11182178_10205206830862965_6771439362878257708_n
‘ধর্ষণের পর হত্যার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড’ এই আইনের বিধানকে বাতিল করে পাশাপাশি যাবজ্জীবনের বিধান রেখে আপিল বিভাগের রায়!!!

ধর্ষণ আর নারী নিপীড়ন যখন আতঙ্কজনক পর্যায়ে উপনীত, ঠিক তখনই এমন একটি রায়!
কি বলবো? কিচ্ছু বলার নেই।

শুধু একটা কথাই মনে আসছে, মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প শাস্তি না থাকায় সংশ্লিষ্ট আইনের সে বিধানকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে বিকল্প শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড রাখার কথা বলা হয়েছে। তো, বিকল্প শাস্তি আরেকটা সংযোগ করলে হতো না? প্রমানিত হলে লিঙ্গ কর্তন! খুব অমানবিক? মোটেও না।
ধর্ষিতা তো সারা জীবনই ভুক্তভোগী হয়। সমাজে আধমরা হয়ে বেঁচে থাকে। তেমন করে ধর্ষকও চিহ্ন বহন করে বেড়াতো! সাময়িক সুখ ভোগ করে একটা নারীর জীবনকে ধ্বংস করার খেসারত সারাজীবনই ভোগ করতো।

প্রতিদিন যেখানে দেশে গড়ে কয়েকশো থেকে হাজার এর মতো ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। তিন বছরের শিশু থেকে ৬০ বছরের প্রৌঢ়াও বাদ পড়ছেন না নরপশুদের হাত থেকে। তারপর আবার যৌনসুখ ভোগ করার পর অনেক ক্ষেত্রে হত্যার ঘটনাও ঘটে চলছে। যেখানে প্রতিদিন ধর্ষণের খবর পড়ে পড়ে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছি, ঠিক সেইমূহূর্তে এরকম একটি রায়!

সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বেপরোয়া ঘটনা নতুন করে জানান দেয় আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান কোথায়।
এক*
১লা বৈশাখে টিএসসিতে পুরো ঘটনাটি ঘটেছিলো এক ঘন্টারও বেশি সময় ধরে। যাদের নির্যাতন করা হয়েছিলো তাদের মধ্যে কিশোরী, যুবতি এমনকি সন্তান নিয়ে ঘুরতে আসা মাও ছিলেন। পাশবিক এই অপরাধে তরুণ থেকে শুরু করে ষাট বছরের বৃদ্ধও লিপ্ত ছিলো। একেকটা গ্রুপ একেকজন নারীকে ঘিরে ধরে হামলা চালিয়েছিলো। চিৎকার চেঁচামেচি যাতে অন্যরা শুনতে না পায় সেজন্যে ভুভুজেলা (একপ্রকার বিকট শব্দের বাশিঁ) বাজানো হয়। যে সমাজ রাস্তায় নারী নির্যাতনের মাধ্যমে বুনো উৎসব করে, সে সমাজ কোনোভাবেই সভ্য হতে পারে না। সভ্যতার আস্তিনের তলে বাস করে আসলে এক অসভ্য-কুৎসিত সমাজের অস্তিত্ব। যতো সুকৌশলেই সভ্যতার মেকি চাদরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কুৎসিত চেহারাটা ঢেকে রাখা হোক না কেনো সেদিন তা প্রকটভাবেই উন্মোচিত হয়েছে।

দুই* খবর : ২৫ এপ্রিল, ২০১৫-কালের কণ্ঠ।
গাজীপুরে ধর্ষণের চেষ্টা কালে ব্যর্থ হয়ে বাপ-ভাইয়ের উপস্থিতিতে শোবার ঘরে মা-মেয়েকে কুপিয়ে হত্যা!
সাত-আটজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি রাতের অন্ধকারে দক্ষিণ পাশের জানালা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে। ভেতরে কলেজছাত্রী আরিফা আক্তারকে (২২) ধর্ষণ করে বা ধর্ষণের চেষ্টা কালে ব্যর্থ হয়ে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে। এসময় ভেতরে মা, বড় ভাইও ছিলো, দুর্বৃত্তরা তাঁদেরও এলোপাতাড়ি কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। আরিফাকে বিবস্ত্র অবস্থায় পাওয়া যায় এবং হাসপাতালে আনার আগেই মৃত্যু হয়।
এবার কি বলা হবে আরিফা উগ্র পোষাক পড়েছিলো? ওর পোষাকে যৌনাবেদন ছিলো?

তিন* খবর: এপ্রিল ২৮, ২০১৫-প্রথম আলো।
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে যমুনার চরে বাবাকে নৌকায় আটকে দুই বোন ধর্ষণ করা হয়!
কৃষকের ২৩ ও ১৯ বছর বয়সী দুই মেয়ে গাজীপুর পোশাক কারখানায় কাজ করে। নববর্ষ উপলক্ষে গত ১৩ এপ্রিল তারা বাড়ি ফিরছিলো। ফিরতে রাত হতে পারে বলে মুঠোফোনে বিষয়টি বাবাকে জানালে সুজাল (২৮) নামের স্থানীয় একজনের নৌকা ভাড়া করে তাঁদের বাবা গোবিন্দাসী ঘাটে যান। ঘাট থেকে রাত সাড়ে নয়টার দিকে দুই মেয়েকে নিয়ে ওই কৃষক নৌকায় বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। রাত ১০টার দিকে নৌকাচালক সুজালের যোগসাজশে একই উপজেলার বিহারীর চরের আসাদুলের (৩০) নেতৃত্বে নজরুল (৩০), রকমান (২২), সাইদুল (২৫) অপর একটি নৌকায় এসে তাঁদের গতিরোধ করে। এ সময় দুই বোনের সঙ্গে থাকা টাকা ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়। পরে বাবাকে নৌকায় আটকে রেখে দুই বোনকে চরে নামিয়ে আসাদুল ও রকমান তাদের ধর্ষণ করে।
আইনগত শাস্তির বিধান থাকা সত্বেও রাতে বাবার সাথে মেয়েরা নিরাপদ নয়। আর এখন তো দিনের আলোতেও অহরহই এমন ঘটনা ঘটতে পারে।

ধর্ষকরা জোরপূর্বক যৌনসুখ ভোগ করতে গিয়ে একটা নারীর জীবনকে চিরতরে ধ্বংস করে ফেলে আর তাকে জীবনসুখ ভোগ করার সুযোগ দেয়ার জন্য আইন পাশ হয়।
বাহ!
আদালতের কোন লিঙ্গ থাকার কথা নয়। কিন্তু সমাজ, আদালত সবই পরিচালিত হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোতে। কাজেই পুরুষতান্ত্রিকতারই জয় হয়েছে! বেগম রোকেয়া, প্রীতিলতার বাঙলায় নারী অধিকার পরাজিত হয়েছে! এদেশে বিপুল সংখ্যক ধর্মান্ধ পুরুষ ধর্ষণের জন্য নারীকেই দায়ী করে, তাদের জয় হয়েছে!

এখন হয়তো সমাজে ধর্ষণের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। আরও বেপরোয়া হয়ে যেতে পারে নরপশুদের আস্ফালন। এতোকাল ধর্ষণের ঘটনা পাহাড়ে আর সমতলে দরিদ্র নিম্নবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো, এবার হয়তো সেই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করবে। যে কোন বয়সের, যে কোন শ্রেনির মেয়ের সাথেই হয়তো ধর্ষণের ঘটনা ঘটবে।
পরোক্ষভাবে তাহলে কোন পথে ছুটছে বাংলাদেশ?

মেয়েরা! সাবধান হয়ে যাও এবং প্রস্তুত হয়েই পথে নামো। কারন যে অপরাধের শাস্তি যত লঘু সে অপরাধ ঘটবে ততো বেশি এইতো স্বাভাবিক। এতোদিন ধর্ষিত হয়ে শুধুমাত্র আইনের সাপোর্ট পাওয়ার জন্য প্রমাণ রেডি করতে তোমাকে বারবার মানসিকভাবে ধর্ষিত হতে হয়েছে। এখন আর আইনও সেরকম শক্তভাবে তোমাকে সহায়তা দেবে না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়ম-কানুন বরাবরই পুরুষদের অনুকুলে ছিলো। এই সভ্য যুগেও আইন পাশ হয় ওদের অনুকুলেই। যে দেশের আইন একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গের পক্ষে কাজ করে, সে দেশে নারীর সম্মানই বা থাকে কতটুকু।

সমাজ-ব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক। তাই এর চারিত্রিক কাঠামোও পুরুষাধিপত্যবাদী। আর এ কাঠামোতে নারীর অবস্থান গবেষণা করে নৃবিজ্ঞানী সারা সি হোয়াইট রাজশাহীর কুমিরপুর (লেখিকার দেওয়া ছদ্মনাম) গ্রামের উপর লিখিত তার বিখ্যাত ‘এথনোগ্রাফি আর্গুইং উইদ দ্য ক্রোকোডাইলস: জেন্ডার আ-ক্লাস ইন বাংলাদেশ’ (১৯৯২) গ্রন্থে প্রতীকী উপস্থাপনায় দেখিয়েছেন যে, এ-সমাজ হচ্ছে আসলে একটা পুকুরের মতো আর এ-সমাজে বসবাস করা পুরুষ হচ্ছে ‘কুমির’। সমাজের নারীরা এসব কুমিরদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পুকুরে বাস করে। যাকে প্রবাদবাক্যে বলা হয়, ‘জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ’। এটা রূপাকার্থে সমাজে বসবাসরত নারী-পুরুষের এক ধরনের অসম-ক্ষমতা এবং নারীর উপর পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্যবাদ বা আধিপত্যবাদী সম্পর্কই নির্দেশ করে। অতএব, সমাজের কুমিরেরা নিজের মতো করে নারীর ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণ করবে; তাকে ইচ্ছেমতো নির্মাণ করবে; তাকে তার স্বাধীন ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিচালিত করবে; ভোগ করবে; কাপড় পরাবে, আবার প্রয়োজনমতো কাপড় খুলবে। এটাই কুমিরের সঙ্গে পুকুরের জলে বাস করার নিয়তি। পহেলা বৈশাখের নারীনির্যাতনের ঘটনা অনেকটা সারা হোয়াইটের কুমিরপুরের চেহারাকেই ফুটিয়ে তুলেছে।

যাহোক, অনেকদিন আগে একটি খবর পড়েছিলাম। হুবহু তুলে দিলাম-
‘কেনিয়ার কাবারাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী উনিশ বছরের কিশোরীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কের জেরে ৩২৪ জন এইচ আই ভি আক্রান্ত হয়েছেন। গত বছর বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি শেষে মাদকাসক্ত অবস্থায় জনৈক সিনিয়র ছাত্র তাঁর সঙ্গে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন। এর ফলে এইডস রোগে আক্রান্ত হয়ে যান ওই কিশোরী। এরপরেই ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতে পাল্টে যান কিশোরী। তাঁর দাবি, যৌন সম্পর্কের জেরে ইতিমধ্যে ৩২৪ জন পুরুষকে তিনি এইডস আক্রান্ত করেছেন। তাদের মধ্যে ১৫৬ জন ছাত্র। বাকিরা বিবাহিত। কিশোরী জানিয়েছেন, এটাই তাঁর প্রতিবাদের ধরন। আরও অনেক জনকে তিনি ‘শিকার’ বানাতে চান। নিজেই সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন।’

আমরা চাই না এমন হোক। কিন্তু ১লা বৈশাখের ঘটনাটির মতো অস্বাভাবিক ঘটনা বারবার ঘটতে থাকলে কি হতে পারে?
তারপর আবার লঘুদন্ডের বিধান সংযোজন করে রায় প্রদান!
কোনদিকে যাচ্ছি আমরা???

৬৯১জন ৬৯২জন
0 Shares

১৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ