মনময়=মন্ময়

গোধূলি ২৭ জুন ২০১৩, বৃহস্পতিবার, ০৩:০৯:১৮পূর্বাহ্ন গল্প ৩০ মন্তব্য

শুক্রবারে নিজের চেম্বারে বসি। রোগীর ভিড় লেগেই থাকে। সেদিনও দেখছিলাম। ‘আলপনা’ নামের ছাব্বিশ-সাতাশের একটি মেয়েকে নিয়ে এসেছিলো তার হাজব্যান্ড মৃদুল। আলপনাকে চেকআপের পর বললাম-

“দেখুন, পেশেন্টের যা অবস্থা দেখলাম, উনাকে হসপিটালে অ্যাডমিট করা উচিত। আমার চেম্বারে না এনে-”

“ওকে হসপিটালে ভর্তি করতে চাই না”, মৃদুল বলল।

“পেশেন্ট কিন্তু ডেঞ্জারাস, বাসায় সামলাতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। কতদিন ধরে এই অবস্থা?”

“তিন মাস ধরে। ডক্টর, আপনি জাস্ট মেডিসিনগুলো প্রেস্ক্রাইব করে দেন প্লিজ।”

“দিচ্ছি। মনে রাখবেন, একদিনের জন্যও এগুলো discontinue করা যাবে না।”

“ডক্টর, একটা রিকোয়েস্ট ছিল।”

“জ্বি,বলুন।”

“ওর সুস্থ হওয়াটা খুব জরুরী। আপনার diagnosisএর সুবিধার জন্য আলপনার লেখা বেশ কিছু পেপারস এনেছি। যদি দেখতেন…”

“দেখুন, diagnosis হয়ে গেছে। আমি psychiatrist, psychologist নই যে-”

“জানি, আপনার কাছে আসার আগে একজন psychologistকে দেখিয়েছি।”

“আচ্ছা, রেখে যান। সময় হলে দেখব।”

 

সাধারণত রোগীদের symptoms দেখেই treatment দেই। আমার স্যার Dr. Tokai এর কথা মনে পড়ল, উনি বলতেন,”‘মিসির আলি’ হবার সুযোগ পেলে ছেড়ো না, মজা পাবে।” একদিন রাতে কাগজগুলো হাতে নিলাম। তারিখ ৪মাস আগের। বেশ নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর আমজাদের সাক্ষাৎকার। লেখাটা অনেকটা এরকম-

“আপনার রিসার্চ সম্পর্কে কিছু বলুন।”

“সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাপারটা একটু জটিল, অনেকটা to live in lies. আপনি শার্লোট ব্রোন্টের “Jane Eyre” পড়েছেন?”

“সত্যি বলতে নাম শুনেছি, পড়া হয় নি।”

“ব্রোন্টে ফ্যামিলির তিনবোন শার্লোট, এমিলি, অ্যান ও ভাই ব্রানওয়েল প্রত্যেকেই কিছু না কিছু রেখে গেছেন ইংরেজি সাহিত্যে। 1842তে শার্লোট ও এমিলি তাদের ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য কন্সট্যানটিন হেগারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। হেগারকে লেখা শার্লোটের বেশ কিছু চিঠি থেকে জানা যায় যে শার্লোট হেগারের প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত ছিলেন, যদিও হেগার তাঁর কোন চিঠির উত্তর দেন নি। হেগার কিছু চিঠি ছিঁড়েও ফেলেছিলেন। মজার ব্যাপার হল, হেগারের wife  চিঠিগুলোর টুকরো জোড়া দেন। পরবর্তীতে হেগারের সন্তানেরা চিঠিগুলো ব্রিটিশ মিউজিয়ামে দিয়ে দেন। ধর্মযাজকবাবা প্যাট্রিক ব্রোন্টের সহকারী ‘আর্থার বেল নিকোলাস’ শার্লোটের গুনমুগ্ধ ছিলেন, বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রথমে প্রত্যাক্ষিত হলেও পরে সফল হন। প্রথম উপন্যাস”Jane Eyre” কে আত্মজীবনীমূলক ধরা হয় কারণ নিজের জীবনের নানা অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছেন এবং মনের একান্ত চাওয়াকে কল্পনায় পূরণ করেছেন উপন্যাসের শেষের দিকে। উপন্যাসে জেন বিবাহিত এডওয়ার্ড ফেয়ারফ্যাক্স রচেস্টারকে ভালবাসে, সে জানত না যে রচেস্টার বিবাহিত ও তাঁর বউ বদ্ধপাগল। ধর্মযাজক সেন্ট জন আইয়র রিভারস জেনকে বিয়ে করতে চান কিন্তু জেন রাজী হয় নি। ওদিকে রচেস্টারের বউ আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করে, নানা নাটকীয়তার পর জেন ফিরে পায় তার ভালবাসাকে। বাস্তবজীবনে শার্লোট বিবাহিত হেগারকে ভালবাসলেও পান নি, বিয়ে করেছিলেন আর্থারকে। শার্লোট যা মনেপ্রাণে চাইতেন তাকে কল্পনায় পূরণ করে লেখনীতে তুলে ধরেন। যা বাস্তবে সম্ভব নয়, তা আমাদের কল্পনায় সম্ভব। The world is ugly. কিন্তু human brain অনেক কিছুই পারে। শার্লোট তাঁর উপন্যাসে নিজের জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন। আমরা যা ভালবাসি তাকে কল্পনায় রুপ দিতে দোষ নেই। Sometimes lies are beautiful. ইয়ান ম্যাকউয়ানের “The Atonement”উপন্যাসটি ব্রাওনি টেল্লাইস নামক একজন লেখিকাকে কেন্দ্র করে যিনি তাঁর শেষ লেখা “The Atonement”এ নিজের করা ভুলকে সংশোধন করেন, যা বাস্তবে সম্ভব হয় নি। লেখিকার বড়বোন সিসিলিয়া ও তাঁর প্রেমিক রোবির একটি Happy ending টেনেছেন প্রায়শ্চিত্য হিসেবে। Why should we all live like the dead? খুব সহজেই ভাল থাকতে পারি আমরা। সেক্ষেত্রে We have to create our worlds ourselves in our minds,remain there & believe in that. But remember, when you come to know that the world doesn’t exist, your happiness ends.”

“মিথ্যের মধ্যে বসবাস! এটা এক ধরনের sickness না?”

“কমবয়সী ছেলেমেয়েরা বাসা থেকে পালিয়ে পরিবারকে ভোগান্তি দেয়, সমাজে অশান্তি করে। তাহলে তো ভালবাসাও এক ধরনের sickness,আলপনা। ভেবে দ্যাখো, জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মানুষের মনমতো হয় না। টাইমমেশিনের বাস্তব অস্তিত্ব নেই যে ফিরে গিয়ে ঠিক করবে। কিন্তু সবকিছুই মনের মতো হওয়া সম্ভব শুধুমাত্র কল্পনায়। মরেই তো যাবো, যে কদিন আছি মনের মতো করে বাঁচতে সমস্যা কোথায়?”

লেখাটা এতোটুকুই। একমাস পরে মৃদুল আলপনাকে নিয়ে এলো চেকআপের জন্য।

জিজ্ঞেস করলাম, “improvement হয়েছে?”

মৃদুল বলল, “বুঝতে পারছি না, তবে এখন ঠিকঠাক ঘুমায়।”

“এর মধ্যে কি আর suicide attempt নিয়েছে?”

“না ”

“হুম। লেখাটা পড়েছিলাম। কিন্তু লেখাটার সাথে connection কি? আরেকবার সবকিছু detailsএ বলুন তো ।”

“বিয়ের পাঁচ-ছমাস পরের দিকের কথা। আলপনা মাসিক ম্যাগাজিনে সাহিত্যপাতায় সাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকারের কলাম লিখত। প্রফেসর আমজাদের সাক্ষাৎকারটা ছিল last, যা আর ছাপা হয়নি। সাক্ষাৎকার নিয়ে বাসায় আসার পরই চুপচাপ বসেছিল। কিন্তু ও এমন না। She’s full of life. In other words, she’s life. তারপর কয়েকদিন ধরেই চুপ। প্রথমে ভেবেছিলাম ও আপসেট, জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিছু বলেনি। দিনকতক পরে দেখি আলপনা খুবই আনন্দিত এবং এসে বলল, ও আর কিছু করবে না, job ছেড়ে দিয়েছে। ও নিজের মতো করে বাঁচবে। এসব বলতে বলতে প্রচণ্ড খুশিতে হাসতে লাগলো। তারপর যা বলল, আমি তো শুনে হতবাক। বলল, ও আলাদা হয়ে যাবে, ‘সময়ে’র কাছে ফিরে যাবে। আমি বললাম, “সময় বিয়ে করে কানাডায় চলে গেছে, ও আর আসবে না।”

“ও আসবে,আমি জানি।”

“আর আমি?”

“মৃদুল, ভেবো না। তোমার জন্য খুব ভাল একটা মেয়ে খুঁজে আনব।”

তারপর থেকেই চলছে। মা-বাবা ডিভোর্স দিতে বলল। lawyer হিসেবে ব্যাপারটা আমার জন্য খুব ইজি। কিন্তু পারলাম না… জীবনের কঠিন কিছু সময়ে অনেককেই এক্সপেক্ট করেছি পাশে,পাই নি। ও ছিল।”

“love-marriage ছিল?”

“আক্ষরিক অর্থে যাকে love-marriage বলে,তা নয়। ভালবাসি কিনা জানি না। শুধু জানি,I’ll stand by her.”

” ‘সময়’ কে?”

“সময়ের সাথে আলপনার affair ছিল। প্রফেসর আমজাদের ঐ সাক্ষাৎকারের পর থেকেই সময়কে নিয়ে আলপনার এসব…প্রচন্ড হ্যাপি ছিল। যখন বুঝাতে পারলাম, ও যা ভাবছে তা হবে না, ও depressed হয়ে গেল। তারপরই suicide attempt নেয়। তারপর psychologist, তারপর আপনার এখানে…এখন ও জানে আমিই ওর ‘সময়’। ওর সময় আমার কাছে অনেক precious,তাই আপাতত ওর ‘সময়’ হয়েই আছি। আপনার প্রেসক্রিপশনে দেখেছিলাম-Bipolar Mood disorder. Google করেছিলাম। Dr.,ওর কতদিন লাগবে সুস্থ হতে?”

“Exact তো বলা সম্ভব না, vary করে।”

 

মৃদুল চলে যাবার পর প্রফেসরের কথাগুলো কানে বাজতে লাগলো,”Remember,when you come to know that the world doesn’t exist,your happiness ends.”

মনে পড়লো, ক্লাস টুতে থাকতে রিমির সাথে ঝগড়া হয়েছিলো ও পাশে জায়গা রাখেনি বলে। রিমি কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছিল দেখেই রাস্তার বাসটি চোখে পড়েনি। বাস্তবে ওকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না,কিন্তু কল্পনায় ওকে বাঁচিয়ে তুলতে পারি।

কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে কীর্তনকে বলেছিলাম,”কীর্তন,আমার কোন opinionকে তুমি respect করো না। Better we should apart. “ও বলেছিল,”আটকে রাখিনি। যাবে যাও। I respect your decision.” কিন্তু ভীষণ চাচ্ছিলাম যে কীর্তন একবার ‘মীরা’ বলে ডাক দিক। হয়ত কীর্তনও চাচ্ছিল আমি একবার ফিরে তাকাই। ও ডাকে নি, আমিও ফিরে তাকাই নি। পাছে দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ঐ সময়টাতে ফিরে গিয়ে মনের মতো করে ফেলা সম্ভব নয়। আমার মনময় যা আছে, তা সম্ভব আমার কল্পনায়। কল্পনাই হতে পারে মন্ময়।

©কৃন্তনিকা

[ বিঃদ্রঃ এই গল্পের দুটি প্রিকুএলও আছে, যা পরবর্তীতে প্রকাশিত হবে (এই গল্পটি আগে লেখা , তাই আগে প্রকাশ করলাম)]

৬৬৭জন ৬৬৭জন
0 Shares

৩০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ