আজ বসন্তের শুরু। শেষ বিকেলের পড়ন্ত রোদটুকু উত্তাপহীন। তবুও ঘোর লাগা এক ভালোলাগা নিয়ে বসে থাকে রাতুল। অকারনেই ফোনটা অন করে…অফ করে… আবার অন। জ্বলে উঠা আলোটুকুর দিকে চেয়ে থাকে। হোমস্ক্রিনে তানি’র হাস্যোজ্বল ছবি। মেয়েটিকে কখনো খুব কাছের মনে হয়। আবার কখনো অনেক অনেক দূরের।
দুর্দান্ত এক ভালোবাসার গল্প ছিল তাদের। কথা ছিল, তারা একসাথে বুড়ো হবে…একজন অন্যজনকে হুইলচেয়ার ঠেলতে সহযোগিতা করবে…অসুধ খেতে, নিয়ম মেনে খাবার খেতে শাসন করবে। একজন অসুস্থ হলে অন্যজন শিয়রে বসে কপালে আলতো হাতের পরশ দিবে… কবিতা শুনাবে। এমন অনেক কিছুই কথা ছিল। দুই জোড়া চোখে অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু কথা রাখেনি তানি। চলে গেছে দূরে… দূরের সেই মেয়েটির মতোই। এ যাওয়া ইচ্ছাকৃত ছিল না। নিয়তি তাকে নিয়ে গেছে অনন্তকালের জন্য, রাতুলকে নিঃস্ব করে অনন্ত প্রহরের অপেক্ষায় রেখে…
নির্বিকার রাতুল। কিছুকাল থেমে থাকা পৃথিবী আবার চলতে শুরু করে। শোকের পাথর একটা সময় কেটে টুকরো টুকরো হয়। অন্ধকার, নিস্তব্দতা একটু একটু করে সরে যায়। যদিও কখনো কখনো মানতে চায় না, বিশ্বাস হতে চায় না__ তানি সত্যিই চলে গেলো তাকে একলা করে ধরা ছোঁওয়ার বাইরের জগতে ! অসময়ে অসুখটা শরীরে বাসা না বাঁধলেই কি হতো না ? এই বিচ্ছেদ বড় বেশি নির্মম হয়ে গেলো না ? দু’জন মানব মানবীর প্রতি বিধাতার বড় বেশি অবিচার হয়ে গেলো না ? রাতুল আকাশের দিকে তাকায়। দীর্ঘশ্বাস নেয়। জীবন বিধাতার প্রতি তাঁর অনেক প্রশ্ন…
রাতুলের দৈনন্দিন জীবনে তানি ফিরে ফিরে আসে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত__
খুব ভোরে এলার্মক্লকটা বেজে উঠলে লাফিয়ে উঠে হন্তদন্ত হয়ে রেডি হয়, অফিস যায়। ভোরের হাল্কা জাম ঠেলে ফুরফুরে মনে যাবার সময় পাশ কাটিয়ে যাওয়া রিক্সায় দু’জন মানুষের সেলফি তোলা দেখে নিমিষেই পেছন কালে ফিরে যায়___তাঁর পাশেই তানি বসে বক্বক্ করেই যাচ্ছে…রাতুল সেলফি তোলে, ভিডিও করে। হঠাৎ রিকশাওয়ালা মামা বলে উঠে, “স্যার নামবেন না ?” রাতুল চম্কে উঠে, বর্তমানে ফিরে আসে। ভাড়া মিটিয়ে অফিসের দিকে ছুটে…
বিকেলে বাসায় ফিরে ল্যাপটপ অন করেই হোমস্ক্রিনে তানির হাস্যোজ্বল ছবিতে চোখ আটকে যায়। আনমনে বলে উঠে, “তুই এত্তো হাসিস ক্যান শয়তান… হাসতে হাসতেই হারাইয়া গেলি ক্যান চুন্নি… জানিস না, তোরে ছাড়া আমার একলা লাগে… খু-উ-ব একলা…” মনিটরের ভেতর থেকে তানি যেন বলে উঠে, ” কিরে, তোর কাজ নাই?… ভুঁড়ি বাড়ছে, খবর নাই ?… সব্জি খা… মাংস টাংস খাইস না যেন…” রাতুল চুপ হয়ে যায়। থম্কে থাকা পাহাড়ের মত স্থির হয়ে থাকে। অন্ধকারে অন্ধভাবে ঘরময় পায়চারী করে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। রাত ঘনায়। গান বাজে…”দু’চোখের আঙিনায়, এঁকেছি সীমানা… বল না পালাবে কোথায়…”তানি রাতুলের ভাবনায় ছন্দপতন করে বলে উঠে__ পালাই নাই তো, ফাজিল… দেখোস না এইখানে চুপটি করে বসে আছি…। রাতুল আচ্মকা পিছু ফিরে। চোখ আঁটকে যায় এলার্মক্লকে ! ইস্ লেইট হয়ে যাচ্ছে। ভোরেই যে আবার উঠতে হবে ! ল্যাপটপ অফ করে, খেয়ে, ফ্রেশ হয়েই ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেয়। নিদ্রাদেবী আসতে দেরী হয়। নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিঃশব্দ হলে কি হবে ! দেয়াল তো শুনেই ফেললো ! চার দেয়াল ! দেয়ালেরই বা কি দোষ… তার গায়ে রাত গভীরে আছ্ড়ে পরে যদি কারো দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস ?
অন্যদিনের কথা। বৈকালিক রিক্সা ভ্রমনে যায় রাতুল। যাবার পথে ঝুম বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির ছিটা আর ঝরো বাতাস মাখামাখি হয় তাঁর মুখে, চুলে, শরীরে। চট করে অজান্তেই ফিরে যায় স্মৃতির পাতায়, যখন তানি ছিল সেথায়। সেই দুনিয়ায়… যেই দুনিয়ায় রাতুল থাকে এখন। তানি বলে উঠে, ” ইস্ ভিজেই গেলো শখের জামাটা !” রাতুল ব্যস্ত হয়ে উঠে… বলে, “আহ্ মামা, তাড়াতাড়ি পর্দাটা দেন তো !” ঠিক সেই সময়ে আচমকা রিক্সা থামিয়ে কেউ একজন বলে উঠে, “স্যার, ভিইজ্জা গেলেন তো… পর্দা নিবেন না?… লন, পর্দা লন…” রাতুল চম্কে উঠে। ফিরে বর্তমানে। বলে, ” তাই তো… ভিজেই গেলাম…
আজ তানির জন্মদিন। রাতুল বিক্ষিপ্ত ভাবে সেই নদীটির ধারে হাঁটে একাকী। অর্থহীন ভাবে আকাশে তাকায়। ছিন্ন ছিন্ন মেঘের ভেতর থেকে অনেক নীল উপ্চে পরে। অনেক তারায় খুঁজে… কোন তারাটি তানি ? খণ্ড মেঘের আড়াল চিরে হেসে উঠে কেউ। বলে উঠে, কিরে কাম নাই তোর?… আকাশের তারা গুনোস্ ?” রাতুল বলে, ” তোর চোখ দুইটা খুব সুন্দর রে… দৃষ্টি কলিজায় গিয়া বিঁধে।” তানি কথা ঘুরায়, বলে… খাবি না?… কখন খাবি ?” রাতুল বিষণ্ণ হয়। চোখ জোড়া ঝাপসা হয়। অভিমানে বলে উঠে, “খামু না… ভালা লাগে না… তোরে ছাড়া কিচ্ছু ভালা লাগে না”। তাঁর চোখ বেয়ে ঝরঝর করে নায়াগ্রা জলপ্রপাত বইতে থাকে…
রাতুলকে আর বলা হয় না তানি’র___ এইখানে, এই আকাশে তোরে ছাড়া আমারও কিচ্ছু ভাল লাগে না… একলা লাগে… খু-উ-ব একলা…
১২টি মন্তব্য
মেহেরী তাজ
🙁 কি হয়েছিলো তানির?
মনে ধরার মত ছোট গল্প……
মনে ধরেছে।
রিমি রুম্মান
তানির মত কিছু তরুণী অল্পবয়সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে মারা যায়। যাদের চোখ ভরা স্বপ্ন ছিল আর দশজনের মতই। স্বপ্নগুলো ডানা মেলবার আগেই হারায় দূরে… অনেক দূরে।
জিসান শা ইকরাম
অসাধারন
খুবই মন খারাপ এক অনুভুতি
বারবার বর্তমান এসে সুখ স্বপ্নকে নষ্ট করে দেয়……
বাস্তবে এমন কিছু অবস্থার কথা জানি আমি
কেন এমন হয়?
রাতুল হয়ত তানির কাছেই চলে যাবে একদিন।
আপনি ভালো লেখেন,এটি অবশ্য নতুন কথা নয়।
রিমি রুম্মান
আপনি বরাবরই আমার লেখার প্রশংসা করেন। এমন মন্তব্যে অনুপ্রানিত হই। লিখি আপনাদের জন্যই। ভাল থাকুন সবসময়।
খেয়ালী মেয়ে
উফফফফফ্ এমনটা কেনো হয় সব সময় বাস্তব আর স্বপ্নের মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব–কিছু মানুষ দুচোখ ভরে স্বপ্ন দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায়–আর সেই স্বপ্নগুলো প্রতিটি মুহুর্তে তার অস্তিত্বের জানান দিয়ে কষ্ট দিয়ে যায়–আজব দূরে গিয়েও রয়ে যায় খুব কাছে 🙁
রিমি রুম্মান
কিছু গল্প নিয়ে ক্যামেরার পেছনে কাজ করার সাধ জাগে। এটিও এমন একটি গল্প।লেখায় হয়তো সেভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারিনি, যেমনটি ভেবেছি।
ছাইরাছ হেলাল
রাতুলের যন্ত্রণা তুলে এনেছেন দক্ষ শিল্পীর তুলির আলতো আচড়ে।
রিমি রুম্মান
শুভেচ্ছা নিরন্তর।
ব্লগার সজীব
মন খারাপ হয়ে যায় আপু এমন লেখায় 🙁
রিমি রুম্মান
লেখায় ছোট ছোট আনন্দের সাথে দুঃখও আছে। জীবনটা তো সুখ দুঃখ মিলিয়েই। ভাল থাকুন।
স্বপ্ন
লেখাটি পড়ে কেমন এক বিষণ্ন্নতা,হাহাকার,শুন্যতা এলো মনে আপু।
রিমি রুম্মান
লেখার মাঝে কারো মনের ভেতরে নাড়া দিয়ে যাওয়া__ এটিই লেখকের লেখার সার্থকতা। শুভকামনা নিরন্তর।