বিশ্বসাহিত্যে যে তিনজন সাহিত্যিক হিউম্যানিজম বা মানবতাবাদের জন্য উচ্চপ্রশংসিত তারা হলেন- ‘শেক্সপিয়ার’, ‘ভিক্টর হুগো’ এবং ‘গ্যেটে’। এনারা প্রত্যেকেই সাহিত্যের এক-একজন দিকপাল এবং তাঁরা সকলেই তাঁদের নিজস্ব ভঙ্গীতে নিজস্ব ভাব-কল্পনা অনুসারে মানুষকে প্রতিফলিত করেছেন তাঁদের নিজস্ব সাহিত্যে।
শেক্সপিয়ার রিপু-বিড়ম্বিত, নিয়তি-শৃঙ্খলিত সংসারের সাধারণ মানব জীবনের অপার রহস্যের কবি। আশা-নিরাশা, আনন্দ-বেদনা, লোভ-হিংসা, কাম-প্রেম, স্নেহ-ভালবাসা, শত দুর্বলতা, শত সংকীর্ণতা নিয়ে যে মানুষ আমাদের চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ঘুরছে; যে মানুষের মধ্যে সুধা ও গরল, দেবতা ও দানব, স্বর্গ ও মর্ত্য একসাথে বিরাজ করছে, সংসারের সেই সাধারণ মানুষদেরকে আমরা শেক্সপিয়ারের নাটকে দেখতে পাই।
ধরণীর ধুলির উপর শত অসম্পূর্ণতায় জর্জরিত এই যে মানুষের ক্ষণিক জীবন, তার মধ্যে যে মহত্ব, যে মহিমা লুকিয়ে আছে তার সন্ধানও আমরা পাই শেক্সপিয়ারের নাটকে। মানবজীবনের গূঢ়তম সন্ধান ও অসীম রহস্যের উপরেই তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির ভিত্তি স্থাপিত রয়েছে। তাঁর সাহিত্য বহুপ্রকারের মানুষের বিরাট প্রদর্শনী। তাঁর মিলনান্ত নাটকগুলিতে নর-নারীর আনন্দ ও হাসির ফোয়ারা ছুটেছে। শেক্সপিয়ার রচিত নাটকে যে পরী (Angel)-চরিত্রের অবতারণা করা হয়েছে, তার একটা স্বপ্নময় ভাব আমাদেরকে প্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃত রাজ্যের মধ্যদেশের রহস্যে পৌঁছে দেয় এবং বিয়োগান্ত নাটকগুলিতে মানুষের প্রবৃত্তির বিরাট সংঘাতের মুকুরে নিজেদের ভালো করে চিনে নেবার এক অনন্ত বিস্ময় আমাদেরকে মুগ্ধ করে।
‘হ্যামলেটের’ বিবেক ও কর্তব্যের দ্বন্দ্ব, আত্মীয়-স্বজন পরিত্যক্ত বৃদ্ধ ‘লিয়ারের’ গূঢ় যুক্তিপূর্ণ প্রলাপ, ‘ওথেলোর’ অন্তিম দুঃখ ও অনুশোচনা, ‘ম্যাকবেথের’ বিবেকের দংশন ও অন্তরাত্মার বেদনা, ‘ক্লিওপেট্রার’ মৃত্যুকালীন মর্মান্তিক হতাশায় মনে হয় যেন আমরা এই নিয়তির খেলনা। দেখতে পাই রক্তমাংসের মানুষের অন্তরলোকের অপাররহস্যময় ছবি। শেক্সপিয়ারের সাহিত্যে আমরা দেখি এই সংসারের মানুষের চিরন্তন রূপ।
মানুষের মাঝে বিরাজমান এই বিরাট মানবতা বা হিউম্যানিজম-ই ভিক্টর হুগো’র সাহিত্য-সৃষ্টির মূলমন্ত্র। সমাজের অশেষ নিন্দাভাজন, শত-গ্লানি-জর্জরিত, শত অসম্পূর্ণতায় দুর্বল মানবের মর্মান্তঃপুরে যে অমর সৌন্দর্য বাস করে, সাহিত্যিক ‘হুগো’ নিজের সাহিত্যে সেটিকেই উদঘাটন করেছেন। এটিই মানবতার জয়গান। তাঁর Notre Dame, Les Miserables প্রভৃতি মানব-জীবনের মহাকাব্য। মানুষের চিরন্তন চিত্তবৃত্তির সংঘাত, তার অসংখ্য দুর্বলতা, তার বীরত্ব ও মহত্ত্বের এমন রমণীয় প্রকাশ আর কোন সাহিত্যে আছে কিনা জানিনা।
শেক্সপিয়ার কিংবা ভিক্টর হুগো’র সাহিত্যে সৃষ্ট মানুষ চরিত্রগুলো সংসারের এমন সমগ্র মানুষ, যার মধ্যে মন্দ এবং ভালো, পশুত্ব ও দেবত্ব দুইই বর্তমান। দেবত্ব অর্থে তাঁরা কোন মেটাফিজিক্যাল সত্তাকে মনে করেননি। মানুষের স্বাভাবিক বিবেক, প্রেরণা, জ্ঞান, ধর্মবোধ, সাধুতা, দয়া, স্নেহ, প্রেম, উচ্চতর প্রবৃত্তি- এক কথায় rationalityকেই তাঁরা মানুষের উচ্চতার অংশ মনে করেছেন। এই নিকৃষ্ট ও উচ্চতর বৃত্তির সংগ্রামে মানুষের মনের অনেক রহস্য আমরা দেখতে পাই- মানুষের বিচিত্র রূপ বের হয়ে পড়ে। মানুষকে যেমন বিবেকহীন স্বার্থান্ধ দেখি, আবার কর্তব্যজ্ঞানে স্বার্থ বিসর্জন দিতেও দেখি। একদিকে যেমন ঘৃণা দেখি, অন্যদিকে তেমন প্রেমের প্রসারিত বাহু দেখি।
সুতরাং মানুষ যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, তার পশুত্ব যতই উৎকট হোক না কেন, তার অন্তরের উৎকৃষ্ট অংশটি কখনোই নষ্ট হয় না। এটাই মানুষের গৌরব। এটাই তাঁদের সাহিত্যে সৃষ্ট মানুষ চরিত্র হৃদয়ের শাশ্বত সৌন্দর্য। শেক্সপিয়ার ও হুগোর সৃষ্ট মানুষ চরিত্রগুলো তাই মন্দ-ভালো মেশানো সংসারের বাস্তব মানুষ।
অন্যদিকে সাহিত্যিক ‘গ্যেটের’ জগদ্বিখ্যাত নাট্যকাব্য ‘ফাউস্ট’ এ দেখি মানুষের পরিপূর্ণ আত্মবিকাশের বিজয়াভিজান। মানুষের অন্তর্নিহিত মহত্ত্বের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস- তাদের চিরন্তন মহিমার জয় ঘোষণা। ‘ফাউস্ট’ চরিত্রটি মানবের প্রতীক। ফাউস্ট জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনার দ্বারা জগৎ ও জীবনের রহস্য উদঘাটন করতে ব্যর্থ হয়ে জীবনের নানা অভিজ্ঞতার রসগ্রহণের দ্বারা সত্যদর্শনের আকাঙ্ক্ষা মেটাবার জন্য শয়তানের শরণাপন্ন হল। শয়তান ফাউস্টকে নানা রূপরসের ভোগে একেবারে আবৃত করে রাখল। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন ইন্দ্রিয়ভোগে তার বিন্দুমাত্র আনন্দ লাভ হলো না। জ্ঞানমার্গেও তার যেমন ব্যর্থতা এসেছিল, ভোগমার্গে তার চেয়েও বেশি ব্যর্থতা ও বেদনা উপস্থিত হল। ফাউস্ট বুঝলো, চিরন্তন সত্য-লাভের ক্ষমতা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ‘ফাউস্ট’ এ সাহিত্যিক ‘গ্যেটে’ বলতে চেয়েছেন- মানুষ কেবল এই সত্যলাভের আদর্শকেই বুকে লালন করে জীবন পথে চলবে। এই আদর্শ লাভের সাধনাতেই তার জীবনের পূর্ণতা, তার চরম আত্মোন্নতির সম্ভাবনা।
যে মানুষ এই চরম সত্য ও রহস্যলাভের আদর্শকে জীবনের একমাত্র ধ্রুবতারা করে জীবনপথে অগ্রসর হয়, কোন নৈতিক বা চারিত্রিক স্খলন-পতন বা কোনো সামাজিক কলঙ্ককালিমা তার অন্তর্নিহিত চরিত্র-গৌরবকে, তার চিরন্তন পবিত্রতাকে, তার দিব্য সৌন্দর্যকে ম্লান করতে পারে না।
মানুষ চিরন্তন সত্যান্বেষী। এই অন্বেষণের মধ্যে বিচিত্র ভালোমন্দ অভিজ্ঞতা এক-একটা স্তর মাত্র। তার পরিপূর্ণ সত্তার সাথে এদের কোন অচ্ছেদ্য সম্পর্ক নেই। মানুষের স্খলন পতন ত্রুটি তার জীবনের সত্য নয়, সেগুলো জীবনের এক-একটা আকস্মিক ঘটনা মাত্র। যার ফলস্বরূপ যে চিরন্তন মহান মানব চরিত্র ফুটে বের হয় তাই মানুষের স্বরুপ।
‘শেক্সপিয়ার’, ‘ভিক্টর হুগো’ এবং ‘গ্যেটে’এই তিনজন সাহিত্যের দিকপাল মানবতার জয়ধ্বজা তাঁদের সাহিত্যসৃষ্টির মূলে প্রোথিত করেছেন। তাঁরা মানব-প্রকৃতির সত্যদ্রষ্টা ঋষি- মানবজীবনের মহাসংগীতের উদগাতা। একটি বিরাট হিউম্যানিজমই তাঁদের সাহিত্যের সম্পদ। তাই তাঁদের রচিত সাহিত্যগুলোকে এই পৃথিবীর সাধারণ খন্ড-অখন্ড, অপূর্ণ-পূর্ণ, পশু-দেব মানুষের জীবনবেদ।
‘সাহিত্য মানবতার জয়গান’- এতেই ‘শেক্সপিয়ার’, ‘গ্যেটে’ এবং ‘ভিক্টর হুগো’র সাহিত্য কাব্য-প্রতিভার বিকাশ হয়েছে বহুমুখী এবং সাহিত্য সৃষ্টিতে এসেছে বিপুল বৈচিত্র্য। কাব্যে, সঙ্গীতে, গল্পে-উপন্যাসে, নাটকে, কথিকায়, প্রবন্ধে- শত রূপ-রসে শত ভঙ্গিতে হয়েছে তাঁদের আত্মপ্রকাশ।
১২টি মন্তব্য
সাদিয়া শারমীন
অনেক কিছু জানলাম।ভালো লেগেছে লেখাটি।
তৌহিদুল ইসলাম
পড়ার জন্য ধন্যবাদ, শুভকামনা জানবেন।
সাবিনা ইয়াসমিন
পৃথিবী বিখ্যাত তিনজন সাহিত্যিক এর ব্যাক্তি সত্তা এবং ব্যক্তিত্ব অনেক চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করেছেন। ব্যক্তি এবং তার সাহিত্য/সাহিত্যভাবনা প্রায়শই এক রকম হয় না। একজন লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের প্রভাব তার লেখায় যৎসামান্য পড়ে। ব্যক্তি পরিচালিত হয় পরিবার পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে, কিন্তু ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে কর্মে, মনোভাবে, সাহিত্যে, দর্শনে। আপনার পোস্টে উল্লেখিত বিশ্ব বিখ্যাত এই তিনজনের ব্যক্তিজীবন এবং সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব আলাদা। তারা ব্যক্তি জীবনে যতটা সমালোচিত হয়েছিলেন/এখনো হোন, তার চাইতেও আলোচিত হয়েছেন তাদের সৃষ্টিতে। তাদের সাহিত্যিক মেধা,রস,দর্শন, ভাবনার বিস্তৃতি সবকিছুই মানুষের মনে ভাবনার রসদ যুগিয়েছে। মানুষ তাদের নিয়ে পড়তে লিখতে নিজের মতো গবেষণা করতে ভালোবাসে।
অনেকদিন পর খুব সুন্দর একটা পোস্ট দিয়েছেন।
ভালো থাকুন, শুভ কামনা অবিরাম 🌹🌹
তৌহিদুল ইসলাম
লেখকের ব্যক্তিজীবন এবং সাহিত্যকর্ম আসলেও এক্নিয়। দুটি আলাদা সত্তা। পাঠক হিসেবে আমাদের সাহিত্যসত্তাকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত। মন্তব্যে পুরো লেখার মূলভাব ফুটিয়ে তুলেছেন। অনেক ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন আপনিও।
মনির হোসেন মমি
তাদের মধ্যে সেক্সপিয়ার সম্পর্কে কিছুটা জানতাম।বাকী দুজনের নাম শুনেছি বিশদভাবে জানা হয়ে উঠেনি।জানলাম অনেক কিছুই।ধন্যবাদ প্রিয়।
তৌহিদুল ইসলাম
মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ ভাই, সুযোগ পেলে এঁদের নিয়ে আরো লিখবো। ভালো থাকুন সবসময়।
প্রদীপ চক্রবর্তী
বাহ্!
তাঁদের নিয়ে অসাধারণ উপস্থাপন করলেন, দাদা।
সাহিত্যে কত বিশাল আসলে তা আমরা অনুভব করতে পারিনা। তাঁদেরকে জানলে আমরা সাহিত্যকে জানতে পারি।
সত্যি খুবি ভালো লাগলো দাদা লেখাটা পড়ে।
তৌহিদুল ইসলাম
পড়েছেন দেখে ভালো লাগলো দাদা। আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
হালিমা আক্তার
সাহিত্যের তিন দিকপাল কে নিয়ে চমৎকার উপস্থাপন। শেক্সপিয়ার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকলে ও অন্যদের সম্পর্কে তেমন জানা ছিল। অনেক কিছু জানা হলো। শুভ কামনা রইলো।
তৌহিদুল ইসলাম
মনোযোগী পাঠকের এমন মন্তব্যে উৎসাহিত হলাম আপু। ভালো থাকুন আপনিও।
আলমগীর সরকার লিটন
সাহিত্যের তিন দিকপাল নিয়ে চমৎকার লেখেছেন তৌহিদ দা
ভাল থাকবেন—–
তৌহিদুল ইসলাম
অনেক ধন্যবাদ ভাই। শুভকামনা জানবেন।