১৯৭১ সালে ৯ মাস ব্যাপী যুদ্ধকালীন সময়ে পাকবাহিনী দ্বারা ধর্ষিত বীরাঙ্গনাদের করুণ পরিণতির পেছনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছিলো এদেশেরই কিছু লোক রাজাকার-আলবদররা। তাদের সাহায্য নিয়েই মিলিটারিরা অসহায় নারীদের উপর তাণ্ডব চালিয়েছিলো, যে তাণ্ডবের যন্ত্রণা তাঁরা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন।
শ্রীপুরের বীরমাতা মমতাজ
গর্ভাবস্থার নয় মাস চলাকালীন সময়ে আট পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক ধর্ষিত হন। যার ফলে জরায়ু ও পায়ুপথের সাথে প্যাঁচিয়ে পচে গলে শিশুটি গর্ভেই মারা যায়। তিন মাস পর হাসপাতালে মৃত্যুপথযাত্রী মমতাজের পেট থেকে মৃত শিশুর হাড়গোড় বের করা হলেও চিরদিনের জন্য তাঁর পায়ুপথ ও যোনিপথ অকেজো হয়ে যায় । ডাক্তাররা তাঁর তলপেট কেটে তাঁর কোলনটি (পায়খানার রাস্তা) বের করে দেন আর গত বিয়াল্লিশ বছর ধরে এভাবেই তিনি মলত্যাগ করে আসছেন। অসহায় মমতাজ কোলন ব্যাগ কেনার ক্ষমতা না থাকায় পরনের ছেঁড়া ময়লা-নোংরা শাড়ি দিয়ে কোলনটি ঢেকে রাখেন। ময়লা শাড়ি আর বাতাস থেকে জীবাণু মিলেমিশে তাঁর কোলনটি ঘাঁ হয়ে একাকার, সবসময় কোলন দিয়ে রক্ত পড়ে।
রানীশংকৈল গ্রামের মোখলেছা, মালেকা, আমিনা, বুদি
চার বোনই বীরাঙ্গনা। যুদ্ধের শেষের দিকে মিলিটারি ক্যাম্প থেকে পালাতে সক্ষম হলেও জীবনের নির্মম সত্য থেকে পালাতে পারেননি। বাড়ির পেছনে জঙ্গলে সারাদিন লুকিয়ে থাকতেন। গ্রামের মানুষ তাঁদের দেখলেই তাড়া করত, যেন ওঁরা অচ্ছুৎ কোনো প্রাণী, ধুর! ধুর! করে খেদিয়ে দিত! সবার পরনে কাপড়ও ছিল না। একটা কাপড় পরে এক বোন লোকালয়ে বের হয়ে খাবার আনতে যেতেন। বাকি তিনজন নগ্ন লুকিয়ে থাকতেন সেই জঙ্গলে। আমিনা পরিচয় লুকিয়ে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু স্বামী তাঁর বীরাঙ্গনা পরিচয় জানতে পেরে সেই অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি হিসাবে ইট দিয়ে মেরে হাত, পা, দাঁত সব ভেঙে দিয়ে সন্তানদের তাঁর ঘাড়ে ফেলে রেখে চলে যায়।
কুমিল্লার বীরমাতা আম্বিয়া
পাক সৈন্যরা তাঁকে ধর্ষণ করলে তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন। স্বাধীনতার পর সন্তানটি জন্ম নিলে ‘শিশুটি বৈধ নয়’ এই ফতোয়া দিয়ে মসজিদের ইমাম শিশুটির মুখে লবণ দিয়ে তাকে মেরে ফেলে। অবিবাহিত অবস্থায় সন্তান হয়েছে মর্মে তাঁকে অসতি বলে ফতোয়া জারি করা হয় এবং পরপর চল্লিশ দিন তাঁর দুহাতে চল্লিশটি করে বেত্রাঘাতের আদেশ করা হয়, ফলে থেতলে যায় তাঁর হাতের পাতা দুটো। এরপর বেঁচে থাকা অবস্থায় তিনি ভাইয়ের সংসারে দাসী হয়েই পড়েছিলেন। সম্প্রতি আম্বিয়া মারা গেছেন।
বীরমাতা রমা চৌধুরী
১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে মাস্টার্স করে পেশা হিসেবে বেচে নিয়েছিলেন স্কুল শিক্ষকতাকে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারের হাতে সম্ভ্রম হারানোর পর নিকটজন সহ সমাজের লোকদের কাছ থেকে শুরু হয়েছিল তার দ্বিতীয় দফা লাঞ্চিত হবার পালা। এখন তিনি ফেরি করে নিজের লেখা বই বিক্রি করেন। তাঁকে ভালবাসেন, শ্রদ্ধা করেন এমন কিছু বাঁধা গ্রাহকই তাঁর বই কিনে নেন। এ পর্যন্ত ১৮টি বই তিনি প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ”আমি বই বিক্রি করি, যেদিন বিক্রি করতে পারি সেদিন খাই, যেদিন পারিনা সেদিন উপোস থাকি। মুক্তিযুদ্ধ আমার কাঁধে ঝোলা দিয়েছে। আমার খালি পা, দুঃসহ একাকীত্ব, সবই মুক্তিযুদ্ধের অবদান। আমার ভিতরে অনেক জ্বালা, অনেক দুঃখ। আমি মুখে সব বলতে পারিনা, কালি দিয়ে লিখে যাবো। আমি নিজেই একাত্তরের জননী।“ ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থের ৫২ পৃষ্ঠায় নিজের ধর্ষিত হবার কাহিনীর পাশাপাশি রমা চৌধুরী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পৈশাচিকতার বর্ণণা দিয়েছেন।
এই হচ্ছে আমাদের বীরাঙ্গনাদের জীবনের সুঁচে খোদাই করা নকশি কাঁথা। ঠাঁই হয়নি সমাজ নামের শৃঙ্খলিত প্রাচীরে। স্বীকৃতিও মেলেনি এক বিন্দু। মিলেছে শুধু লাঞ্ছনা, গঞ্জনা আর বীরাঙ্গনা জীবনের জন্য তিরস্কার। এমনকি পরিবারেও ঠাঁই মেলেনি তাঁদের, পড়ে ছিলেন স্টেশনে, নদীর পাড়ে। দিনের পর দিন অভুক্ত, কখনো কখনো পরনে হয়তো কোনো কাপড়ও থাকত না।
পাকিস্থানি মিলিটারিরা কিন্তু এদেশের অলিগলি কিছুই চিনতো না। কোন ঘরে মেয়ে আছে তা জানার বা চেনার তাদের কোন উপায়ই ছিলো না। তাহলে কে চিনিয়েছে বা জানিয়েছে তাদের???
৩১টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
বীরাঙ্গনা মায়েদের এসব অত্যাচারের কথা জানতে পেরে নিজকে অসহায় লাগে
কোন দোষ না থাকা সত্বেও সমাজ এদেরকে গ্রহন করেনা,শাস্তি দেয়
গতবছর টিভিতে দেখেছিলাম- বনের মধ্যে লুকিয়ে থাকার সেই কষ্টের কাহিনী বর্ননা করেছেন বীরাঙ্গনা মায়েরা।
শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
মারজানা রুবা
অসহায় লাগে মুলতঃ এজন্য যে, স্বাধীনতা আনতে যেয়ে যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন তাঁরা আজীবন জাতির কাছে সন্মানের সাথে স্বরণীয় হয়ে আছেন, থাকবেন। আর যাঁরা মান হারিয়েছেন তাঁরা সন্মান তো দুরের কথা, বেঁচে থেকে সারাজীবন লাঞ্চনা আর অপমান বয়ে বেড়াচ্ছেন। এখনো আমরা তাঁদের সেরকম সন্মান দিতে পারিনি।
সঞ্জয় কুমার
পড়তে পড়তে কখন কেঁদে ফেলেছি বুঝতে পারিনি ।।
মারজানা রুবা
কাঁদো বাঙালী কাঁদো।
আমাকেও প্রতিনিয়ত কাঁদায়। প্রতিমুহূর্ত তাঁদের অপমানের জ্বালা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আরো বেশি কষ্ট দেয় যখন দেখি তাঁরা নিজগৃহেও অবাঞ্চিত। এখনো আমরা তাঁদের সেরকম সন্মান দিতে পারিনি।
আপনার কান্নাই যেনো তাঁদের হয়ে কথা বলে।
প্রজন্ম ৭১
এনারাই আমাদের মা আমাদের বোন,অবস্থা গুলো যেনো দেখতি পারছি এখন। এসব অত্যাচারের জন্য দায়ী এদেশীয় সহযোগী রাজাকারদের বিচার চাই।
মারজানা রুবা
এই দেশটাকে স্বাধীন করতে যেয়ে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে বীরাঙ্গনাদের, স্বাধীনতা ভোগ করার পাশাপাশি তাঁদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য লড়ে যাওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
মেহেরী তাজ
এসব পড়ে কষ্ট লাগছে খুব আপু। এত কিছু জানতামনা। ধন্যবাদ জানানোর জন্য। পাকিদের দোসরদের জন্য শুধু প্রচন্ড ঘৃনাই থাকবে মনে আজীবন।
মারজানা রুবা
মান হারিয়ে তাঁরা আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, বিনিময়ে পেয়েছেন লাঞ্চনা আর অপমান। এবার সময় এসেছে তাঁদের মুখে হাসি ফোটাবার।
মামুন
সুন্দর পোষ্ট। অনেক কিছুই জানলাম।
মারজানা রুবা
ধন্যবাদ ভাই। শুধু জানলে হবে না, জানাতেও হবে। তাঁদের হয়ে দাঁড়াতে হবে।
তাঁদের কাছে আমাদের যে দায় তা যে শোধ করতে হবে।
মারজানা রুবা
ধন্যবাদ ভাই। শুধু জানলে হবে না, জানাতেও হবে। তাঁদের হয়ে দাঁড়াতে হবে।
তাঁদের কাছে আমাদের যে দায় তা যে শোধ করতে হবে।
ব্লগার সজীব
বীরমাতাদের ইট দিয়ে আঘাত করা, ইমামের ফতোয়া অনুযায়ী বেত্রাঘাত করা, এসব মানতে পারছিনা আপু। কোথায় তাদের প্রতি সহানুভুতি দেখাবো, তার পরিবর্তে এমন লাঞ্চনা। কোন সমাজ ব্যবস্থায় আছি আমরা?
মারজানা রুবা
আর সমাজব্যবস্থা! সমাজব্যবস্থা এখন নষ্টদের দখলে!
সঞ্জয় কুমার
সজীব ভাই সমাজ বরাবরই সুবিধাবাদী আর পুঁজিবাদীদের দখলে । আমাদের মত সাধারণ মানুষদের জন্য সমাজ কখনোই ভাল আগেও ছিল না এখনও নেই ।
মারজানা রুবা
আমার মনে হয় সাধারন মানুষরা উট পাখির ন্যায় বালিতে মুখ গুজে আছে বলেই সমাজ দিনেদিনে নষ্টদের দখলে চলে যাচ্ছে। সুবিধাবাদী হোক আর পুঁজিবাদীই হোক, সাধারন মানুষের জাগরনই এর থেকে উত্তরনের একমাত্র উপায়।
শুন্য শুন্যালয়
একাত্তরের প্রজন্ম ভাইয়ার একটা পোস্টে আমি এজন্যই বলেছিলাম তিনি জন্ম সনদ চাইতে পারছেন, কারন তিনি সৌভাগ্যবান। ভুল বলিনি আপনার এই পোস্টই তার প্রমান। রাজাকার-আলবদররা তাদেরকে চিনিয়েছিলেন, কিন্তু সব জেনে শুনে আমরা মানুষরা বীরাঙ্গনাদের কি প্রতিদান দিয়েছি।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ দিচ্ছি এমন পোস্টের জন্য। ভালো থাকুন। -{@
মারজানা রুবা
ঠিক বলেছিলেন! এদেশে বীরাঙ্গনারাই সঠিক সন্মান পাচ্ছেন না, আর যুদ্ধশিশু!!!
ধন্যবাদ আপনাকে। আপনিও ভালো থাকুন।
ছাইরাছ হেলাল
নিজেদের খুব অকৃতজ্ঞ মনে হয়।
মারজানা রুবা
বোধ কাজ করে বলেই এমন মনে হয়। ধন্যবাদ।
নুসরাত মৌরিন
শিউড়ে উঠি এমন সব বর্ণনায়।
দুচোখ ফেটে জল আসে,হাত পা অসাড় লাগে ভাবলেই। 🙁
এত নির্মন যন্ত্রনা আর অপমানের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন আমাদের মায়েরা,অথচ আমরা তাদের ন্যুনতম সম্মানটুকু দিতে পারি নাই!!!ধিক শত ধিক!!
মারজানা রুবা
আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব দেশের প্রয়োজনে তাঁরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাঁর সঠিক মূল্যায়নের প্রয়োজনে ভুমিকা রাখা।
নওশিন মিশু
এই বাঙ্গালী ললনাদের হাতেই “Afridi Marry Me” লেখা প্লা-কার্ড শোভা পায়…..
মারজানা রুবা
আরে ম্যাডাম! ওই মেয়েগুলোর দোষ ধরে কি হবে? এদেরে এই মানসিকতা গড়ে উঠার পেছনে দায়ী কে?
দীর্ঘকাল এই বাংলায় অশুভ প্রেতাত্মারা বিচরণ করে বেড়িয়েছে।
শুভবুদ্ধিসম্পন্নরা গা বাচিয়ে চলেছেন।
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখুন না, আপনার আমার আশেপাশে বসেই স্বাধীনতা বিরোধীরা কেমন মগজ ধোলাই করে বেড়াচ্ছে!
আর সমাজে এখন সেই প্রভাবটাই যে পড়েছে।
এই প্রভাব কাটিয়ে উঠতে গেলে একটাই উপায় জাগতে হবে, জাগাতে হবে।
ধন্যবাদ।
সায়ন্তনু
আমরা একদিন আলো খুঁজে নেবই ।
মারজানা রুবা
অবশ্যই, সজাগ থাকলে আলো একদিন আসবেই।
স্বপ্ন
কষ্ট লাগলো আপু পড়তে।সব দোষ যেনো নারীদের।যত আক্রোশ সব নারীদের প্রতি।এসব জানতাম না।ধন্যবাদ জানানোর জন্য।
মারজানা রুবা
তাঁদের ত্যাগের বিনিময়েই আমরা আজ স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করছি।তাঁরা ত্যাগস্বীকার করে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, এখন তা রক্ষা করার দায়িত্ব আপনার-আমার, সবার; যারযার অবস্থান থেকে যে যেভাবে পারি।
শিশির কনা
পড়া যায়না এমন কাহিনী আপু। এদেশে বসবাসকারী কিছু কুলাংগর,বিশ্বাষঘাতক যারা রাজাকার নামে পরিচিত,এরাই পাকিদের এইসব মা বোনদের বাড়ি বাড়ি নিয়ে গিয়েছে।সামাজিক এবং রাষ্ট্রিয় ভাবে এদের বর্জন করা যায়।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
পড়তে গেলেই কষ্ট হয়,এবের বুঝুন তাঁরা কতোটা সহ্য করেছে! তাঁদের কাছে আমাদের যে দায়, তা যে আমাদেরই শোধ করতেই হবে।
ওদের আমরা এতোকাল সুযোগ দিয়েছি, এবার আমাদেরই তাদের বর্জন করতে হবে।
কৃন্তনিকা
এমন অজস্র ঘটনাই ঘটেছে।
কিন্তু অকৃতজ্ঞ “স্বাধীন আমরা” কিছুই জানি না…
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হ্যাঁ, দীর্ঘকাল জাতির কাছে এই ঘটনাগুলোকে আড়াল করে রাখা হয়েছিলো। প্রতিকুল পরিবেশে এগুলো নিয়ে কেউ আলোচনাও করতো না।
এখন সময় এসেছে শেকড়ের খবর বের করে আনার।