রাতভর ঘুম হয়নি প্রদীপের।বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতেই অস্বস্তিতে রাতটা কোনরকম কাটল তার।বড় বাজারের বড় মাছের আড়তের পশ্চিম দিকে কলোনি বলে লোকমুখে প্রচলিত এক পাড়ায় বিশ্রী পরিবেশে থাকতে হত প্রদীপকে।জেলা ওই শহরে নিকটাত্মীয় না থাকায় তাকে বেশ বেকায়দায় পড়তে হয়েছিল একমোডেশন(থাকা-খাওয়া)সংক্রান্ত বিষয়ে।নিরুপায় হয়ে মন্দের ভাল সিদ্ধান্তে ওই জায়গাটাতেই উঠতে হয়েছিল।ভীষণ বইপড়ুয়া প্রদীপের ওই গিঞ্জি পরিবেশে থেকে আর সহ্য হচ্ছিল না।একটি বাসায় সাবলেট হিসেবে যে কক্ষে থাকত তার সিংহভাগ দখল করে নিয়েছিল তার একাডেমিক বইপত্র,রেফারেন্স বইপত্র,মাসিক বিচিত্রা ও অন্যান্য।ওই শহরে আসার আগে প্রদীপ কোলাহল মুক্ত,নিরিবিলি পরিবেশে উচ্চশব্দে পড়াশোনা করায় অভ্যস্ত ছিল।তার ওই স্বস্থির উচ্চশব্দ কম আসবাবপত্রের ঘরে প্রতিফলন করবে এমন ব্যবস্থার অন্বেষণে ছিল প্রদীপ।তার এক ইয়ারমেট তথা বন্ধু,সুনীল তাকে নতুন বোডিং ব্যাবস্থা করে দেয়ার কথা বলেছিল।যদিও সুনীলের সাথে ততটা সখ্যতা তখনো গড়ে উঠেনি তার,তবুও তার কথাতে যারপরনাই আস্থা রেখেছিল।
সাতসকালে তার মুঠোফোন বেজে উঠল।সুনীলের নাম মোবাইলের স্ক্রিনে দেখে সহসা রেসপন্স করল প্রদীপ। নতুন বোডিংয়ের ঠিকানা জানিয়ে সুনীল প্রদীপকে বোডিংয়ের নিকটেই এক পরিচিত কর্নারে আসতে বলল।রাতের নিদ্রাহীনতার ছায়া মূহুর্তের মধ্যেই গেল সরে প্রদীপের মুখমন্ডল থেকে।অন্তত ভালো পরিবেশের নিশ্চয়তায় নতুন বোডিংয়ে উঠতে পারবে ভেবে সে প্রসন্ন হচ্ছিল।৩০ মিনিটের মধ্যেই সেই কর্নারে উপস্থিত হয়ে সুনীলকে অপেক্ষমান দেখতে পেল প্রদীপ।সুনীলের পশ্চাদপসরণ করে প্রদীপ বড় সাইনবোর্ডে লিখা নূর মার্কেটের দোতালায় একটি বিশেষ কামরায় প্রবেশ করল।পরিপাটি কামরায় ত্রিশোর্ধ এক ব্যক্তি বসা ছিলেন হেলানো কেদারায়।সুনীলের সহিত উনার হাস্যরস উদ্দীপক বাক্যবিনিময়ের সময় কিছু তথ্য বের করে নিল প্রদীপ।তন্মধ্যে উনার নাম কাইয়ুম,উনি এখানকার তত্বাবধায়ক,উনি নিচ তালার সব দোকান,উপরের সব বোডিং,কামরা,স্টোর রুমের ভাড়া দেয়ার দ্বায়িত্বে ও মাসিক ভাড়া নিয়মিত সংগ্রহের দ্বায়িত্বে রয়েছেন।কাইয়ূম ভাই হাসিমুখে কুশলাদি বিনিময় করে নিলেন প্রদীপের সহিত।অতঃপর নীলচে-সবুজ বোর্ডে ঝুলানো চাবিগুলো থেকে ১২ নাম্বার কক্ষের চাবি সমেত দুজনকে নিয়ে চললেন কক্ষটি দেখাবেন বলে।কক্ষটি খোলতেই এলোমেলো কিছু কাগজ,এক পা ভাঙা একটি টেবিল সেখানে পড়ে থাকতে দেখা গেল।সুনীলের যে বেশ পরিচিত ওই জায়গাটি,সেটা সুনীলের আকার ইঙ্গিতের মাধ্যমেই বুঝতে পারল প্রদীপ।প্রদীপ থাকার জন্য মনে মনে কক্ষটি ঠিক করে নিল প্রাথমিকভাবে বিচার বিবেচনার পরখ করে।জানা গেল আরো একজন এখানে উঠবে।তার সাথে ভাগাভাগি করে এই কক্ষে থাকতে হবে।প্রথমে এই ব্যাপারে নিমরাজি হলেও পরক্ষণেই ভাড়া চূড়ান্ত করে সেখানে থাকার কথা সুনীলকে দিয়ে কাইয়ুম ভাইকে বলে সুনিশ্চিত করে নিল প্রদীপ।প্রদীপের পড়াশোনার পরিবেশ আগের চেয়ে বেশ ভাল হবে ভেবে বদনে হাসির ভূগোল বিস্তৃত হল।অন্তত আগের গিঞ্জি পরিবেশ থেকে সে রেহাই পাচ্ছে ভেবে স্বস্তিও বোধ করছিল।প্রদীপ ভীষণ পড়ুয়া,একাডেমিক পরীক্ষায় প্রথম/দ্বিতীয় হওয়ার মাঝেই অনাবিল সুখ খুজে বেড়াত।সহসা সুনীল হাতে চেপে প্রদীপকে ওই কক্ষেরই সংযুক্ত আরেকটি কক্ষে প্রবেশ করাল।সাথে যোগ দিল সুনীলের অন্য এক বন্ধু,নীলয়(প্রদীপের অপরিচিত) ওই কক্ষেই।সুনীল প্রদীপকে তার অন্য বন্ধু নীলয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলছিল সেই হবে তার রুমমেট।তবে কিছুটা সংকিত হয়ে পড়ল প্রদীপ সংযুক্ত ওই কক্ষের দেয়ালে টাঙানো কিছু নিশ্চল ছবি,কক্ষের এক পাশে বড় টুলে রাখা ব্যানার,ফেস্টুন,পোস্টার,টেবিলে থাকা কয়েকটি রেজিস্ট্রার দেখে।তিনটি ছোট-বড় টেবিল,অনেকগুলো চেয়ার থরেথরে সাজানো ছিল সেখানে।সুনীল রহস্যময় হাসিতে প্রদীপের কৌতুহল বুঝার চেষ্টা করছিল।প্রদীপ দেশ-বিদেশের সমাচার ততটা না রাখলেও এতটুকু বুঝে নিতে পারল যে ওই কক্ষটি হবে নিশ্চয়ই সমাজতান্ত্রিক
দলের রাজনৈতিক কার্যালয়।সে কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়ল এমনাবস্থায়।একদিকে কাইয়ুম ভাইকে ১২ নং কক্ষে থাকার কথা দিয়ে দিয়েছে,তথাপি সংযুক্ত ১৩ নং কক্ষ পার্টি অফিস যেখানে দলীয় লোকদের আনাগোনা থাকবে।রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে সর্বদা বিরত থাকার জন্য তার বাবা তাকে প্রায়শই মুঠোফোনে বলেন।সে নিজেও তার পাঠাভ্যাসের ব্যাঘাত ঘটবে বলে ওইসবে জড়াতে চাইত না।তাহলে ভাল পরিবেশের নিশ্চয়তায় সুনীল তাকে কোথায় নিয়ে এল!সুনীল যে বেশ সেয়ানা প্রদীপ সেটা ফের বুঝে নিল তার কথাবার্তায়।কনভিন্স করার জন্য সুনীল বলছিল প্রদীপকে এটা মূলত বামধারার রাজনৈতিক দলের কার্যালয়।বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করে ওই দলটি।সুনীলের স্নিগ্ধ সুন্দর সকাল,মেঘলা বা রোদ্দুর দুপুর,সোনালী বিকেলের অধিকাংশ সময় ওখানেই কাটে। পড়ালেখার কোন ব্যাঘাত ঘটবে না বরংচ আরো ভাল হবে কিছু জ্ঞানী,প্রজ্ঞাবান, সৃষ্টিশীল,উদীয়মান মানুষদের সন্নিকটে পড়াশোনার অবসরে আসার কারনে।আর প্রদীপের মেধার বিনা পরীক্ষায় প্রদীপের লাগামহীন তারিফ করতে লাগল সুনীল ও নীলয় উভয়েই।প্রদীপকে ওই পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়ার সকল আয়োজন করেছিল সুনীল।সুনীলের মন,মগজ প্রদীপের মত বন্ধুকে হাতছাড়া করার বোকামি দেখাতে নারাজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই জনে জনে,জোড়ায় জোড়ায় লোক আসতে লাগল ওই কক্ষে।প্রদীপ প্রস্থান করতে চেয়েছিল আপাদত।কিন্ত সুনীল,নীলয় দুজনেই সনির্বদ্ধ অনুরোধে প্রদীপকে আরো কিছু সময় ধরে রাখল।অনেকটাই ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে সেখানে অবস্থান করছিল প্রদীপ।সেদিন ছিল ভাষা দিবস।তাই ভাষা দিবসের গুরুত্ব শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান নির্ধারিত ছিল।ঘড়ির কাটায় সকাল ১১ বাজল তখন।সিনিয়র কয়েকজন নেতৃবৃন্দ ও অন্যান্য অনুসারীরা উপস্থিত হয়েছিলেন এরই মধ্যে।আলোচনা অনুষ্ঠান সুনীলের উপস্থাপনায় শুরু হতে দেখে প্রদীপ আশ্চর্যান্বিত হয়ে পড়ল।আরো অবাক হল সুনীলের উপস্থাপনার শৈলী দেখে।তখন প্রদীপের আরেকটু থেকে যাওয়ার ইচ্ছা বোধ হল।সিনিয়র নেতৃবৃন্দের নাতিদীর্ঘ বক্তব্য প্রদীপকে অনেকটা কাছে টেনে নিল মোহিনীশক্তিতে।আলোচনা অনুষ্ঠান যখন শেষপ্রায় তখন প্রদীপকে সবার সাথে সুনীল পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল।সুনীল খুব গর্ববোধের সাথে প্রদীপকে লাইমলাইটে আনার প্রয়াস করছিল।আগামীর পার্টি অফিস প্রদীপ আরো রাঙিয়ে দিবে বলে আশ্বাস দিচ্ছিল সুনীল।এসব শুনে প্রদীপ যেন থ!এমতাবস্থায় সুনীল ভাষা দিবসের গুরুত্ব শীর্ষক আলোচনার জন্য প্রদীপের দিকে মাউথ স্পিকার বাডিয়ে দিল সবার সামনে।বিচলিত প্রদীপ যেন খেই হারিয়ে ফেলল।কখনো কোনদিন এইভাবে বড়দের সামনে কিছু বলার প্রয়াসই যেখানে করেনি সেখানে কিনা ভাষা দিবসের উপর কথা বলবে।এ যে সোনার পাথরবাটি তার জন্য।কিন্ত সবার আগ্রহে তাকে মাউথ স্পীকার নিতে হল।প্রদীপ পড়াশোনায় বেশ ভাল হলেও এক্সট্রা কারিকুলার কর্মকাণ্ডে কম জড়ানোর জন্য সে তার জড়তা আবিষ্কার করতে পারল তখন।অনেক কিছুই বলতে গিয়েও কিছুই যেন বলতে পারছিল না প্রদীপ।তার এই জড়তা যেন তাকে ভিতরে চেপে ধরে রেখেছিল।প্রদীপ সুনীলের মত করে এতটা সাজিয়ে ঘুচিয়ে বলতে পারছিল না তাই অপ্রস্তুত বক্তব্যতে আছমকা ছেদ দিল।কিন্ত তার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর সবার উৎসাহব্যাঞ্জক করতালি আর সুনীলের হাস্যোজ্বল মুখ তাকে উৎসাহিত ও সম্মানিত করেছিল বহুলাংশে।সুনীলের জ্ঞান ও বাগ্মিতার বাতিঘরের আলোয় আলোকিত হতে চাইল প্রদীপ।সুউচ্চ সুনীল আকাশের সুগভীর নীলাভ রঙে রাঙানো অসম্ভব বটে তবে বন্ধু নিশ্চয়ই উদারতা দেখাবে সেখানে।তাইতো ফেরার পথে সুনীলের জিজ্ঞাসায় প্রদীপ জানাল আগামী মাসে নয় আগামীকাল থেকেই উঠতে চায় বোর্ডিং এ।
১৮টি মন্তব্য
নীরা সাদীয়া
আপনার গল্পের শিরোনামটা নজর কাড়ে, পাঠককে উৎসাহিত করে।
অন্যান্য ভাষা থেকে অনেক শব্দ বাংলায় যোগ হয়েছে এবং এগুলো আমাদের ভাষার সাথে মিলেমিশে গেছে। তাই আমরা চাইলেও সেগুলোকে অনুবাদ করে লিখতে পারি না। যেমন: চেয়ার=কেদারা, স্কেল=মাপকাঠি ইত্যাদ। তথাপি যতটা সম্ভব বাংলা গল্পে বাংলাভাষাটা ব্যবহার করলে খুব ভালো হয়। রেসপন্স, একমোডেশন ইত্যাদি শব্দগুলো পড়তে একটু খটকা লাগে, হয়ত আমার জ্ঞান সীমিত বলে।
গল্প ভালো এগুচ্ছে। আপনি চালিয়ে যান।
পার্থ সারথি পোদ্দার
ধন্যবাদ আপু।আপনার কথা যৌক্তিক।আগামীতে প্রচেষ্টা থাকবে।
আপনার প্রতি শুভ কামনা রইল।
আরজু মুক্তা
গল্প কি আরও চলবে?
এতোটুকু ভালো লাগলো
পার্থ সারথি পোদ্দার
ধন্যবাদ,মুক্তা আপু।গল্পটা আরো এগিয়ে নিতে চাই।
ফয়জুল মহী
অনুপম, অতুলনীয় লেখা।
পার্থ সারথি পোদ্দার
ধন্যবাদ,ভাই সাথেই থাকার জন্য।শুভ কামনা রইল।
সুপায়ন বড়ুয়া
শিরোনামে বাজিমাৎ
মাঝে মাঝে এই রকমই হয়।
সাহস করে দাঁড়ালে ভালই বলা যায়
তাই সাহস রাখতে হয়।
ভাল লাগলো। শুভ কামনা।
পার্থ সারথি পোদ্দার
দাদা,আপনার ভাল লাগার এই অনুভূতি আমায় উৎসাহ যোগাচ্ছে।একদম সঠিক কথা বলেছেন আপনি।শুভ কামনা রইল।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
এক শিরোনামেই গল্পটি বলে দিলেন। আপনার গল্পের বিষয়বস্তু অসাধারণ। আরো লিখুন দাদা। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন। শুভ সকাল
পার্থ সারথি পোদ্দার
চেষ্টা করেছি গল্পটা ফুটিয়ে তুলতে।গল্পের বিষয়বস্তু জীবন থেকে নেওয়া তাই হয়তো কিছুটা পেরেছি।আরো এগিয়ে নিতে চাই গল্পটি।আশা করছি পাশেই পাব।শুভ সকাল,দিদি।
প্রদীপ চক্রবর্তী
অসাধারণ লাগলো দাদা।
পার্থ সারথি পোদ্দার
ধন্যবাদ,প্রদীপ দাদা।আপনার জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা রইল।
জিসান শা ইকরাম
প্রদীপ যুক্ত হয়ে গেলো সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে,
তার পড়াশুনার জন্য চিন্তা হচ্ছে।
ভালো লেগেছে গল্প,
শুভ কামনা।
পার্থ সারথি পোদ্দার
ভাই অসংখ্য ধন্যবাদ গল্পটির উপর আপনার মনোনিবেশের জন্য।প্রদীপ নানা কাহিনিতে ঘুরপাক খেতে যাচ্ছে,ভাই।শুভ কামনা রইল।
মাহবুবুল আলম
গল্পটা ভাল লেগেছে। আরও লেখা পড়তে চাই।
গল্পের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে ভাল লাগলো!
শুভেচ্ছা জানবেন!
পার্থ সারথি পোদ্দার
আপনার ভাল লাগার এই অনুভূতি আমাকে প্রীত করল।আরো আসছে।আশা করি পাশেই পাব আপনাকে।অনেক অনেক শ্রদ্ধা ও ভালবাসা আপনার প্রতি রইল।
তৌহিদ
সুন্দর গল্প পড়লাম দাদা। ভালো থাকুন সবসময়।
পার্থ সারথি পোদ্দার
আপনার মন্তব্য আমাকে আরো বেগবান করবে।
অনেক অনেক ভালবাসা রইল,তৌহিদ ভাই।