আকাশে বজ্রপাত,সু সু বাতাসের শব্দ,জানালায় টুস টাস কি যেন কঠিন পদার্থের আঘাত। রোজী জানালা খুলতেই জানালার কাচঁগুলো ঝড় ঝড়িয়ে পড়ে গেল। বাতাসের তীব্র গতি মাথায় রাখা ঘুমটার ওড়নাটা উড়ে গেল।কাগজ দিয়ে ভঙ্গুর জানালাটার ছিদ্রটি বৃথাই বন্ধ করার চেষ্টায় হঠাৎ চোখঁ পড়ে দূরে…এমন ঝড়ো হাওয়ায় কয়েক জন অস্ত্রধারী মিলিটারী একজন যুবককে পিছনে হাত বেধে চোখেঁ কালো কাপড়ে বাধা অবস্হায় ধাক্কাতে ধাক্কাতে কোথাও যেন নিয়ে যাচ্ছে রোজীর অকপট নজর সেদিকে বাতাসের গতির সাথে হেচকি বৃষ্টির ধারা যেন রোজীকে ভিজিয়ে দিচ্ছে সে দিকে তার খেয়াল নেই।
মিলিটারীরা ছেলেটিকে নিয়ে জঙ্গলের ভিতর রোজীর দৃষ্টির বাহিরে চলে যায়।কিছুক্ষণ রোজী ভাবনায় মগ্ন তার পর সাহস করে তার ছোট আট দশ বছরের এক ভাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে জ্বলন্ত হারিকেন হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে তাদের পিছু নেয়।
চারদিকে ব্যাঙের গ্যা গ্যা শব্দ,কর্দমাক্ত রাস্তা দিয়ে হাটতে গিয়ে মাঝে মাঝে ওরা পিচ্চিল খায়। কিছু দূর যাবার পর ওরা দেখতে পেলো , মিলিটারীরা ছেলেটিকে চোখ বাধাঁ অবস্হায় একটি গর্তে ফেলে রেখে চলে যায়।রোজী ও তার ভাই সুজন সাহসীকতার সহিত এগিয়ে যায় গর্তের নিকট।
ছেলেটি মরার মতন চোখঁ হাত বাধা অবস্হায় গর্তে নিশ্চুপ শুয়ে আছে মরে গেছে না বেচে আছে বলা মুসকিল।গর্তের কাছে গিয়ে গর্তে উকি দেয় রোজী,নিথর দেহটির পাশে আরো কিছু মানুষের ছিন্ন ভিন্ন কঙ্কালের হাড় হাড্ডি মনে হয় পাক মিলিটারীরা মুক্তিকামী বাঙ্গালীদের শায়েস্তা করে এখানে এই গর্তে ফেলে যায়,গর্তটিও বেশ বড় সর।রোজীর হাতের হারিকেনটির আলোর রস্মি নিথর দেহটির মুখবয়ে গিয়ে পড়ে, রোজী দেখতে পেল ছেলেটির চোখের পাতা নড়ে উঠার দৃশ্য,চারদিকে তাকিয়ে ভাইকে সাথে নিয়ে নিথর দেহের অচেনা ছেলেটিকে গর্ত থেকে উপরে তুলে উড়না দিয়ে ছেলেটির মুখের কাদাঁ গুলো মুছে দেয়াতে ছেলেটির সামান্য জ্ঞান ফিরে শুধু মা মা মা তিন চার বার ডাক দিয়ে আবার জ্ঞান হারায়।রোজী ও তাই ভাই সুজন ছেলেটিকে ধরা ধরি করে বাসায় নিয়ে গরম পানি করে কর্দমাক্ত আর রক্ত মাখা শরীরটাকে পরিস্কার করে।এরই মধ্যে রোজীর বাবা গ্রাম্য দরবার শেষ করে বাসায় ফিরেন।
রোজীর বাবা কেরামত মাওলানা পাঞ্জেগানা নামাজী আল্লাহ ভক্ত লোক,পাড়ার ছোট খাটো বিচার করেন।রোজী বাবাকে ঘরে প্রবেশ করতে আন্দাজ পেয়ে আহত ছেলেটিকে চাদর দিয়ে ঢেকে রাখে।ছোট ভাইটিকে বাবাকে কিছু না বলে সে ব্যাবপারে শাষিয়েছে রোজী।বাবা ঘরের বারান্দায় ঢোকে রোজীকে ডাকছে।
-মা রোজী, কই গেলি মা…আমারে কিছু খেতে দে,বড্ড খিদে লাগছে।
রোজী ঘরের ভিতর থেকে উত্তর দেয়..মা নেই বলে সকল কাজই রোজীকে করতে হয়।কেরামত মাঝে মাঝে চিন্তায় পড়েন যদি রোজী না থাকত তবে কেরামতের অনেক কষ্ট হত চলা ফেরায় তাই যদি এমন কোন ছেলে পেত তাহলে তাকে ঘর জামাই করে রেখে দিতেন এ নিয়ে বাপ বেটীর মাঝে মাঝে তুমুল তর্ক হয়, রোজীর কথা হলো তার স্বামী ঘর জামাই থাকবে কেনো তার স্বামী হবে বলিষ্ট সাহসী শিক্ষিত কর্মঠ পুরুষ ।
কেরামত মাওলা নীমের ঢাল দিয়ে দন্ত পরিস্কার করে পাশে রাখা বদনার জল দিয়ে হাত মুখ পরিস্কার করে বারান্দায় ছেলের বিছানো মাদল পাটিতে বসেন।মেয়ে ডাল-ভাল বেড়ে দিয়ে আবার ভিতরে চলে যায় আহত ছেলেটির কাছে।ছেলেটি এখন কিছুটা সুস্হ্য তবে মিলিটারীর বুটের আঘাতগুলো বেশ কষ্ট দিচ্ছে ঠিক মত সেবা না দিলে ছেলেটি বিছানা থেকে আর উঠতে পারবে বলে মনে হয় না বিধি বাম কেরামত মাওলা জানতে পারলে মেয়েকে কেটে ফেলবে কিন্তু রোজী এত সব না ভেবে একজন মুমূর্ষ মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধা মানুষের সেবা করছে এটা তার যেন কর্তব্য মনে করে।ছেলেটির কষ্ট আর সয় না রোজীর চোখঁ বন্ধ মাথায় হাত রেখে রোজী চমকে যায় জ্বরে যেন ছেলেটির গা পুড়ে যাচ্ছে।ঐ দিকে কেরামত মেয়েকে ডাকছে,,,,
-কৈ রে মা কই গেলি পানি দে,লবন দে।রোজীর ছোট ভাই কিছুই যেন দেখেনি সে যা আছে পাতের সামনে তাই ভক্ষণে মগ্ন।বাবা কেরামত রোজীকে না আসতে দেখে সে নিজেই আইট্টা হাতে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে দেখে মেয়ে রোজী তার ঘাটে বিছানায় কাকে যেন চাদর মুড়ি দিয়ে লোকানোর চেষ্টা।
-কি রে মা ঐ চাদর দিয়ে কি লুকাইতেছস….বলে কেরামত মাওলা চাদরটি টান দেন।আহত ছেলেটি আঘাতে চাইতে পারছে না এবং তেমন একটা কথা বলতেও পারছে না।কেরমত মাওলা ছেলেটির কপালে হাত দেন প্রচন্ড জ্বরে কাপছেঁ ছেলেটি কেরমত রেগে যায় মেয়ের উপর।মেয়ে ভয়ে ছিল না জানি তার বাবা কি কান্ড ঘটান।কিন্তু মেয়ে রোজীর ভাবনার ভয়টি কেটে গেল বাবার কথা বার্তা শুনে।
-তোমার কি আর আক্কল জ্ঞান অবে না….ছেলেটি জ্বরে মরে যাচ্ছে আর তুমি চাদর মুড়ি দিয়ে রেখে দিছো…যাও হাড়িতে পানি নিয়ে পানি পট্টির ব্যাবস্হা করো।কেরামত ছেলেটিকে ডেকে ডাক্তার আংকেলের কাছে পাঠায়।মেয়েকে কিছু প্রশ্ন করে পানি পট্টির ব্যাবস্হার ফাকে ফাকে রোজী উত্তর দেয়।
-ছেলেটি কে?
-জানি না।
-জানি না মানে কি কইতাছ,কেমনে এলো এখানে?
-আপনি আসার আগে আমাদের ঘরের দক্ষিন ভাগের জঙ্গলে আমি জানালা বন্ধ করার সময় দেহি কিছু মিলিটারী এরে জঙ্গলের ভিতরে টেনে হিচড়ে নিয়ে পুরানো একটা গর্তে ফেলে রেখে চলে যায়।
-তারপর?তারপর ঘরে আনল কে?
-জি,আমি আর সুজন গিয়ে গর্তে উকি দেয়ার পর দেখলাম ছেলেটি মরেনি মাথা নড়াচড়া করতে দেখলাম…. এর পর দুজনে ধরে ঘরে নিয়ে আসি।আমি ভুল করেছি আমারে যা মন চায় কন ছেলেটারে ভাল হতে দেন।
মেয়ের কথা শুনে বাবা কেরামত মাওলা গর্বে বুক ফুলিয়ে মেয়েকে সাবাস জানান।
-সাবাস মা,আমি সারা জীবন নামাজ রোজা করে যে সোয়াব কামাইছি তুমি এই কয় ঘন্টাই কামাইয়া লাইছ…এটাইতো মুসলমানের আসল চরিত্র অসহায়দের পাশে থাকা,মৃত্যু পথ যাত্রীদের সেবা করা।মনে রাখবে “জীবে প্রেম করে সে জন সেবিসে ঈশ্বর”
বাবার এমন কথা শুনে রোজীর যেন বিশাল এক পাহাড় সমপরিমান চিন্তা মাথা থেকে নেমে গেল।রোজী ছেলেটির কপাল বরাবর একটি মাটির হাড়ি ঝুলিয়ে তলায় ছিদ্র করে পানি ঢালছে।কেরামত তার ছোট ছেলেকে ডাক্তার আনতে পাঠিয়েও চিন্তায় পড়ে গেল।গ্রামে ডাক্তার নেই পাশের গ্রাম থেকে আনতে হয় এ দিকে পাক মিলিটারীরা জায়গায় জায়গায় ক্যাম্প বসাইতেছে, এদেশের উদিয়মান শিক্ষিত যুবকরা এই ক্যাম্প বসানো নিয়ে প্রতিবাদ করায় ক’দিন আগেও বেশ কয়েকজন যুবককে মিলিটারীরা টর্চার করে মেরেছে এই নিয়ে পুরো গ্রামই আতংকে।কখন যে পাক মিলিটারী কার উপর চড়াও হয় বলা মুশকিল।ছেলেকে এভাবে একা অন্য গ্রামে ডাক্তার আনতে পাঠানো ঠিক হয়নি এবার কেরামত মাওলা চিন্তায় মগ্ন।
দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে পূর্ব গ্রামের বেশ কয়েকটি কাচা মাটির ঘর।পাক মিলিটারী আর স্হানীয় রাজাকারা যারা মক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ইন্ডিয়া গেছেন তাদের ঘর বাড়ীতে আগুন দিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়েন।ছোট বড় যুবক বয়স্ক ছুটাছুটি যে যে দিকে পারছে পালাচ্ছে ।চারদিকে ভয়ার্ত চিৎকারে আকাশঁ ভারী হয়ে গেছে।
অগ্নিস্ফুলিঙ্গের অতি নিকটে একটি দুই তিন বছরের শিশু হাটি হাটি পা পা করে পাকিদেরঁ অত্যাচারিত মায়ের লাশের কাছ থেকে হেটে একটু সামনে এগিয়ে আবার মায়ের বুকে এসে মা মা বলে কাদঁছে।তার আশে পাশে ভয়ে ছুটে চলা মানুষগুলো যেন আপনা জান বাচা অবস্হায় কেউ কারো দিকে তাকাবার সময় যেন নেই।
ডাক্তার আনতে আসা কিশোর সুজন শিশুটির চিৎকারে থমকে যায় লক্ষ্য করে দেখল একটি শিশু মায়ের বুকে হাত রেখে… কাদঁছে চারদিকে তাকিয়ে সুজন দ্রুত শিশুটিকে কোলে নিয়ে বাশ ঝাড়ের ভিতরে লুকিয়ে পড়ে……।
চলবে…
২৭টি মন্তব্য
সঞ্জয় কুমার
মুক্তিযুদ্ধের গল্প আমার সব সময় ভালো লাগে । এটাও ভাল লাগছে চালি যান ।
সঞ্জয় কুমার
মুক্তিযুদ্ধের গল্প আমার সব সময় ভালো লাগে । এটাও ভাল লাগছে চালিয়ে যান ।
মা মাটি দেশ
ধন্যবাদ ভাইয়া
আদিব আদ্নান
সত্যিই প্রজন্মের ঋণ , যা আমাদেরই শধ করতে হবে ।
লিখতে থাকুন ।
মা মাটি দেশ
ধন্যবাদ আমাদের আরো বহুদূর যেতে হবে।
খসড়া
ঋন শোধ কি এতই সহজে।আরও আছে দেনা।
মা মাটি দেশ
ঋণতো শোধ হয় না তবে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এবং দেশের পাশে থাকা।ধন্যবাদ। -{@
বনলতা সেন
খুব ভাল একটি বিষয় নিয়ে লিখতে শুরু করেছেন ।
ঋণ শোধ আমরা করতে পারব কিনা সেই প্রশ্ন নয় , আমরা ভাবতে পারছি সেটাই অনেক কিছু ।
মা মাটি দেশ
ঋণ শোধ আমরা করতে পারব কিনা সেই প্রশ্ন নয় , আমরা ভাবতে পারছি সেটাই অনেক কিছু । -{@ (y)ধন্যবাদ।
অলিভার
ঋণ শোধের নতুন কোন উপায় জানার অপেক্ষায় থাকলাম…..
মা মাটি দেশ
নতুন কোন উপায় বলতে কি বুঝাইতে চাচ্ছেন যুদ্ধপরাধীর বিচার ছাড়াও যদি কোন বিষয় থাকে জানা হেল্প করতে পারেন আমি সংযোগ করে নেব।ধন্যবাদ।
সীমান্ত উন্মাদ
মুক্তিযুদ্ধের গল্প পেলে আমি এক নিশ্বাসে পড়ার চেষ্টা করি আর নিজের ভীতর একটা অপরাধবোদ জন্মনেয় কেন সেই উত্তাল সময়ে আমার জন্ম হলোনা।
মা মাটি দেশ
ঠিক বলেছেন ভাই সেই সময় জম্ম হলে আমরা জানতে পারতাম এর প্রকৃত ইতিহাস। -{@
জিসান শা ইকরাম
ভালো একটি টপিকস নিয়ে লিখছেন –
অভিনন্দন আপনাকে ।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত লেখা হবে , ততই আমাদের দেশ প্রেম বৃদ্ধি পাবে ।
লেখা চলুক ।
মা মাটি দেশ
এই সিরিজ লেখার ভাল মন্দ সব দিকের সমালোচনা আশা করি পাবো ।ধন্যবাদ।
আজিম
প্রজন্মের ঋণশোধের গল্প চলুক আর চলুক আমাদের ঋণশোধের পালা-ও।
মা মাটি দেশ
ঋণ যদিও শোধ করতে ারব না তবে কৃতজ্ঞ প্রকাশে কোন কার্পণ্য যেন না হয় ।
পুষ্পবতী
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখা ভালো লাগে।চলুক। (y) -{@
মা মাটি দেশ
ধন্যবাদ আপু
ছাইরাছ হেলাল
আত্মবিস্মৃত জাতি আমরা , ভুলে যাই সব কিছু অতি সহজেই ।
ঋন-ফিন নিয়ে কেউ ভাবে বলে মনে হয় না ।
মা মাটি দেশ
এতটা বিমূখ হবেন না ভাইয়া আজ যে বিচার হচ্ছে সেখানে ঋণ শোধের একটি অংশ যদিও এ ঋণ কখনও শোধ করা যাবে না তবুও মনকে শান্তনা দিতে কেউ না কেউ তো আছেই িকংবা আসবে এ বাংলার ত্রিশ লক্ষ রক্তের ঋণের পরিবর্তে দেশকে গড়তে।ধন্যবাদ। -{@
ওয়ালিনা চৌধুরী অভি
গতকালকেই পড়েছি আপনার এই লেখাটি । ভালো লিখেছেন ভাইয়া । গুড জব (y) -{@
মা মাটি দেশ
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আসলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস বেশী বেশী করে লিখতে হবে। -{@ (y)
শুন্য শুন্যালয়
অনেক প্রিয় একটা বিষয় নিয়ে লিখতে দেখে খুশি হলাম। শুরুটা বেশ গোছালো হচ্ছে। শেষ টাতে পাঠক ধরে রাখার আকর্ষণ টাও বেশ। লিখুন ভাইয়া। -{@
মা মাটি দেশ
ধন্যবাদ অনেক শুণ্য.আপু…..পরামর্শ চাই -{@ (y)
আজিম
চালিয়ে যান জনাব ‘মা মাটি মানুষ’। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
ধন্যবাদ।
মা মাটি দেশ
ধন্যবাদ প্রিয় -{@ (y)