গতকাল অনেকদিন পরে নাজিফার সাথে দেখা হলো। সে নিজেই আমাদের অফিসে এসেছে দেখা করার জন্য। নাজিফা আমাদের পেশেন্ট ছিলো এবং একটি মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে দীর্ঘদিন থেকে তার চিকিৎসা চলছিলো। চিকিৎসা পর্যায়ের কয়েকটি ধাপ সম্পন্ন করার পরবর্তী কর্মসূচিতে পরিবারের সাথে সময় কাটানোর জন্য কয়েকদিনের ছুটিতে সে বাড়িতে এসেছে। অফিসে সে আমাদের ডাক্তারের সাথে দেখা করে সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে এসেছিলো। নাজিফা নামটি তার প্রকৃত নাম নয় এবং সঙ্গতকারনেই এই লেখায় রোগীর প্রকৃত নাম উল্লেখ করা হলোনা।
আমি ডাক্তার নই, তবে স্বাস্থ্য বিভাগে কাজ করি। সেইসাথে একটি মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্র ও রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের সাথেও সম্পৃক্ত। তাদের প্রতিষ্ঠানের একজন অনারারি সদস্য হিসেবে আমাকে সম্পৃক্ত করেছে তারা। কাজটি আমি নিজেও উপভোগ করি। একজন মানসিক সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তিকে দীর্ঘ প্রকৃয়ায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাটা আমার কাছে সবসময়েই চ্যালেঞ্জিং মনে হয়। রোগী সুস্থ হয়ে যখন তার পরিবারের কাছে ফিরে যায় সে সময় তাদের মুখের হাসি আমাদের আনন্দ দেয়, প্রেরণা যোগায়। আমরা নবউদ্যম ফিরে পাই। মনে মানসিক শান্তি অনুভব করি। মানবসেবাই যে জীবনের বড় ধর্ম!
মানসিক রোগাক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে নানাধরনের সমস্যা দেখা যায়। তারমধ্যে অন্যতম একটি রোগ বা লক্ষণ হচ্ছে বিষণ্ণতা। তাদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বেশীরভাগ সময়েই আমর সফল হই। কখনো ব্যর্থতার দায়ভার নিজেদের কাঁধে নিয়ে আবার নতুন উদ্যমে কাজ করা শুরু করি। সে সুবাদে অন্তত পাঁচশতাধিক মানসিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিকে অনেক কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। নাজিফা সেরকমই একজন নারী। আজ তাকে নিয়েই সবার জন্য আমার এই লেখাটি। আশাকরি পাঠকগণ উপকৃত হবেন।
নাজিফা সবেমাত্র কৈশোর পেরিয়েছে। সবসময় হাসিখুশি থাকা উচ্ছল এক তরুণী। কিন্তু ইদিনিং সে আর আগের মত হাসিখুশি থাকছিলোনা। তার জীবনের কোথায় যেন একটু ছন্দপতন ঘটেছে। কোন কিছুর অভাব নেই তার। নাজিফার পিতামাতা তাকে নিজেদের সর্বোচ্চ এবং সেরা সবকিছুই দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে সবসময়। তারপরেও আজকাল নাজিফা একমনে কি যেন ভাবে, খাওয়াদাওয়ায় মন নেই, ঘুমের সমস্যা।
এ বয়সে এক আধটু এমন হয়ই, পাড়াপড়শি আত্মীয়স্বজনদের এমন কথায় নাজিফার বাবা মা বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়েছেন। নিজেদের অজ্ঞতার কারনে তারা বুঝতেই পারেননি এভাবে ধীরে ধীরে নাজিফা এগিয়ে গিয়েছে মৃত্যুর কাছাকাছি। আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে এবং আর একটু হলে প্রায় সফল হয়েছিল বলা যায়। আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকালে বিষয়টি তার মামার চোখে ধরা পড়ে যায় এবং সেই জায়গাটি থেকে তাঁকে উদ্ধার করা হয়।
নাজিফার এই সমস্যাটি একটি মানসিক সমস্যা যা দীর্ঘদিন অজান্তেই সে নিজের মধ্যে লালন করেছিলো। প্রথমে তার পরিবার ভেবেছিলো নাজিফা হয়তো মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু ডাক্তার পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানান যে নাজিফা মাদকাসক্ত নয়। তার সমস্যা হয়েছিলো আসলে অন্যজায়গায়। সে ভাবতো সবাই তাকে অবহেলা করছে এবং এ বিষটি একসময় তাকে অবসাদগ্রস্ত করে তোলে। বিষণ্ণতা রোগে আক্রান্ত হয় নাজিফা।
আমাদের দেশে নারীদের মানসিক চিকিৎসার জন্য আলাদাভাবে খুব বেশী চিকিৎসাকেন্দ্র (ট্রিটমেন্ট সেন্টার) নেই। এর কারন হচ্ছে নারীদের সার্বিক নিরাপত্তা এবং আমাদের সচেতনতার অভাব। দেশের হাতেগোনা কয়েকটি জায়গায় শুধু চিকিৎসা হয়। সেরকমই একটি কেন্দ্রে নাজিফার চিকিৎসা হচ্ছিলো এবং সে এখন ভালো আছে, স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। জীবনকে বুঝতে শিখছে, ভালোবাসতে শিখছে। নিজের মানবিক মুল্যবোধ জাগ্রত হচ্ছে তারমধ্যে।
তার বাবামায়ের ধারণা আমরাতো সবকিছুই তার চাহিদামত দিয়েছি তাহলে নাজিফার এমন মনে হবার কারন কি? কাউন্সিলিং করে ডাক্তার বুঝতে পারেন নাজিফা আসলে বাবামা’র কাছ থেকে কোয়ালিটি টাইম পায়নি। পাঠকদের জন্য কোয়ালিটি টাইম নিয়ে অন্য একটি পর্বে বিস্তারিত লিখবো আশাকরি। শুধু এতটুকু জানুন পরিবারকে সময় দেয়া অত্যন্ত জরুরী। বিশেষকরে উঠতি বয়সি কিশোর কিশোরীর আচরণ প্রত্যেক বাবা মায়ের খুব ভালো করে লক্ষ্য করতে হবে। তাদের সাথে নিত্যদিনের কার্যাবলী যেমন – কোথায় যাচ্ছে কাদের সাথে মিশছে এসব বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে।
(পরের পর্বে সমাপ্য)
২৫টি মন্তব্য
সুপায়ন বড়ুয়া
বিষন্নতা একটা মানষিক ব্যাধি
এর পরিনতি বড় ভয়ঙ্কর।
কিশোর বয়সে সঠিক পরিচয্যা না হলে
হতাশা গ্রস্থ হয়ে আত্নহননে পথ বেঁচে নিতে পারে।
ভাল একটা বিষয় লেখার জন্য।
ধন্যবাদ। শুভ কামনা।
তৌহিদ
অথচ আমরা একে অনেকেই অবহেলা করি যার ফল মারাত্মক আকার ধারন করে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভাই।
সুপায়ন বড়ুয়া
আপনাকে ও ধন্যবাদ। শুভ কামনা।
ইঞ্জা
অবসাদ সে এক অতি বিপদের বিষয়, আপনার ঘটনার মতোই আরেকটি ঘটনা জানি বা শুনেছি অবসাদ গ্রস্থ এক ছেলে আত্মহত্যা করেছিলো যে লটকানো অবস্থায় পা মাটিতে থেকে যাওয়ায় সে নিজের দুই পাকে দুই হাতে ধরে মুড়িয়ে নেয় এবং একি অবস্থায় ওর লাশ উদ্ধার হয়।
আমি বলবো অবসাদগ্রস্ত যে কেউ হতে পারে কিন্তু যদি প্রপার টেইক কেয়ার করা যায় তাহলে অল্পতেই এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, এমন রোগীকে ভুলেও অবহেলা করা যাবেনা।
অসাধারণ পোস্টটির জন্য আপনাকে সাধুবাদ জানাই।
শুভকামনা ভাই।
তৌহিদ
অবসাদগ্রস্ততাও বিষণ্ণতা থেকে আসে দাদা। একে অবহেলা করা মোটেই উচিত নয়। যার ফল মারাত্মক হতে পারে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভাই।
ইঞ্জা
একদম ঠিক বলেছেন ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
আমরা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মানসিক দিকটি ধর্তব্যের মধ্যেই রাখি না।
তার ফল যে ভয়ানক হতে পারে আপনার লেখাটি ই তার প্রমান।
চলুক।
তৌহিদ
একদম ঠিক বলেছেন ভাই। কেউ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হলে তাকে সঠিক পরিচর্যা করতে হবে।
ভালো থাকুন ভাই।
প্রদীপ চক্রবর্তী
সত্যিই বিষণ্ণতা একটি মানসিক রোগ।
কিশোর বয়স থেকে এর পরিচর্যা না করলে তার জীব দুর্বিষহ হয়ে পড়বে।
আর এ বিষণ্ণতা মানুষকে একসময় মৃত্যুের কোলে নিয়ে যায়।
.
ভালো একটা পোস্ট শেয়ার করলেন, দাদা।
তৌহিদ
হ্যা দাদা, কেউ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হলে তার পরিচর্যা করতে হবে।
ভালো থাকুন সবসময়।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
এই বিষয়টি কেউ কখনোই গুরুত্ব দেয় না উল্টো ভিকটিম কেই অন্যায়ভাবে দোষী সাব্যস্ত করে না জেনে, না বুঝে। এই বিষয়টি এখন সরব আকারে প্রচার করা দরকার। ধন্যবাদ ভাইয়া এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় তুলে আনার জন্য। শুভ কামনা রইলো
তৌহিদ
ববিষণ্ণতা নিয়ে কাউকে দোষারোপ করা উচিত নয়। এতে উল্টা ফল হতে পারে।
ভালো থাকুন আপু।
খাদিজাতুল কুবরা
প্রথমেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে
লেখার জন্য।
মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে অনেক শিক্ষিত মানুষ ও সম্যক জ্ঞান রাখেন না।
আশা করছি লেখাটি পড়ে অনেকেই উপকৃত হবেন।
তৌহিদ
পাঠকের উপকারে আসলেই লেখাটি স্বার্থক আপু। মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
ফয়জুল মহী
জনগুরুত্বপূর্ণ একটি বিয়ষ লিখলেন । পরিবেশ এবং পরিবার অনেক সময় দায়ী হই এই জন্য তাই সচেতন হওয়া দরকার
তৌহিদ
সুন্দর বললেন মহী ভাই, ভালো থাকুন সবসময়।
নিতাই বাবু
ভালো একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেন। আসলে পারিবারিক দিক থেকেই উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েদের মানসিক চাপ বাড়তে থাকে। একসময় এই চাপে নিজের পরিবারের প্রতি অনীহা বাড়তে থাকে এবং সেই অনীহা থেকে নিজেকে শেষ করে দিতে প্রস্তুতি নিয়ে থাকে।
তো যাক, দাদা। এটা আমার নিজের উপলব্ধি থেকে জানালাম।
পর্ব চলুক, সাথে আছি।
তৌহিদ
মানসিক চাপ সবাই সহ্য করতে পারেনা। বিষণ্ণ হলে সে মানুষের পরিবারের আদর যত্ন অত্যন্ত প্রয়োজন, অবহেলা নয়।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ দাদা। শুভকামনা রইলো।
আরজু মুক্তা
আমরা এতো ব্যস্ত যে, বাচ্চাদের প্রতি খেয়াল রাখিনা। ওরাও চায় আমাদের সঙ্গ। একটু সহানুভূতি, অবসরে ওদের নিয়ে একটু ঘোরাফির। যেহেতু এখন বাচ্চারা কম সময় পায়। আমাদের উচিত ওদেরকে বন্ধুর মতো সময় দেয়া। ওদের অভাব অভিযোগ শোনা।
তৌহিদ
অবশ্যই আপু। শিশুদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে হবে। ভালো থাকুন সবসময়।
সাবিনা ইয়াসমিন
বিষন্নতা এক ভয়াবহ ব্যাধি। মানবদেহের কাঠামো ঠিক রেখে ভেতর থেকে পুরো মানুষটিকেই এক সময় নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। কিন্তু প্রায় সময়ই দেখা যায় আমরা নিজেদের বিষন্নতা বা মন খারাপ গুলোকে যতটা প্রাধান্য দেই সাথে থাকা মানুষের মন নিয়ে ততোটা ভাবি না। যার ফলাফল পরে খুবই খারাপ হয়ে যায়।
পরের পর্ব জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। তাড়াতাড়ি লিখবেন প্লিজ।
ভালো থাকুন তৌহিদ ভাই। শুভ কামনা 🌹🌹
তৌহিদ
আসলে মন খারাপ বিষণ্ণতা এসবকে আমরা অবহেলা করি যা মোটেও উচিত নয়। এর ফলে একজন মানুষ ডেসপারেট হতে পারে। পরিবার এবং সমাজের সকলের উচিত তার প্রতি যত্নশীল হওয়া।
ভালো থাকুন আপু।
সুরাইয়া পারভীন
এই ভয়াবহ ব্যাধিতে আক্রান্ত অনেকেই অকালে শেষ করে দেয় নিজেদের। আর তাদের পরিবার এর যথার্থ কারণ জানতেই পারে না। সবারই এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত
তৌহিদ
অবশ্যই সকলের সচেতনতাই পারে একজন মানুষকে বিষণ্ণতা থেকে দূরে রাখতে। কাউকে অবহেলা করা মোটেই উচিত নয়।
ভালো থাকুন আপু।
তৌহিদ
অবশ্যই সকলের সচেতনতাই পারে একজন মানুষকে বিষণ্ণতা থেকে দূরে রাখতে। কাউকে অবহেলা করা মোটেই উচিত নয়।
ভালো থাকুন আপু।