ইন্টার পরীক্ষা শেষে বন্ধুরা পিকনিকে যাবার পরিকল্পনা করলো। আমার কঠিন হৃদয়ের বাবার অনুমতি প্রয়োজন। বাড়িতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আম্মা বলল, “বলে লাভ নাই, তোর আব্বা রাজি হবে না। তবুও বুকে সীমাহীন সাহস সঞ্চয় করে আব্বার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আব্বা গম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন, কে কে যাইতাসে ? আমি একে একে নাম বললাম। তিনি বিস্ময়ে বলে উঠলেন, ” তোরা সবই তো পোলাপাইন ! কোন শিক্ষক নাই, মুরুব্বি নাই ! অসম্ভব !” দুইদিন বাদে আবারো আব্বার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। মলিন মুখে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলি, ” আব্বা, এখন পরীক্ষা শেষ, সব বন্ধুরা যার যার মত করে এখানে সেখানে ভর্তি হবে। আমাদের তো আর কোনদিন কারো সাথে কারো দেখা হবে না”। আমার বাবার পাথরের মতন শক্ত মন সেদিন মোমের মতন গলে গিয়েছিলো। আমি অনুমতি পেলাম। যেন খাঁচার পাখি ছাড়া পেলাম। যেন বুক ভরে বাইরের পৃথিবীতে নিঃশ্বাস নিলাম।
যখন ঢাকায় ভর্তি হলাম কি যে আনন্দ ! যেখানে খুশি সেখানে যাওয়া যায়, অনুমতি লাগে না ! আহা, স্বাধীনতা ! কয়দিন পরপর আব্বা ঢাকায় ছুটে আসে আমায় দেখতে। বলা নেই, কওয়া নেই, হুট হাট-ই আসে। রুমমেট আপু’রা সাত সকালে ঘুম থেকে ডেকে তোলে__” রিমি, তোমার আব্বা আসছে”। আমি চোখ ঘষতে ঘষতে ভিজিটর রুমে গিয়ে দেখা করি। আজ অবধি ভয়ে যার চোখের দিকে চেয়ে কথা বলিনি, সেই আব্বা বাচ্চাদের মতন বলে উঠলেন, ” কতদিন তোরে দেখিনা, মনটা ভাল লাগতেছিলো না, তাই চইল্লা আসলাম।” তারপর বলেন, “চল তোর কাকার বাসায় যাই, চল অমুকের বাসায় যাই… ” সারাদিন আমরা বাপ-মেয়ে রিক্সায় এখানে ওখানে ঘুরে শেষ বিকেলে হলে ফিরে আসি। আমায় নামিয়ে দিয়ে আব্বা বিষণ্ণ মনে ফিরে যান। আর আমি চোখ মুছতে মুছতে রুমে ঢুকি। আমার লাল চোখের দিকে চেয়ে থাকা রুমমেট আপুদের বলি, চোখে যে কি হইসে, এলার্জি মনে হয় ! ডাইনিং খেতে বসেও চোখ মুছি আর পাশের জনকে বলি, ধুর ছাই, এই বন্ধ রুমে বালু আসলো কোত্থেকে !
দেশ ছেড়ে আসবার সময়টাতে গোছ গাছ করছি। এটা সেটা ব্যাগে রাখছি। আম্মা নকশী কাঁথা এনে দিলেন। আব্বা একটি বোতল এনে বললেন, এইটা নিয়া যা। আমি বিস্ময়ে তাকাই ! আব্বার চোখে, মুখে উজ্জ্বল দ্যুতি। বললেন, ” নিজেদের ক্ষেতের সরিষার তেল। খাঁটি তেল কই পাইবি ওই দ্যাশে ?”। ব্যাগ গুছানো শেষ হয় যখন, একলা রুমে আমি চোখ মুছি আর বিড়বিড় করি, ” রুমের ভিতরে বালু আসে কইত্থেইকা !”
চলে আসবার সময় তাকিয়ে দেখি, পিছনে ইট-সিমেন্টের দালান দাঁড়িয়ে। সামান্য ইটের দালান, তবুও কি তার ক্ষমতা ! স্বর্গ ! অন্তঃপুরের বাসিন্দা ছিলাম সবে পাঁচজন। জীবনকে রঙিন, বর্ণিল করে তোলার জন্যে, দিনশেষে হাসি, আনন্দে মেতে থাকা, সুখ সুখ অনুভূতি নিয়ে ঘুমাতে যাবার উপকরন ছিল কেবলই একের প্রতি অপরের নিখাদ ভালোবাসা।
****
রমযানের দু’দিন আগে এখানে, এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এক বাংলাদেশী পরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছিলো। বর-কনে দু’জন দু’জনার পরিচিত। পারিবারিকভাবেই সকল আয়োজন। প্রতিবেশী বাঙালিদের নিমন্ত্রন করা হয়। বিপত্তি বাঁধলো কন্যা বিদায়ের সময়টাতে। সে এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি ! কনে, তাঁর মা আর একমাত্র ভাই__ তিনজনের বুকফাটা কান্নায় বিয়ে বাড়ির পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। তাঁরা অপেক্ষা করছিলো, এই বুঝি কন্যার বাবা ফিরে আসবেন, মাথায় হাত বুলিয়ে অশ্রুজলে আদরের কন্যাকে বিদায় জানাবেন। কিন্তু না, তিনি ফিরে আসেননি। তিনদিন আগেই নাকি রাগ করে বাড়ি ছেড়ে গেছেন। মাঝে মাঝেই এমন করে চলে যান, নেশা করেন, বেশ ক’দিন পর আবার ফিরেও আসেন। এটি সেই বাবার নিয়মিত প্রক্রিয়া। কন্যাটি নিদারুন কষ্ট আর লজ্জায় অশ্রুজলে ভেসে যেতে যেতে স্বামীর বাড়ি যায়। কন্যা বিদায়ের পর মা আর একমাত্র ছেলেটি, দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ দৃশ্যে উপস্থিত অতিথিরাও অশ্রুসজল হয়ে উঠেন। আনন্দের বিয়ে বাড়ি শেষমেশ বিষাদ আর দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠে।
পৃথিবীতে দুই ধরনের বাবা আছেন। ভালো বাবা এবং খারাপ বাবা।
আমি ভাগ্যবতী, আমার ভীষণ মায়াময় একজন বাবা ছিলেন।
সামনে বাবা দিবস। পৃথিবীর সকল বাবাকে শুভেচ্ছা।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
২৩টি মন্তব্য
মেহেরী তাজ
এমন বাবাও থাকে যে কি না মেয়ের বিয়ের দিনেও অনুপস্থিত থাকতে পারে??
সত্যি আমরা ভাগ্যবতী যে আমাদের বাবা প্রথম ভাগের মধ্যে পড়ে….
লেখা ভালো লাগলো সেই সাথে মেয়েটার আর তার পরিবারের জন্য কষ্টও….
রিমি রুম্মান
শেষের লেখাটি সবার সাথে শেয়ার করেছি এ জন্যে যে, আমরা যারা ভীষণ ভাল বাবা পেয়েছি, তাঁরা অনেকেই জানিনা, পৃথিবীতে অনেক বাবাই আছেন নির্দয় আর মমতাহীন।
ইনজা
সব বাবার মাঝে মাত্র কয়েকজন বাবা হইতো ভালো না হতে পারেন কিন্তু বাকি সব ভালো হয় আর তেমনি তার সন্তানদের ভালোর জন্যই হয়ত বাবারা একটু কঠিনই হোন।
বাবাকে নিয়ে এই সুন্দর লেখার জন্য ধন্যবাদ। 🙂
রিমি রুম্মান
বাবারা বেশিরভাগই কঠিন। তবে জীবনের একটা পর্যায়ে এসে তাঁরা তাঁদের ভেতরের নরম, মমতামাখা রূপটি আর ভেতরে চেপে রাখতে পারেন না। আমরা যখন বাবার গণ্ডির বাইরে এলাম, তখনই তিনি ভেঙ্গে পড়লেন। এবং শিশুর মতন আবদার করতেন, দেখতে চাইতেন, কাছে কাছে রাখতে চাইতেন।
তবে সব বাবা এমন নয়, সেটি জানলাম বিয়ে বাড়ির সেই বাবাকে দেখে।
আবু খায়ের আনিছ
ভালো মন্দ মিলিয়েই মানুষ। তাই দুই ধরণের মানুষই আমরা দেখতে পাই।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন, ভাল মন্দ মিলিয়েই মানুষ। আমরা যখন ভালোর মাঝে থাকি, আমরা ভুলে যাই মন্দটুকু। আশেপাশের দুই একটি উদাহরন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ” আমরা অনেক ভাগ্যবান” ।
জিসান শা ইকরাম
বাবারা কঠিন ভাব দেখালেও ভিতরে থাকেন একদম তুলতুলে কাদার মত। নিজে বাবা হয়ে এখন বুঝি তা।
আপনার বাবাই আদর্শ বাবা। বাবার কথা মনে হলো, এই এসি রুমে বালি আসলো কোত্থেকে!
বিয়ে বাড়ির ঐ বাবার মত কারো বাবা যেন না হয়।
রিমি রুম্মান
আমার এক বন্ধু তাঁর বাবাকে নিয়ে নানান অভিযোগ করতো। লেখাটি পড়ার পর জানালো, তাঁর বাবা এর চেয়ে ঢের ভাল। এতদিন যে অভিযোগ করতো তা নিয়ে লজ্জিত হল। এটি একটি ভাল দিক। আমরা অনেকেই ছোট খাটো বিষয়েও বিরক্ত হই বাবাদের উপর। কিন্তু এমন দুই একটি উদাহরন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে নিশ্চয়ই।
মামুন
বাবাকে মনে পড়ে।
দুই পারের সকল বাবারা ভাল থাকুন।
পোষ্টের জন্য শুভেচ্ছা…
রিমি রুম্মান
বাবা দিবস। আমার বাবা নেই। 🙁
মামুন
🙁
মোঃ মজিবর রহমান
সব বাবাই ভাল হোক সব বাবাই ভাল থাকুক।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুক সকল বাবা।
ভাল থাকুন আপনি।
শুভকামনা।
মোঃ মজিবর রহমান
(y)
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
পৃথিবীতে বাবাদের কোন ভাগ আছে বলে মনে হয় না।বাবা বাবাই হউক সে মন্দ কিন্তু বাবার স্নেহের বিষয়টি মন্দ নয় হয়তো তার চালচলন ভিন্ন।তবুও লেখাটি বেশ চমৎকার আপনার এবং সকলের বাবার জন্য রইল শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা। -{@
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন, নিরাপদ থাকুন।
শুভকামনা…
ব্লগার সজীব
সব বাবা এক নয়। আপনার বাবার আর আপনার কথা এমন ভাবে লিখলেন যে চোখ ভিজে গেলো।
এই দিনে প্রতিজ্ঞা করি, আমরা যেন আমাদের বাবাকে বুঝতে পারি। তাকে কষ্ট না দেই।
রিমি রুম্মান
বেশিরভাগ বাবারা আমার বাবার মতন,
খুব কম বাবা আছে অন্যরকম।
ভাল থাকুন, নিরাপদ থাকুন।
শুভকামনা…
নীলাঞ্জনা নীলা
আমি লাকি, আমার বাবা এমন নির্দয় না। পৃথিবীতে ভালো বাবাদের সংখ্যা বেশী।
আপু তোমার চোখের বালু আমার চোখে আসতো যদি! প্লেনে ওঠার পর ছেলে বললো, “মাম মন খারাপ? তুমি কি কাঁদবে?” বললাম কেন? বললো, “ভাইয়া খুব কাঁদছিলো আর দিদিমনির জল আসেনি, কিন্তু আমায় জড়িয়ে ধরেছিলো।” নাহ কাঁদিনি, আসলে পাথর হয়ে গেছি আপু। আমি কাঁদতে পারিনা।
রিমি রুম্মান
আমরা অশ্রুজল ঢাকতে কখনো কখনো “চোখে বালি পড়া”র দোহাই দেই, তাই না ?
ভাল থাকো, নীলা’দি…
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু কান্না মানে নাকি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া নোনতা জল।
আচ্ছা বুকের ভেতর জমে থাকা যন্ত্রণাকে কি বলে তাকে। যেখানে প্রতিসময় রক্তক্ষরণ হয়?
তুমিও ভালো রেখো নিজেকে রিমি আপু।
মৌনতা রিতু
হারতে শিখিনি আমি আব্বার জন্য। সে বলত,” হেরে গেলেও সোজা হয়ে দাঁড়াবে। কেজ ধাক্কা দিলেও তাকে ঠ্যাস দিয়ে দাঁড়াবে। আমরা চারবোন কোনোদিন আব্বার হাতে মার খাইনি। আমি সিঁড়িতে বসে থাকতাম অন্যায় করলে, কখন আব্বা আসবে। আব্বার সাথে একসাথে ঘরে ঢুকতাম।
আব্বা এখন কোনো কারনে বকা খেল ছোট মানুষের মতো চুপ করে থাকে। এত যে সে জার্নি করতে পারে ! কোথায় যাচ্ছে বলবে না, এই কারনেই সে শুধু বকা খায় মার কাছে। আর নালিশ শুনি আমি।
রিমি রুম্মান
আমি রাগ করলে ভাত না খেয়ে ঘুমিয়ে থাকতাম। সবাই ঘুমিয়ে গেলে আব্বা আদর করে ডেকে ভাত খাওয়াত। সেইসব এখন কেবলই স্মৃতি। নামাজে বাবা-মা’র জন্য দোআ করতে গিয়ে প্রতিদিনই চোখ ভিজে আসে।