ের পেয়ারের বুইড়া মইরা গেল নাকি? স্বাধীন রেগে গিয়ে বললো কি কইলি তুই হারামজাদা? তাদের চিৎকারে জেগে উঠল আশিতিপর বৃদ্ধ রইস উদ্দিন। উঠে বলল যা তোরা আমার সামনে থেইকা, বাক বিতণ্ডা চলছে এমনি সময় প্রবেশ করলো এক মায়াময়ী মহিলা। ভাতের থালা হাতে। তাকে দেখে স্বাধীন বসে পড়লো এক পাশে জীর্ণ মাদুর বিছিয়ে। স্বাধীনের দিকে একবার তাকিয়ে প্রায় ছুঁড়ে দিলেন খাবারের থালা তার দিকে, মীরও বসে পড়লো তার খাবার নিয়ে। সেই মুহূর্তে গোসল সেরে এসে বসলেন বৃদ্ধ রইস উদ্দিন তার গাছের নিচে। আর মহিলা তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে বৃদ্ধের পাশে বসলেন, যত্ন করে বেড়ে দিলেন খাবার তার পাতে। বৃদ্ধ খাচ্ছেন আর মহিলা পরম মমতায় বাতাস করে চলছেন বৃদ্ধকে। এদিকে, মীর টিটকিরির স্বরে স্বাধীনের দিকে তাকিয়ে বললঃ দেখ দেখ তোড় মা কেমনে কইরা বুইড়ার দিকে তাকাই আছে আর বাতাস করতেছে! তোর মায়ের লগে এই বুইড়ার পিরিতি আছে আর তুই মনে অয় এই বুইড়ার ওরস থেইক্কা হইছস। এই কথাগুলো শুনে স্বাধীন আর সহ্য করতে না পেরে সে খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, দৌড়ে বৃদ্ধের খাবারের থালায় লাথি দিল আর মায়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো তোর এতো পিরিতি কিয়ের এই বুইড়ার লগে আইজ তোরে কইতেই হইবো, স্বাধীন চিৎকার দিচ্ছে ঠিক ঐ মুহূর্তে মা তার গালে ঠাস করে একটা চড় লাগালেন আর বলতে লাগলেনঃ হুনতে চাস, এই বুইড়ার লগে আমার কি? হুনতে চাস হারামজাদা! বৃদ্ধ রইস লাফ দিয়ে উঠে হাত চেপে ধরলেন মায়ের, বলতে লাগলেনঃ না তুই কইস না বইন, ওরে কিছু কইস না। এই শুধু আমি, তুই আর আমাগো খোদায় জানে, তুই কইস না, ও সইতে পারবো না। মা বলল না আমারে কইতে দাও ওর শুনতে হইবো, বৃদ্ধ না না উচ্চারন করতে করতে। মা বলতে লাগলেন স্বাধীনকে, শুন হারামজাদা আমাগো দেশ স্বাধীনের যুদ্ধের সময় রাজাকাররা আমারে ধইরা নিয়া গেছে পাক আর্মির ক্যাম্পে। দিনের পর দিন, রাইতের পর রাইত পাক হানাদাররা আমার উপর অত্যাচার করছে, দেশ স্বাধীন হবার দিন, এই বুইড়া, এই রইস উদ্দিন আমারে সেইখান থেইক্কা উদ্ধার করছে, আর সেই পাক হানাদারগো অত্যাচারের ফসল তুই আমার পেডে জন্ম নিছস। আমি জানিনা তোর বাপ কে বা কয়জন। আত্মহত্যা করতে চাইছিলাম, তখনও এই বুইড়া আমারে বাচাইছে, থাকনের যায়গা দিছে, খাওন দিছে তোরে লালন পালন কইরা ডাঙ্গর করনের লাইজ্ঞা আর তুই কস এই বুইড়ার লগে আমার কি, হারামজাদা!! এই বুইড়া আমার তোর নতুন জীবন দাতা। এই সব শুনে হতবম্ভ স্বাধীন চিৎকার করে উঠেঃ আমার কি দোষ? আমার কি অপরাধ? অসহায়ের মত কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে স্বাধীন।

কেমন একটা নিস্তব্দতা বিরাজ করছে দূপুর রোদের ঝিকিমিকিতে! যেন নিরব কান্না উজ্জলতা কেড়ে নিয়েছে তার। বৃদ্ধ চুপ, মা চুপ, শুধু স্বাধীনের গোঙ্গানি যেন ইতিহাসের সাক্ষী কিছু বেদনার পরশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে নিঝুমপুর কবস্থানের মাটি এবং তার অপেক্ষাতে।

 সবাইকে বিজয় দিবসের অগ্রীম শুভেচ্ছা।।

৬৯৮জন ৬৯৭জন
0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ