জাতিকে নির্বাচন উপহার দেবার দায়িত্বে থাকা নন্দঘোষ কমিশনটির নাম নির্বাচন কমিশন। উপরে হাইকোর্ট, ডানে শুয়োরাণী এবং বামে দুয়োরাণী-এই তিনের মন রক্ষা করে চলা কঠিন ব্যাপার। এবারের নির্বাচন তাদের জন্য গ্রেট চ্যালেঞ্জ। দেবদূতের মতো গোলগাল চেহারার সিইসি চেয়ারে বসেই ১৯৭২ সনের গণ-প্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ-এর সংশোধন কাজে হাত দিলেন। ধারা উপধারায় সূচাঁলো শিং বসিয়ে কগনিজিবল অফেন্সকে আরো ষ্পষ্ট করা হলো। আইনি দিকটা সেরে তারা মাঠ পর্যায়ের তদারক শুরু করলেন।
আমজনতার নির্বাচনী বিধিমালার খুঁটিনাটি নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। নির্বাচন তাদের কাছে একটা ভিন্নতর আনন্দ উত্তেজনার বিষয়। গ্রামের অশিক্ষিত জনতা কার্ল মার্কসের ‘দাস ক্যাপিটাল’ কিংবা প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ পড়ে মাথা নষ্ট করেনি। নির্বাচন কিংবা রাজনীতি সম্পর্কে তাদের ধারণা এবং যুক্তি শ্রীরামকৃষ্ণ পরম হংস দেবের নীতিকথার মতো আটপৌঢ়ে গ্রামীণ সহজ-সরল। মাদারীপুর শহরতলির হাওয়ালাদারদের হাটের সবচেয়ে দরিদ্র চায়ের দোকানী আলালদ্দির ধারণা দেশের প্রবল দুই দলের স্বভাব চরিত্র তার দুই পুত্র আবুল-কাবুলের মতো। বাড়িতে কালেভদ্রে ইলিশ মাছ রান্না হলে দু’জনেই মাছের মাথা খেতে চায়।
কাবুল কয় : ‘বাজান আমি মুড়া খামু।’
আবুল একটু বড়, তার বুদ্ধি-টুদ্ধিও একটু বেশি। সে ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলে : ‘বাজান আমি লেঞ্জা খামুনা।’
হালার পুতরা কেউ লেঞ্জা খাইতে চায় না। বউ শেফালী ক্ষেপে ওঠে। ‘দুইডা কল্লা পামু কই নোয়াবের বাচ্চা, ধর আমার কল্লাডা খা।’
নির্বাচন এসে পড়ায় আলালদ্দির বিক্রি-বাট্টা ভালোই। দুই পুত্রের আনন্দিত মুখ দেখার জন্য দুটো ইলিশ মাছ কিনে আনে সে। দু’জনের থালায় দুটো ইধিলশের মাথা দেবার পর আবুল-কাবুলের চেহারায় যে আনন্দ ফুটে উঠেছিলো তার পরিপূর্ণ বর্ণনা পৃথিবীর কোনো ভাষায় দেয়া সম্ভব নয়। আলালদ্দির দুই পুত্রের মন পেতে দু’টো ইলিশ জোগাড় করা সম্ভব। কিন্তু দুই দলের শাসনের জন্য দু’টো দেশের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়।
মহাসচিবের নাতির বিয়ে উপলক্ষ্যে ইমনকে মহাসচিবের বাসায় যেতে হলো। মহাসচিব তাকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। জরুরী অবস্থার মহাদূর্দিনে এই ছেলেটির সাহায্যের কথা মনে পড়ে যায় তার। ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার পুত্রের সাথে ইমনের সখ্যতা ছিলো। সুদুর অষ্ট্রেলিয়া থেকে একটা টেলিফোনের কারণে অনেক বিপদ থেকে বেঁচে গেছেন তিনি।
চারদিন ছুটি কাটিয়ে কর্মস্থলে যোগদান করে ফৌজদারী ও দেওয়ানী কার্যবিধির সমুদ্রে ডুব দিলেন মজিদ সাহেব। দেড় মাসের মধ্যে ইমন-সুমন কিংবা নুরজাহান আপার সাথে যোগাযোগের সময়টুকু পেলেন না তিনি। আদালত গৃহে যেমন, মহানুভব বিচারক থাকেন তেমনি দুষ্টু ইঁদুর সদৃশ কিছু কর্মচারীও থাকে।
জারীকারক সমন-ডিক্রীজারী করে, পেশকার পেশকার সাহেব মামলার তারিখ আগুপিছু করে জনগণের প্রতি তাদের জোঁক ভূমিকা পালন করে। আদালতের রেকর্ডরুম প্রায় স্বায়ত্বশাসিত এলাকা। নথি যতো পুরাতন তার নকল কপির দামও ততো বেশি। নথি পুরোনো হওয়াটাকে এখানে পাবলিকের অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
মজিদ সাহেব এই দিকটায় কঠিন নজর দিলেন। কড়া মাষ্টারের মতো বেত হাতে সবকিছুর মনিটরিং করতে লাগলেন। এই ভয়াবহ ব্যস্ত সময়ে নুরজাহান আপার কাছ থেকে দুঃসংবাদটি পান তিনি। সুমনা নামের এক কোটিপতির কন্যার সাথে ঘটনাচক্রে সুমনের বিয়ে হয়েছে। মজিদ সাহেব সেই ঘটনাচক্রের মধ্যে ঢুকতে চাইলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন সুমন নুরজাহান আপাকে দিয়ে ফোনটা করিয়েছে, হারামজাদাটা জানে মজিদ সাহেবের আইনের হাত যতো লম্বা হোক তা নুরজাহান ফুপুর আঁচল ভেদ করে তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। মজিদ সাহেবের ইচ্ছে করছে সুমনকে একটা থাপ্পর মারতে। তিনি ছুটির সুযোগ খুঁজতে লাগলেন।
নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি বাড়ির উঠানে পা রাখার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে প্রচারণায় নেমেছে ইমন। গ্রামের মানুষের সুখ দুঃখের কথা শুনতে শুনতে তার দিন কেটে যায়।
তার রানিংমেট সুনীল হাজরা গ্রামের সমস্যা, বিশেষ করে নিখুঁতভাবে কৃষকের সমস্যা তুলে ধরেন। সুনীল এক সময় হাড়ে মজ্জায় কমিউনিস্ট ছিলেন। ছেলে বেলায় কোনো এক কার্তিক মাসে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে সেই যে এপাড় বাঙলায় ঢুকলেন আর ফিরে গেলেন না। সুনীল জানেন শ্রেণীহীন শোষণমুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা তিনি দেখে যেতে পারবেন না। তার পরেও তার সূর্যস্ফুলিঙ্গ স্বপ্নটাকে সবার কল্পনার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে চান।
সুনীল গতকালও বলছিলেন কৃষকের কথা, বুর্জোয়াদের সীমাহীন ক্ষুধা মেটাতে আইন প্রশাসনের খড়গ নেমে আসে কৃষকের ওপর। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে কৃষক নিপীড়নের অশুভ সূচনা হয়। ইংরেজ জোর করে নীলচাষ করিয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কৃষকের উৎপাদিত খাদ্যশস্য পাঠিয়ে দিয়েছে ব্রিটিশ সৈন্য শিবিরে। বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের চিল্লাচিল্লি কানে তোলেনি ব্রিটিশরাজ। শিল্পচার্য জয়নুল কাক-কুকুরের কয়েকটি রেখাচিত্র এঁকে না রাখলে অনায়াসে তা ভুলে যেতো বাঙালি। পাকিস্তান সরকার যা করেছে তো করেছেই। বঙ্গবন্ধু সরকার বাদে স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারগুলো কৃষকের কথা ভাবেনি, বরং সার চাওয়ার অপরাধে কৃষককে গুলি করে মেরেছে।
পরের দিন ইমন আবুল-কাবুলদের গ্রামে ঢোকে। আবুল-কাবুল বড় কষ্টে আছে। আলালদ্দির দিন কাটে কাপের মধ্যে গরম পানি, চা পাতি, চিনি, দুধ রেখে চামচ দিয়ে টিক টিক বাজনা বাজিয়ে। অর্ডারের পর অর্ডার। শেফালী বাড়িতে বসে পুরী সিংগারা বানায়। সন্ধ্যার পর গ্রামের লোকজন হাটে ওঠে। নির্বাচনী ভলান্টিয়াররা চায়ের সাথে সিংগারা চায়। আবুল-কাবুল বাবা-মার সান্নিধ্য না পেয়ে মন মরা হয়ে পড়ে। ওদিকে মোল্লাবাড়ির পোলাপানের সাথে মিশতেও শেফালীর নিষেধ আছে। শেফালীর ভাষায় তারা জাউরা পোলাপান। শেফালীর নজরদারি না থাকায় এদের দলে ভিড়ে যায় আবুল-কাবুল। সারাদিন ডাংগুলি খেলে। ওদের সাথে থেকে একটি ছড়া শিখে ফেলেছে আবুল-কাবুল :
ইসকি মিসকি সাগুর দানা
রাইত পোহাইলে বৈঠকখানা
মামায় আইছে ঘামাইয়া
ধর ছাতি টানাইয়া
ছাতির ওপর বল্লা
ধর মামার কল্লা
ছোট মামানি রান্ধে বাড়ে
বড় মামানি খায়
মাইঝা মামী গাল ফুলাইয়া
বাপের বাড়ি যায়
বাপের বাড়ির ছেমরিরা
জামাইরে কয় জাম্বুরা
কমফারে কয় পেঁপে
… … … …
(ভদ্রতার বর্ডার লাইন ক্রস হবার ভয়ে ছড়াটির শেষাংশ উদ্ধৃত করা গেলো না)
(চলবে…)
আগের পর্বগুলোর লিংক :
নিছক গল্প-১
http://sonelablog.com/archives/3193
নিছক গল্প-২
http://sonelablog.com/archives/3229
নিছক গল্প-৩
http://sonelablog.com/archives/3286
নিছক গল্প-৪
http://sonelablog.com/archives/3370
১৩টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
ইমনরাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যত।
সাতকাহন
দেখতে থাকেন
বনলতা সেন
দু’দলের জন্য দু’টো দেশ পাওয়া যায় না ।
কতই না অবাস্তবায় আমাদের সহ্য করতে হয় ।
সাতকাহন
ভালো বলছেন
মিসু
ভালো লিখেছেন । ভালো লাগছে গল্প । (y)
সাতকাহন
ধন্যবাদ সাথে থাকবেন
হতভাগ্য কবি
চমৎকার (y)
সাতকাহন
ধন্যবাদ
জিসান শা ইকরাম
শ্রেণীহীন শোষণমুক্ত সমাজ ব্যাবস্থা নিয়ে একসময় আমিও ভাবতাম
কিন্তু দেশের বাস্তবতায় এটি আর সম্ভব না ।
গল্প এগিয়ে যাচ্ছে আপন গতিতে – পড়তে বেশ লাগছে ।
সাতকাহন
আসলে ধার করা কমিউনিজমে এই দেশের পরিবর্তন হবে কখনো
শিশির কনা
খুব ভালো একটি উপন্যাস হতে পারে আপনার এই ধারাবাহিক গল্প (y) -{@
সাতকাহন
উপন্যাস লেখার সাহস এখনো হয়নি, এটা বড় গল্প
ব্লগার সজীব
গল্প তো দৌড়াচ্ছে ভালোই (y)