ঘোমটা মাথায় ভীরু নয়নে এদিক ওদিক তাকিয়ে যে মেয়েটি অতি সন্তর্পণে শ্বশুরবাড়ি পদার্পণ করে, সে-ই একদিন মা হয়ে উঠে। অতঃপর কালের পরিক্রমায় শাশুড়ি হয়। বলছিলাম বউ-শাশুড়ি সম্পর্ক নিয়ে। যে সম্পর্কটি চিরকালই একরকম জটিলতার মধ্য দিয়ে যায়। এই জটিলতা একরকম ব্যাধির মতো। একাধিক গবেষণা থেকে জানা যায়, বউ-শাশুড়ি সম্পর্ক বিশ্বের প্রায় সব দেশেই একই রকম। কেন এই বৈরি সম্পর্ক ? আমার চেনা জানা অনেক নারীকেই দেখেছি, স্বামী শুধুমাত্র তার দিকেই মনোযোগী থাকুক, এমন মনোভাব পোষণ করেন। বাবা-মা, ভাই-বোনের জন্যে দেশে টাকা পাঠালে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন। ভুলে যান যে তার স্বামীকে কে জন্ম দিয়েছেন ? পেলে পুঠে আজকের অবস্থানে এনে দিয়েছেন ? বাবা-মা, ভাইবোনের প্রতি তার কি কোন কর্তব্য নেই ? এ প্রসঙ্গে অনেক আগের দুটি ঘটনা মনে পড়ে গেল।
এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে ছোটখাটো পার্টি চলছিল। শিশুরা এঘর ওঘর ছুটোছুটি করছিল। পুরুষরা ড্রয়িং রুমে, আর নারীরা ভেতরের রুমে গল্পে মশগুল। অতিথিদের মধ্য থেকে এক বন্ধুপত্নী বলছিলেন তার শাশুড়ির কথা। শাশুড়ি খুব ভালো মানুষ। বিয়ের পর যে কয়দিন দেশে ছিলেন, তিনি নতুন বউকে খুব আদর, স্নেহ করেছেন। যত্ন-আত্তি করেছেন। ক্ষণিক বিরতিতে তিনি আবার বলে চললেন, দেশে ফোন করলেই এখন শাশুড়ি তার ছেলেকে বলেন, ‘ বাবারে, আমারে তোর কাছে লইয়া যা ‘। আমি বলি, নিয়ে আসুন, বাড়িতে একজন মুরুব্বী থাকলে ভালোই হবে আপনার। বন্ধু পত্নী কিঞ্চিৎ বিরক্তিতে বললেন, ‘ থাকবে কোথায়, এই বিদেশ বিভূঁইয়ে আমাদের তো বাড়তি রুম নেই। ‘ অতঃপর প্রসঙ্গ পাল্টায়। অন্য বিষয় নিয়ে গল্প চলে। এলেবেলে গল্প। বাবা-মা, ভাই-বোন’কে এদেশে আনার ব্যাপারে কে কে আবেদন করেছে সেইসব গল্প। উচ্ছ্বসিত বন্ধুপত্নী এবার জানালেন, তিনি তার বাবা-মা’য়ের জন্যে আবেদন করেছেন। সহসাই তারা এদেশে চলে আসবেন। আমি বললাম, ‘ থাকবে কোথায়, আপনার তো বাড়তি রুম নেই। ‘ তিনি বুঝলেন, হো হো করে হেসে উঠলেন। চিরকাল জেনে এসেছি , হাসির চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। কিন্তু সেদিন প্রথমবার কারো হাসি ভীষণ রকম অসুন্দর মনে হলো। অতঃপর একদিন খবর পেলাম, দেশ থেকে বন্ধুপত্নী’র বাবা-মা এলেন, বেড়ালেন, বছরখানেক বাদে দেশে ফিরেও গেলেন। কিন্তু ‘ বাবারে, আমারে তোর কাছে লইয়া যা ‘ বলে আকুতি করা মায়ের আকুতি আকুতিই থেকে যায়। তার আর আসা হয় না প্রানপ্রিয় পুত্রের কাছে। আমার বন্ধুপত্নীও একদিন শাশুড়ি হবেন। একটু একটু করে যত্নে আগ্লে রাখা সন্তানটি থেকে দূরে থাকার কষ্ট নিশ্চয়ই তিনি সেদিন অনুভব করবেন। কিন্তু সেদিন যে বড় বেশি দেরি হয়ে যাবে ! খুব জানতে ইচ্ছে করে, ‘ বাবারে আমারে তোর কাছে লইয়া যা ‘ এমন আকুতি কি তার কানে বেজে উঠবে সেদিন ? হয়তোবা হ্যাঁ, হয়তোবা না। কী জানি !
রোজ টুকটাক কাজ করার সময় আমার সত্তরঊর্ধ্ব বয়সী শাশুড়ি এগিয়ে আসেন প্রায়ই। আমার মা যেমন করে বলতেন, ঠিক তেমন করে বলে উঠেন, ‘ তোমার ভারী কাজ করা ঠিক না, কিংবা তোমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে ‘। বলেই তিনি নিজে করার চেষ্টা করেন ! তেমনি আমিও প্রায়ই বলি, ‘ আম্মা এটা তো আমিই করতে পারবো, আপনি যান।’ আবার বৈকালিক চা’য়ের সময়টাতে আমাদের গল্প ফুরাতে চায় না। যুদ্ধের সময়কার গল্প, জীবনের চড়াই উৎরাই এর গল্প কিংবা অন্য কোন বিষয়। এটি দু’জনের প্রতি দু’জনের মায়া, ভালোবাসা’র বন্ধুসুলভ এক সম্পর্ক। যতবারই শাশুড়িকে নিয়ে ডাক্তারের ক্লিনিকে কিংবা বাংলাদেশে যাই, দীর্ঘ ভ্রমনে পাশের সহযাত্রী’রা জানতে চায় আমরা মা-মেয়ে কিনা। মা-মেয়ে কিংবা বৌ-শাশুড়ি একটি পরিচয় মাত্র। কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষের প্রতি সহযোগিতা, সহমর্মিতা, ভালোবাসা কিংবা সন্মানটুকু তো অন্তত করা যায় ।
আরেকবার এক বন্ধুর মা এসেছিলেন ইমিগ্রেণ্ট হয়ে এদেশে থাকবার উদ্দেশ্যে। তিনি দেশে সরকারী চাকুরীজীবী ছিলেন। চাকুরি থেকে ইস্তেফা দিয়ে এসেছেন। কিন্তু দুইমাস বাদে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, তিনি দেশে ফিরে যাচ্ছেন। আমরা এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে গেলাম। প্রয়োজনীয় কাজ শেষে ওয়েটিং এরিয়ায় বসে গল্প করছিলাম। কেন ফিরে যাচ্ছে জানতে চাইলে বেদনার্ত চোখে তাকালেন এদিক সেদিক। অতঃপর খুব নিচু স্বরে জানালেন কিছু কথা। চোখ মুছলেন। সিকিউরিটি চেকিং এর জন্যে গমগমে এনাউন্স হচ্ছিল। আমরা উঠে দাঁড়াই। বিদায়ের পালা। বৃদ্ধ মা আর ছেলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন খুব। বেশ বেদনাবিধুর বিদায়ক্ষণ। অতঃপর তিনি তার নাতিকে জড়িয়ে রাখলেন বুকের মাঝে। সিকিউরিটি চেকিং শেষে তিনি ভেতরে চলে গেলেন একাকি। চলে গেলেন আমাদের দৃষ্টিসীমার বাহিরে। বন্ধু, বন্ধুপত্নী, তাদের ছোট্ট ছেলেটি, আর আমরা স্বামী-স্ত্রী দু’জন ফিরছিলাম পার্কিং লটের দিকে। আমি বন্ধু পত্নীকে বললাম, বাচ্চা ছেলেটির খুব মন খারাপ লাগবে দাদীর অনুপস্থিতিতে। আমায় অবাক করে দিয়ে তিনি জানালেন ভিন্ন কথা। বললেন, আমার ছেলে একটু আগেই আমাকে বলেছে, ‘ মা, আজ আমরা আরাম করে থাকতে পারবো, কি মজা ‘। সেদিন হাইওয়ে ধরে বাড়ি ফিরবার পুরোটা পথ কথাগুলো সুঁইয়ের মতো কানে বিঁধছিল। আমার শুধুই আমার দাদীকে মনে পড়ছিল। দাদীকে আমরা ‘ বু ‘ বলে ডাকতাম। বু যখন আমাদের শহরের বাসায় বেড়াতে আসতেন, আমাদের উচ্ছ্বাসের সীমা থাকতো না। আমরা যেন সেই সময়গুলোতে বাবা মায়ের সব অভিযোগ আর চোখ রাঙ্গানির ঊর্ধ্বে থাকতাম। মাস খানেক থেকে যেদিন বু গ্রামে ফিরে যেতেন, আমরা সেদিন অঝোরে কাঁদতাম। আম্মা আমাদের বু’য়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে আঁচলে চোখ মুছতেন। অশ্রুজলে বিদায় দিতেন। আমরা ক’দিন খুব বিষণ্ণ থাকতাম। ঘরকে ঘর মনে হতো না। খাঁখাঁ শূন্যতায় ভরা কোন বিরানভূমি মনে হতো। আবার ছুটির দিনে আমরা যখন গাঁয়ে বেড়াতে যেতাম, বয়সের ভারে নুইয়ে থাকা আমাদের বু তুমুল উৎসাহ আর আনন্দ নিয়ে এটা সেটা রান্না করে খাওয়াতেন। ফিরে আসবার সময় তিনি সরু রাস্তার মোড় অবধি আসতেন বিদায় দিতে। ছলছল চোখে মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতেন, ‘ বউ, আবার কবে আইবা ?’ বউ-শাশুড়ির অশ্রু বিসর্জন হতো বাবা তাগাদা না দেয়া পর্যন্ত। অতঃপর যতদূর চোখ যায়, আমরা দৃষ্টিসীমায় মিলিয়ে না যাওয়া অবধি তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন লাঠি ভর করে। আমরাও পাঁজরভাঙা দীর্ঘশ্বাসে পিছু ফিরে চাইতাম বার বার।
এখানে পারিবারিক নৈতিক শিক্ষাটা জরুরি। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমি যদি আমার মাকে দাদীর সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলতে শুনি অহরহ, কিংবা দাদীকে যদি দেখি আমার মায়ের সাথে দ্বন্দ্ব বিবাদে লেগে থাকতে, তবে আমার ভেতরেও তেমন মানসিকতা তৈরি হবে। এই প্রবাসে আমরা সকলেই ব্যস্ত সময় কাটাই। বেশিরভাগ পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই অর্থ উপার্জনের জন্যে বাহিরে কাজ করতে হয়। দিন শেষে ঘরে ফিরে ঘরের প্রবীণ মানুষটির সাথে ভালোমন্দ গল্প করুন, কিংবা এটা সেটা শেয়ার করুন। কেননা এই বিদেশ বিভূঁইয়ের একলা যাপিত জীবনে তাঁদের তো গল্প করার মতো কেউ নেই। তাঁদের পৃথিবী বলতে কেবল আপনার ঘর এবং ঘরের মানুষগুলো। নাতি-নাতনীদের তাঁদের সাথে মিশতে দিন। প্রবীণরা তাঁদের নাতি-নাতনীদের যে শাসনই করুন না কেন, মনে করুন ভালোর জন্যে করেছে। এতে প্রবীণদেরও মন ভালো হয়ে উঠবে। তাঁরা এটা ভাবতে ভালো বোধ করবে যে, সংসারে তাঁদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি।
রিমি রুম্মান
কুইন্স, নিউইয়র্ক
১১টি মন্তব্য
তৌহিদ
রোজ টুকটাক কাজ করার সময় আমার সত্তরঊর্ধ্ব বয়সী শাশুড়ি এগিয়ে আসেন প্রায়ই। আমার মা যেমন করে বলতেন, ঠিক তেমন করে বলে উঠেন, ‘ তোমার ভারী কাজ করা ঠিক না, কিংবা তোমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে ‘। বলেই তিনি নিজে করার চেষ্টা করেন ! তেমনি আমিও প্রায়ই বলি, ‘ আম্মা এটা তো আমিই করতে পারবো, আপনি যান।’
এই অংশটুকুতেই সবার জন্য অনুভাবী উত্তর বিদ্যমান। সম্পর্কগুলি নিজেরাই নিজেদের মত করে একটু যত্ন করলে বৌ শাশুড়ি সম্পর্ক অনেক মধুর একটি সম্পর্ক। দরকার শুধু একটুমাত্র সহনশীলতা আর সহানুভূতি।
সুন্দর লিখেছেন আপু। শুভকামনা রইলো।
রিমি রুম্মান
সমস্যাগুলো কেন হচ্ছে , এর প্রতিকার কি… এসব নিয়ে আসছে পরবর্তি পৰ্ব ।
তৌহিদ
অপেক্ষায় রইলাম আপু।
আরজু মুক্তা
আচ্ছা, বৌ রাও তো একদিন শাশুড়ি হবে, এটা ভুলপ যায় কেনো?
রিমি রুম্মান
সমস্যাগুলো কেন হচ্ছে , এর প্রতিকার কি… এসব নিয়ে আসছে পরবর্তি পৰ্ব । ভাল থাকুন সবসময়।
জিসান শা ইকরাম
যে যেমন সে তেমনই প্রতিদান পাবেন, এটি আমি বাস্তবে দেখেছি।
তোমার বন্ধু পত্নীও এর প্রতিদান পাবে, পাবেই।
ভালো থেকো দিদি ভাই প্রবাসে।
রিমি রুম্মান
সমস্যাগুলো কেন হচ্ছে , এর প্রতিকার কি… এসব নিয়ে আসছে পরবর্তি পর্ব, ভাইজান।
নিতাই বাবু
এটা একরকম ব্যধিই বলা চলে। নিজের ঘরেও প্রায়সময় এই ব্যধি নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়। সময় সময় রাম রাবণের যুদ্ধও বাধে। নিজের মেয়ের অবস্থাও একইরকম চলছে। এই ব্যধি থেকে শান্তি পেতে চাইলে, অনেকেই বলে শান্তির মা মারা গেছেন অনেক আগে। কিছুদিন আগে শান্তিরও মৃত্যু হয়।
ইঞ্জা
সত্যি তাই আপু, জীবনের পরতে পরতে শিক্ষাটাই আপনাকে, আমাকে, সবাইকে শিখাতে পারে মুরুব্বিদের সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, উনাদের শেষ বয়সে যদি আমরা কেয়ার না করি তো কে করবে।
লেখাটিকে আমি শিক্ষণীয় পোস্ট হিসাবেই নিলাম আপু।
ছাইরাছ হেলাল
আপনি ব্যতিক্রম বলেই এমন করে ভাবতে পারছেন।
নারী-ই নারীর শত্রু বউ-শাশুড়ি সম্পর্কই তার প্রমাণ।
জানিনা এর অবসান কখন কীভাবে হবে।
একজন নিগৃহীত বউ শাশুড়ি হলে/হয়ে সব কিছু ভুলে শাশুড়ির চিরায়ত রূপে ফিরে যান।
সত্য-ই অদ্ভুদ লাগে দেখলে।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
কী লিখবো বুঝতে পারছি না। লেখাটি পড়তে পড়তে দুবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো। মেয়ে হয়ে মেয়েদের অকপটে সমালোচনা করতে পারে তা প্রথম দেখলাম। বিশেষ করে শাশুড়ি বিমুখ বউদের জারি সারি যেভাবে ফাঁস করে দিলেন, অসাধারণ!
এই সমস্যার সমাধান আশু প্রয়োজন। অসহায়, অভাগী,দুঃখিনি মায়ের সেভাবে যত্ন পাওয়ার অধিকার আছে যেভাবে সন্তানেরা ছোটকালে নিজ নিজ মায়ের কাছে পেয়েছিলো।
আপনাকে ধন্যবাদ।