জোহরের নামাজের সময় যায় যায়। অফিস থেকে ফিরে ফরজ নামাজটুকু আদায় করেই মা বসে পরেন খাবার টেবিলে। ক্ষুদার্থ আমরা চারটি প্রাণী অপেক্ষায়। মা মৃদু ভৎসনা করেন, কেন না খেয়ে অপেক্ষায় থাকি প্রতি দুপুরে। অতঃপর পাঁচ সদস্যের পরিবারটি একসাথে দুপুরের খাবার খেতে খেতে হাসি গল্পে মেতে উঠে। অনেকদিন পর্যন্ত এটি একটি সুখী পরিবারের গল্প ছিল…
এভাবে আমরা বেড়ে উঠি। ভাইটি হোস্টেলে চলে যায়। মা অফিস থেকে ফেরার পথে প্রায়ই তাঁকে দেখে আসে। বাসায় ফিরে অঝোরে কাঁদে। একদিন ওর মুখটা শুকনো ছিল… কোনদিন ওর গায়ে টিচারের মারের দাগ দেখেছে… আবার কোনদিন ভাল রান্না হয়েছে, অথচ ও নেই…। এরপর আপা ভার্সিটিতে যায়। অনেকদিন পর পর ছুটিতে আসে। উচ্ছ্বসিত মা এটা সেটা ভাল মন্দ রান্না করে। বাসায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। একদিন ছুটি শেষে আপা ফিরে যায়। ভোর থেকেই মা এটা সেটা গুছিয়ে দেয়। দিতেই থাকে, যেন পৃথিবী শুদ্ধ দিয়ে দিলেও এ দেয়া শেষ হবার নয়। ওকে বিদায় দিয়ে বুকে বালিশ চেপে পাঁজর ভাঙ্গা কান্না। ক’দিন গুমোট নিস্তব্দতায় থাকে বাড়িটির আনাচ কানাচ।
সবশেষে আমিও ছেড়ে যাই আমার শহর। সেই কাক ডাকা ভোর থেকেই মা ব্যস্ত। টেবিলে নাস্তা সাজায়। ঘুম থেকে ডেকে তোলে। ব্যাগ গুছিয়ে দেয়। আমি বলি, এটা লাগবে না, ওটা লাগবে না। তবুও মা দিতে থাকে। দিতেই থাকে। বাইরে রিক্সাটি অপেক্ষায়। পা ছুঁয়ে সালাম করে জড়িয়ে ধরি। মায়ের গায়ের মিষ্টি গন্ধ আর বুকের উত্তাপ গায়ে মেখে দরজায় পা বাড়াই। রিক্সা এগিয়ে চলে। পিছু ফিরে চাই। মা একতলা থেকে উঠে আসে দোতলার বারান্দায়। কোন এক অদৃশ্য মায়ায়, পিছুটানে ফিরে ফিরে চাই। আরেকটু দেখবে বলে মা এবার ছাদে এসে দাঁড়ায়। দূরে যেতে যেতে আবছা হতে হতে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাই। পিছনে পরে রয় মায়ের অশ্রুসজল মুখ … বাবার করুন মায়াময় চাহনি… আর স্মৃতিময় বাড়িখানা …
মাস শেষে ডাকপিয়ন চিঠি দিয়ে যায়। মা লিখে, ছাদে রজনীগন্ধা ফুটেছে। অথচ ক’দিন আগে ফুটেনি বলে, আমি দেখিনি বলে আক্ষেপ। শূন্য বাড়িটি খা খা করে, সেই হাহাকার চিঠি জুড়ে। অতঃপর একদিন ভাইটি ঢাকায় এলো। মা টিফিন ক্যারিয়ারে অনেক কিছু রান্না করে পাঠায়। ভাবে, বেশ ক’দিন খেতে পারবো। ততোদিনে হোস্টেলের পাতলা ডাল আর একটুকরো মাছ কিংবা মাংসে অভ্যস্ত হয়ে উঠা আমি সেই খাবার রুমমেটরা সহ ভাগাভাগি করে তৃপ্তি নিয়ে খাই। মায়ের মুখখানা ভেসে উঠে। নোনা জলে ভাসি। আহা, আমার মায়ের হাতের রান্না…
বড় হয়ে উঠেছি। মায়ের কাছ হতে মাস শেষে টাকা নিতে সংকোচ বোধ করি। আজিমপুর থেকে মিরপুরে গিয়ে দুটি টিউশনি করি। কেমন করে সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিলো, জানিনা। মায়ের চিঠি আসে। পুরো চিঠির মুল কথা___ “আমি তোমাদের কিসের অভাবে রেখেছি যে, টিউশনি করার প্রয়োজন হলো… ” মাস না ফুরাতেই অনেকে যখন বাড়িতে টাকা চেয়ে চিঠি লিখে পাঠায়, আমি তখন ছুটিতে বাড়ি ফিরে বেঁচে যাওয়া টাকা মায়ের হাতে তুলে দেই। মা খুশি হয় না। ভাবে, ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া করিনি হয়তো। কিংবা অর্থ সাশ্রয় করতে গিয়ে সীমাহীন কষ্টে থেকেছি হয়তো…
আমরা বড় হই। মায়ের বয়স বাড়ে। বিদেশ থেকে অনেকদিন পরপর দেশে যাই। রাতভর গল্প করি। জমে থাকা যতো কথা, সব। স-ব। শুধু দুঃখের, কষ্টের গল্পগুলো আড়াল করি। কখনো কখনো মিথ্যে বলি। সব মিথ্যা তো আর ক্ষতিকর নয় ! কিছু মিথ্যে কখনো কখনো কারো সুখের কারন হয়। গল্পের মাঝেই ভোর হয়ে আসে। বাইরে আজান হয়। মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই। বেলা করে যখন উঠি, ততোক্ষনে টেবিলে সব পছন্দের খাবার সাজিয়ে মা অপেক্ষায় থাকে। সেই ছোটবেলায় কবে কোন খাবারটি পছন্দ করতাম, ভুলে যাওয়া সেইসব খাবার …। আমার প্যারালাইজড বাবা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাজারে গিয়ে দুর্লভ সেইসব পছন্দের আইটেমগুলো কিনে নিয়ে এসেছেন !
অতঃপর ২০১২ তে সেই বাড়িটিতে যখন যাই, তীব্র এক ঝাঁকুনি দিয়ে ভূমিকম্প হয় বুকের বাঁ পাশে। অশান্ত অস্থির চোখ জোড়া খুঁজে বেড়ায় বাড়ির আনাচ কানাচ। আমায় ভাল রাখবে বলে, ভাল খাওয়াবে বলে ব্যস্ত হয়ে উঠা মানুষ দু’জন নেই ! নেই মানে নেই ! পৃথিবীর কোথাও নেই। ঘুমহীন দুঃসহ দু’রাতের কথা আর না-ই বলি। শুধু বলি___ আমি ফিরে আসি। অন্যরকম এক ফেরা। দু’পা ছুঁয়ে সালাম করা হয়নি আর। মায়ের বুকের উত্তাপ নেয়া, জড়িয়ে ধরে গায়ের মিষ্টি গন্ধ শুঁকে বিদায় নেয়া হয়নি আর। পিছু ফিরে চাই বারে বারে। একতলার গেট, দোতলার বেলকণি, সবশেষে ছাদের কোনা। সবই আছে আগের মতই। সেই বেলকনি, সেই ছাদ। ছিলনা তবুও কিছুই। বুকের বাম পাশে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠি। চোখের উষ্ণ পানি টপটপ করে ঝরে রিক্সায় ছিটকে পরে। রিক্সা এগোয়… এগোতেই থাকে… সামনে… দূরে… আরো দূরে… পিছনে ঝাপসা হয়ে পরে রয় সেই বাড়িটি, যেখানে একদা একটি সুখী পরিবারের গল্প ছিল…
মা দিবসে পৃথিবীর তাবৎ মায়েদের জন্য ভালোবাসা অন্তরের অন্তস্থল হতে…..
৩২টি মন্তব্য
অলিভার
মায়েদের গল্প কিংবা মায়ার গল্প। জনে জনে হাজার ভাবে ঘুরিয়ে বললেও গল্পের মূলে ঠিকই মিল থেকে যায়। সকল মায়েদের মুখেই থাকে সন্তানকে নিয়ে উৎকণ্ঠা। বাড়ি ছাড়ার সময় সকল সন্তানই খুঁজে নেয় নিজের মত করে মায়ের উত্তাপ।
তারপর একদিন তারা হারায়, সেই উত্তাপের জন্যেই সন্তানেরা ছটফট করে। আমরা বুঝি না। ততদিনে ঐ একই উত্তাপ আমাদেরও বিতরণ করার সময় চলে আসে। কারও কারও ক্ষেত্রে আরও আগেই ঘটে ঘটনাটি, আবার কারও ক্ষেত্রে সময় লেগে যায়।
ভালো থাকুক মায়েরা, ভালো থাকুক তাদের হৃদয় নিংড়ানো মমতা গুলি।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুক সকল মা। ভাল থাকুক তাদের প্রানপ্রিয় সন্তান’রা।
খেয়ালী মেয়ে
পড়তে পড়তে শেষ প্যারাতে এসে চোখে পানিই চলে আসলো…
খুব সুন্দর গুছিয়ে লিখেছেন (y)
মা দিবসে পৃথিবীর সব মায়েদের জন্য ভালোবাসা অন্তরের অন্তঃস্থল হতে….
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুক আপনিও। শুভকামনা নিরন্তর।
সীমান্ত উন্মাদ
মা এই শব্দটার পরে এবং এই মা কে পাশে পেলে পৃথীবির বাকি সব কিছুই তুচ্ছ মনে হয়।
আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।
মা দিবসে সকল মায়ের জন্য সীমান্ত উন্মাদের উন্মাদীয় ভালোবাসা, শ্রদ্ধা।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকবেন আপনিও। ভাল থাকুক সকল মা।
অরণ্য
” পিছনে ঝাপসা হয়ে পরে রয় সেই বাড়িটি, যেখানে একদা একটি সুখী পরিবারের গল্প ছিল…” – আমি যেন দেখতে পেলাম।
রিমি রুম্মান
আমার দেশের প্রতিটি পরিবারের গল্প মুলত একই রকম। তাই সব কিছুই যেন চোখের সামনে দেখতে পাই আমরা। অনুভব করি একই সাথে মাকে নিয়ে লেখাগুলো পড়ার সময়।
রাকিবুল
মা তোমায় কখনো ঝাবেনা ভুলা মা
রিমি রুম্মান
জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত যে মানুষটি নিজের সকল সুখ, চাওয়া, পাওয়া বিসর্জন দেয় শুধুমাত্র সন্তানের জন্যে, সেই মাকে কেমন করে ভুলি আমরা ? ভাল থাকুন সবসময়।
আশা জাগানিয়া
মন খারাপ করা লেখা।মা এর চেয়ে আপন কেউ নেই।সব মা এর প্রতি শ্রদ্ধা।
রিমি রুম্মান
মা বেঁচে থাকলে লেখাটি অন্যরকম হতো। আনন্দের হতো। তিনি নেই।তাই এর চাইতে অন্যরকম লেখা কলমে উঠে আসেনি। ভাল থাকবেন। শুভকামনা জানবেন।
ইমন
সব মা এর প্রতি শ্রদ্ধা।:)
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুক সকল মায়েদের প্রাণপ্রিয় সন্তানরাও ।
স্বপ্ন নীলা
শেষ প্যারাতে এসে থমকে গেলাম —— মাকে ছালাম আর দোয়া রইল
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন সবাইকে নিয়ে। অনেক শুভকামনা।
শুন্য শুন্যালয়
অসাধারন একটি লেখা আপু। আমি কোনদিন কল্পনা করতে পারিনা, আমার বাবা-মা আমাকে ছেড়ে যাবে। প্রার্থনা করি আমার সব আয়ু তাদের হোক।
এমন করে লিখলে মন খারাপ হয় আপু, সবকিছু থেমে যায় যেন। মা-বাবাকে ভালো রাখুক আল্লাহ, যেখানেই থাকুন তারা।
রিমি রুম্মান
সবার একটু একটু দোয়ায় আমার বাবা-মা যেন সত্যিই ভাল থাকে।
ব্লগার সজীব
লেখাটি কয়েকবার পড়লাম আপু।মা নেই বাবা নেই এমনটা ভাবতে পারিনা।মা বাবাকে ভালো রাখুন আল্লাহ্।
জগতের সকল মাকে শ্রদ্ধা।
রিমি রুম্মান
বাবা-মা’কে ভালবাসুন, কাছাকাছি রাখুন যতটা সম্ভব। বাবা নেই, মা নেই… এমনটি কোনদিন হবে ভাবিনি। তবুও বাস্তবতা খুব দ্রুত বদলায়। খুব দ্রুত।
জিসান শা ইকরাম
‘ আমায় ভাল রাখবে বলে, ভাল খাওয়াবে বলে ব্যস্ত হয়ে উঠা মানুষ দু’জন নেই ! নেই মানে নেই ! পৃথিবীর কোথাও নেই।’ — এমন লেখায় কথায় মন্তব্য করা যায় না আসলে।একটি ভারী পাথর বুকে চেপে থাকার অনুভুতি জাগে শুধু। আল্লাহ্ তাঁদেরকে বেহেশত নসীব করুক………।
আপনাকে সহ সকল মা কে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুক সবার বাবা-মা। এপার আর ওই পারে।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
এমন দরদী আর কেউ নেই ভবে।মা সব সময় যেখানে থাকুক ভাল থাকুক এই কামনা।
রিমি রুম্মান
ঠিকই বলেছেন। স্বার্থহীন ভালোবাসা একমাত্র মা-ই বাসে।
স্বপ্ন
আপু লেখা পড়ে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেলো।লেখার গুনে আপনার ওখানে নিজে চলে গিয়েছিলাম।ভালো থাকুন ওনারা ওখানে।আপনার জন্য শুভেচ্ছা।
রিমি রুম্মান
বাস্তবতা আসলে এমনই। আমাদের সবার গল্প মোটামুটি একই রকম। কারো জীবনে ঘটেছে। কারো জীবনে ঘটবে, এই যা।
অনিকেত নন্দিনী
মা, নিজের সব দুঃখ-কষ্ট, সাধ-আহ্লাদ বুকে দাফন করে সন্তানের মঙ্গলকামনায় ব্যস্ত একজন নারী।
পৃথিবীর তাবৎ মায়েরা সর্বাবস্থায় ভালো থাকুন, সুখী থাকুন।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনিও। শুভকামনা রইলো।
লীলাবতী
আপু আপনার লেখা পড়ার পরে রেশ থেকে যায় অনেকক্ষন।এই লেখার রেশ থাকবে আগামী কয়েকদিন।
মায়েদের জন্য ভালবাসা।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন মায়ের ভালোবাসায়। শুভকামনা নিরন্তর।
মেহেরী তাজ
বেশ কদিন পরে পড়লাম আপনার পোষ্ট টা। এত্তো আবেগ মিশে থাকে আপু আপনার লেখায় যে কাঁদবো মন করে পড়তে বসলেও শেষমেশ কান্না আটকাতে খুব কষ্ট হয়। ভালো থাকুক সবার মা।
রিমি রুম্মান
জীবন কিন্তু এভাবেই এগিয়ে যায় সমাপ্তির দিকে। আমাদের সবার গল্প অনেকটা একই রকম। কারো জীবনে ঘটেছে , কারো জীবনে ঘটবে । এটিই কঠিন বাস্তবতা। ভাল থাকবেন।