মা’কে নিয়ে

রিমি রুম্মান ৯ মে ২০১৫, শনিবার, ০৭:২৬:৪১অপরাহ্ন বিবিধ ৩২ মন্তব্য

জোহরের নামাজের সময় যায় যায়। অফিস থেকে ফিরে ফরজ নামাজটুকু আদায় করেই মা বসে পরেন খাবার টেবিলে। ক্ষুদার্থ আমরা চারটি প্রাণী অপেক্ষায়। মা মৃদু ভৎসনা করেন, কেন না খেয়ে অপেক্ষায় থাকি প্রতি দুপুরে। অতঃপর পাঁচ সদস্যের পরিবারটি একসাথে দুপুরের খাবার খেতে খেতে হাসি গল্পে মেতে উঠে। অনেকদিন পর্যন্ত এটি একটি সুখী পরিবারের গল্প ছিল…

 

এভাবে আমরা বেড়ে উঠি। ভাইটি হোস্টেলে চলে যায়। মা অফিস থেকে ফেরার পথে প্রায়ই তাঁকে দেখে আসে। বাসায় ফিরে অঝোরে কাঁদে। একদিন ওর মুখটা শুকনো ছিল… কোনদিন ওর গায়ে টিচারের মারের দাগ দেখেছে… আবার কোনদিন ভাল রান্না হয়েছে, অথচ ও নেই…। এরপর আপা ভার্সিটিতে যায়। অনেকদিন পর পর ছুটিতে আসে। উচ্ছ্বসিত মা এটা সেটা ভাল মন্দ রান্না করে। বাসায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। একদিন ছুটি শেষে আপা ফিরে যায়। ভোর থেকেই মা এটা সেটা গুছিয়ে দেয়। দিতেই থাকে, যেন পৃথিবী শুদ্ধ দিয়ে দিলেও এ দেয়া শেষ হবার নয়। ওকে বিদায় দিয়ে বুকে বালিশ চেপে পাঁজর ভাঙ্গা কান্না। ক’দিন গুমোট নিস্তব্দতায় থাকে বাড়িটির আনাচ কানাচ।

 

সবশেষে আমিও ছেড়ে যাই আমার শহর। সেই কাক ডাকা ভোর থেকেই মা ব্যস্ত। টেবিলে নাস্তা সাজায়। ঘুম থেকে ডেকে তোলে। ব্যাগ গুছিয়ে দেয়। আমি বলি, এটা লাগবে না, ওটা লাগবে না। তবুও মা দিতে থাকে। দিতেই থাকে। বাইরে রিক্সাটি অপেক্ষায়। পা ছুঁয়ে সালাম করে জড়িয়ে ধরি। মায়ের গায়ের মিষ্টি গন্ধ আর বুকের উত্তাপ গায়ে মেখে দরজায় পা বাড়াই। রিক্সা এগিয়ে চলে। পিছু ফিরে চাই। মা একতলা থেকে উঠে আসে দোতলার বারান্দায়। কোন এক অদৃশ্য মায়ায়, পিছুটানে ফিরে ফিরে চাই। আরেকটু দেখবে বলে মা এবার ছাদে এসে দাঁড়ায়। দূরে যেতে যেতে আবছা হতে হতে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাই। পিছনে পরে রয় মায়ের অশ্রুসজল মুখ … বাবার করুন মায়াময় চাহনি… আর স্মৃতিময় বাড়িখানা …

 

মাস শেষে ডাকপিয়ন চিঠি দিয়ে যায়। মা লিখে, ছাদে রজনীগন্ধা ফুটেছে। অথচ ক’দিন আগে ফুটেনি বলে, আমি দেখিনি বলে আক্ষেপ। শূন্য বাড়িটি খা খা করে, সেই হাহাকার চিঠি জুড়ে। অতঃপর একদিন ভাইটি ঢাকায় এলো। মা টিফিন ক্যারিয়ারে অনেক কিছু রান্না করে পাঠায়। ভাবে, বেশ ক’দিন খেতে পারবো। ততোদিনে হোস্টেলের পাতলা ডাল আর একটুকরো মাছ কিংবা মাংসে অভ্যস্ত হয়ে উঠা আমি সেই খাবার রুমমেটরা সহ ভাগাভাগি করে তৃপ্তি নিয়ে খাই। মায়ের মুখখানা ভেসে উঠে। নোনা জলে ভাসি। আহা, আমার মায়ের হাতের রান্না…

 

বড় হয়ে উঠেছি। মায়ের কাছ হতে মাস শেষে টাকা নিতে সংকোচ বোধ করি। আজিমপুর থেকে মিরপুরে গিয়ে দুটি টিউশনি করি। কেমন করে সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিলো, জানিনা। মায়ের চিঠি আসে। পুরো চিঠির মুল কথা___ “আমি তোমাদের কিসের অভাবে রেখেছি যে, টিউশনি করার প্রয়োজন হলো… ” মাস না ফুরাতেই অনেকে যখন বাড়িতে টাকা চেয়ে চিঠি লিখে পাঠায়, আমি তখন ছুটিতে বাড়ি ফিরে বেঁচে যাওয়া টাকা মায়ের হাতে তুলে দেই। মা খুশি হয় না। ভাবে, ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া করিনি হয়তো। কিংবা অর্থ সাশ্রয় করতে গিয়ে সীমাহীন কষ্টে থেকেছি হয়তো…

 

আমরা বড় হই। মায়ের বয়স বাড়ে। বিদেশ থেকে অনেকদিন পরপর দেশে যাই। রাতভর গল্প করি। জমে থাকা যতো কথা, সব। স-ব। শুধু দুঃখের, কষ্টের গল্পগুলো আড়াল করি। কখনো কখনো মিথ্যে বলি। সব মিথ্যা তো আর ক্ষতিকর নয় ! কিছু মিথ্যে কখনো কখনো কারো সুখের কারন হয়। গল্পের মাঝেই ভোর হয়ে আসে। বাইরে আজান হয়। মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই। বেলা করে যখন উঠি, ততোক্ষনে টেবিলে সব পছন্দের খাবার সাজিয়ে মা অপেক্ষায় থাকে। সেই ছোটবেলায় কবে কোন খাবারটি পছন্দ করতাম, ভুলে যাওয়া সেইসব খাবার …। আমার প্যারালাইজড বাবা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাজারে গিয়ে দুর্লভ সেইসব পছন্দের আইটেমগুলো কিনে নিয়ে এসেছেন !

 

অতঃপর ২০১২ তে সেই বাড়িটিতে যখন যাই, তীব্র এক ঝাঁকুনি দিয়ে ভূমিকম্প হয় বুকের বাঁ পাশে। অশান্ত অস্থির চোখ জোড়া খুঁজে বেড়ায় বাড়ির আনাচ কানাচ। আমায় ভাল রাখবে বলে, ভাল খাওয়াবে বলে ব্যস্ত হয়ে উঠা মানুষ দু’জন নেই ! নেই মানে নেই ! পৃথিবীর কোথাও নেই। ঘুমহীন দুঃসহ দু’রাতের কথা আর না-ই বলি। শুধু বলি___ আমি ফিরে আসি। অন্যরকম এক ফেরা। দু’পা ছুঁয়ে সালাম করা হয়নি আর। মায়ের বুকের উত্তাপ নেয়া, জড়িয়ে ধরে গায়ের মিষ্টি গন্ধ শুঁকে বিদায় নেয়া হয়নি আর। পিছু ফিরে চাই বারে বারে। একতলার গেট, দোতলার বেলকণি, সবশেষে ছাদের কোনা। সবই আছে আগের মতই। সেই বেলকনি, সেই ছাদ। ছিলনা তবুও কিছুই। বুকের বাম পাশে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠি। চোখের উষ্ণ পানি টপটপ করে ঝরে রিক্সায় ছিটকে পরে। রিক্সা এগোয়… এগোতেই থাকে… সামনে… দূরে… আরো দূরে… পিছনে ঝাপসা হয়ে পরে রয় সেই বাড়িটি, যেখানে একদা একটি সুখী পরিবারের গল্প ছিল…

 

মা দিবসে পৃথিবীর তাবৎ মায়েদের জন্য ভালোবাসা অন্তরের অন্তস্থল হতে…..

৫৭৫জন ৫৭৪জন
0 Shares

৩২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ