আজ ভরা পূর্ণিমা। সন্ধ্যার শুরুতেই বাঁশ বাগানের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো চুইয়ে পড়ছে মাজেদা বেগমের উঠোনে। ছোট্ট একটা হাড়িতে ভাত চড়িয়ে চুলোর পাশে বসে আছে মাজেদা বেগম। কালো ধোঁয়ার কাছে চাঁদের আলো ম্লান। ধোঁয়ায় আছন্ন মাজেদা বেগমকে ছায়ামূর্তির মতো দেখাচ্ছে। ফুঁ দিয়ে চুলো ধরানোর ধারাবাহিক চেষ্টা করে যাচ্ছে। গলা খাকারি দিতে দিতে বাড়িতে ঢুকলো রমজান মণ্ডল। সহানুভূতির সুরে রমজান মণ্ডল বললেন, ‘মাজু বেগমের কষ্ট আমি আর সহ্য করতি পারচি নে। কালই একগাড়ি পাটকাঠি দিয়ে যাতি হবেনে।’
নাকিসুরে বিকৃতভাবে মাজেদা বেগম বলে, ‘ওরে আমার দরদী রে! দরদ একেবারে উতলে ওটচে! পাটকাঠি দিলি, তুমার বউ তুমাকে ঝেটা পিটে করে বিদেয় করবেনে।’
পিঁড়িটা টেনে নিয়ে চুলোর পাড়ে বসলো মণ্ডল এবং খেদোক্তি প্রকাশ করে বললেন, ‘ওই মাগীর জন্যিই তো পারি নে। অনেক কিচুই তো দিতি ইচ্চা করে। তুমার জন্যি আমার অনেক কষ্ট হয়, তুমি বোঝ না নাকি?’
উদাসভাবে ধীরলয়ে মাজেদা বেগম বলল, ‘বুঝি, সব বুঝি।’
রমজান মণ্ডল এবং মাজেদা বেগমের মধ্যে যখন আবেগ আর ভাবের বিনিময় হচ্ছে তখন তালপাতার বেড়ার ফাঁক দিয়ে দুই জোড়া চোখ কি যেন খোঁজার চেষ্টা করছে। তিতি বিরক্ত হয়ে দুলাল বলল, ‘না রে খালেক, আজগের রাতিও ফাঁকা পাওয়া যাবে না।’
রাগে গরগর করতে করতে খালেক বলে, ‘এই শালা রমজান মণ্ডল একটা পাকা নুচ্য। বয়েস হয়েচে, একন এট্টু খ্যান্ত দে।’
দুলালের কথাই সমর্থন দিয়ে খালেক বলল, ‘তাছাড়া ওই শালার ঘরে জোয়ান একখানা বউ রয়েচে, একন আমাদের এট্টু চান্চ দে।’
খালেকের কথা কেড়ে নিয়ে দুলাল বলে, ‘আরে চান্চ দেবে কি? ওই পাগলার বউ ছিনাল মাগী আচে সপ সুমায় উর মণ্ডল ভাতাররে নিয়ে। আমাদের কতা ভাবার সুমায় আচে নাকি?’
খালেক দুলালের কথা পিঠে বলে, ‘তুই যাই বলিস দুলাল, এই বয়সেও ওই মাগীর দুধ দু’টো একেবারে ডাঁসা ডাঁসা। আর পাছাটা আমাদের অজিত ঢুলির ঢোলের মতো। আমার আর সহ্য হচ্চে না ভাই।’
দুলাল খালেককে শান্তনা দিয়ে বলে, ‘শোন্ তুই চিন্তা করিস নে খালেক। ঐ মণ্ডল হারামজাদারে একটা উচিত শিক্ষা দিতি হবেনে।’
রাত অনেক হয়েছে। পূর্ণিমার আলোয় গাছের ছায়াকে মাটির উপর আলপনা মনে হচ্ছে। অদূর থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে। চারিদিকে কুকুর ঘেউ-ঘেউ করছে। একটা বাদুড় রমজান মণ্ডলের মাথার উপর দিয়ে ঝটপট করে উড়ে গেলো। রমজান মণ্ডলের বুকের মধ্যে ছলাৎ করে উঠলো। বিড়ি টানতে টানতে পা টিপে টিপে চোরের মতো বাড়িতে ঢুকলো মণ্ডল। ঘরের বারান্দায় চৌকির উপর হারিকেনটি মৃদুভাবে জ্বলছিলো। মণ্ডল হারিকেনটি নিয়ে কলতলার দিকে গেলো। শিথান থেকে হারিকেন নেওয়ার শব্দে রমজান মণ্ডলের বউ শায়লা বেগমের ঘুম ভেঙে গিয়েছে। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো শায়লা। কাঁচা ঘুম থেকে উঠে চৌকির উপর পা ঝুলিয়ে বসে হাই তুলছিলো। বারান্দায় এসে রমজান মণ্ডল মিহি সুরে বললো, ‘তুমি একনো ঘুমোওনি?’
রমজান মণ্ডল যেনো বিষধর নাগিনীর লেজে পা দিয়েছে। বিষোদ্গার করে শায়লা বেগম বলল, ‘আমার ঘুম নিয়ে তুমার এতো ভাবনা কিসির?’
বোকার মতো রমজান মণ্ডল বললেন, ‘আমার ভাত কই?’
শায়লা বেগম তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে উঠে. ‘ওরে বাবা! তুমার আবার ভাতও খাওয়া লাগবেনে। ক্যানে, যার বাড়ি এতো রাত পয্যন্ত ছিলে, সে ভাত দিইনি? আর এতো রাতি আসারই বা দরকার কি? বাকি রাতটুকুন ওই মাগীর সাতে কাটাতি পারতে না?’
মিনতির সুরে মণ্ডল বললো, ‘দুহাই তুমার, এতো রাতি ঝকড়া বাদানোর চিষ্টা করো না। ছেলেমেয়েরা জেগে যাবেনে। তারা একন বড় হয়েচে না!’
বিকৃতভাবে অবজ্ঞার সুরে শায়লা বললো, ‘ওরে আমার সনমানি লোক রে! এতোই যোদি সনমানের ভয়, তালি ঐ রকম এট্টা ছিনাল মাগীর বাড়ি পড়ে থাকতে না। বিহায়াদের আবার নজ্জা-শরম থাকে নাকি?
মণ্ডল চাপা গলায় বলে, ‘দয়া করে চেচামেচি করো না। আশেপাশের লোকজন জেগে যাবেনে।’
গলার স্বর আরো দুই স্কেল বাড়িয়ে শায়লা বেগম বললো, ‘সবাই জাগুক, সারা গিরামের লোক এসে তুমার কিত্তি-কলাপ দেকে যাক। ঘরে যার বিয়েদারী শিয়ানা মেয়ে…।’
শায়লা বেগমের বাক্য আর শেষ হলো না। মণ্ডলের মাথায় যেন রক্ত উঠে গেলো। দ্রুত শায়লা বেগমের গলা টিপে ধরে শূন্যে তুলে ধপাস করে ফেলে দিলো। শেয়ালের মুখ থেকে ছাড়া পাওয়া মুরগীর মতো শায়লা বেগম দ্রুত ঘরের ভিতর চলে গেলো। খাটের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে হাফাচ্ছে। মৃত্যুর দ্বার প্রান্ত থেকে যেনো ফিরে এসেছে সে। রমজান মণ্ডল একহাতে হারিকেন আর এক হাতে দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি ঘরের মধ্যে কি যেন খুঁজছে। আবছা অন্ধকারে শায়লা বেগমের সুডৌল বুকের উঠানামা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : একটি শব্দ লেখার কারনে আশা করি এই গল্পটিকে কেউ অশ্লীল ভাববেন না। আসলে একটি বাস্তব ঘটনার প্রেক্ষিতে লেখা এই গল্প।
(চলবে…)
১৮টি মন্তব্য
সাতকাহন
এটা আমার এফবি আইডি https://www.facebook.com/swadheenota.tumi
জিসান শা ইকরাম
ঝর ঝরে বর্ণনা এবং চমৎকার গল্পের মধ্য দিয়ে ১ম পর্ব শুরু
শুরুটা বেশ আকর্ষণীয় হয়েছে
লিখতে পারেন বটে আপনি (y)
অশ্লীল মনে হয়নি কিছু ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ ভাইয়া, আপনা সহযোগীতা আছে বলেই লিখতে পারছি।
আদিব আদ্নান
পড়লাম এবং অপেক্ষায় থাকলাম ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ ভাইয়া।
শিশির কনা
সামাজিক দন্দ আসলেই প্রাচীন , এ থেকে মুক্তিও নেই আসলে । যুগ শতাব্দী পার হয়ে গেলেও চিত্রগুলো চিরচেনা । পরের পর্বের অপেক্ষায় (y)
সাতকাহন
এই দ্বন্দ নিয়েই মানুষ এখনো বেঁচে আছে, আর এই গল্পটির প্লট চিন্তা করতে গিয়ে আমি বাঙলা প্রতিটি গ্রামের চিত্র দেখতে পেয়েছি।
খসড়া
আপনি লিখছেন বেশ ঝরঝরে ভাবে। লিখুন, লেখায় চমক আছে। বাস্তবতার প্রয়জনে কিছু চিত্র আসতেই পারে। ভাবনার কিছু নেই।অশ্লীলতা বাস্তবতার অংশ। তবে শুধু খেয়াল রাখবেন তা যেন মাত্রা না ছাড়ায়। আর একটু বড় করে লিখলে হয় না।
সাতকাহন
অবশ্যই ভাই, চটি লিখতে আসিনি, মাত্রা ছাড়াবে না। আপনি শুধু পাশে থাকবেন।
ছাইরাছ হেলাল
বাস্তবতার পরবর্তী অংশের অপেক্ষা করছি ।
সাতকাহন
থ্যাঙ্কস ভাই।
ব্লগার সজীব
আমাদের চিরচেনা সমাজের কথা উঠে এসেছে আপনার লেখায় । অপেক্ষায় থাকলাম ।
সাতকাহন
জানি না এটা আদৌ গল্প হয়ে উঠছে কিনা, তবে বাস্তব চিত্রই তুলে ধরবো আমার সব লেখায়।
প্রজন্ম ৭১
অসাধারন এক গল্পের পূর্বাভাস পাচ্ছি 🙂
সাতকাহন
পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
হতভাগ্য কবি
গল্পে বাস্তবের গন্ধ পেলাম। চমৎকার লিখেছেন।
সাতকাহন
আমাদের আশ-পাশে এই ঘটনাগুলোই ঘটে ভাই। ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার জন্য।