
রুক্ষ মরুভূমিতে বৃথা ফুল ফোটানোর শত সহস্র বছরের সব প্রচেষ্টাকে একপাশে ঠেলে বেদুঈন দিগ্বিজয়ের ক্লান্তিতে যেন এক দিশেহারা বাউলা পথিকে রুপান্তরিত হয়েছে। খাপমুক্ত তরবারিতে শান নেই, মাথার পাগড়ি হারিয়ে গিয়েছে মরুঝড়ে।
নিত্যকার সঙ্গী উলউলের কেশরে জটা লেগেছে। চামড়া কুঁচকে বুড়ো হতে হতে প্রাণীটি এখন শুধুই একটা দূর্বল অশ্ব। ছুটে চলার সেই শক্তি সাহস কোনটাই তার নেই। সহিস যেখানে সকাল-সন্ধ্যা মৌনব্রত অবলম্বনে ছুটে চলেছে, তার বাহনের হ্র্বষা ধ্বনিও যে মৌনতার দীর্ঘশ্বাসে রুপ নেবে এতো বলাই বাহুল্য।
কোন এক শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে রোম নগরীতে মায়াবী আলোকছটার যে ঝলক বেদুঈন হৃদয় গহ্বরের ব্রহ্মাণ্ডকে তছনছ করে দিয়েছিলো সেই লুক্রেতিয়া আজ ভোরে আবারো স্বপ্নে এসেছে। কানে কানে বলেছে ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের মত অপেক্ষমান নির্জলা চিরসত্যটি – ‘আমি ভালো নেই বেদুঈন, আমাকে খুবলে খাচ্ছে হিংস্র হায়েনার দল’।
ক্লান্ত-শ্রান্ত ঘাম শুকোনো দেহে শুয়ে থাকা নিথর বেদুঈন ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। বালুকাবেলার স্নিগ্ধ আলোয় চোখে ভাসে নগ্ন সোনালি অতীত। সেই আলেকজান্দ্রিয়ার ধবধবে শুভ্র প্রাসাদ; বন্দী আমার প্রিয়তমা লুক্রেতিয়া, দূর দ্বীপবাসিনী!
পৃথিবীতে যীশুর আগমনের পূর্বভাগে বেদুঈনের মনে আস্ফালন জাগানো যে প্রেম অঙ্কুরেই ঝড়ে গিয়েছে, আজ স্বপ্নে লুক্রেতিয়াকে দেখার পর এইভাগে এসে তা যেন হঠাতই তপ্ত লাভার রঙিন রুপ ধারণ করেছে। অপ্রতিরোধ্য ছুটে চলা তরল অনলের ভয়ঙ্করদর্শন মাতমের মতন বেদুঈন চিৎকার করে ডাকে লুক্রেতিয়া! আমার লুক্রেতিয়া!
ভোরের মিষ্টি আলোয় কিংবা রাতের নিশ্চিদ্র অন্ধকার বিদীর্ণ করে বেদুঈনের সে চিৎকার কি শুনতে পেয়েছিলো লুক্রেতিয়া? ধর্মের বেড়াজালে বন্দী বেদুঈনের সেই অমর প্রেম একাকী নীরবে নিভৃতে প্রহর গুনছে আজও। অপেক্ষায় আছে লুক্রেতিয়া, আমার প্রিয়তমা লুক্রেতিয়া!
তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে শতক্রোশ পথ ঘুরে, গেরুয়া সাজে সজ্জিত বেদুঈন এবং উলউল দু’জনাই এসে দাঁড়িয়েছে টিবার নদের পাড়ে। ঐ দূরে আলেকজান্দ্রিয়া দ্বীপে বন্দী লুক্রেতিয়ার দীর্ঘশ্বাসের ধ্বনি যেন বাতাসে শিস কেটে যায়। কানে আসে লুক্রেতিয়াকে উপহার দেয়া ম্যাকাও পাখির করুণ কান্নার সুর।
বেদুঈনের দেহে বান ডাকে; রক্তের লোহিত কনিকারা আলোড়িত হয় রন্ধ্রেরন্ধ্রে। খাপ থেকে উন্মুক্ত তরবারি হাতে উলউলের হ্রেষার বেগে ছুটে চলে বেদুঈন। আমি এসেছি লুক্রেতিয়া! চার দেয়ালের অন্ধকারে বন্দি প্রেম দেখবে আজ পৃথিবীর আলো।
উলউলের পিঠে সওয়ারী লুক্রেতিয়াকে জড়িয়ে রক্তাক্ত তরবারি হাতে বেদুঈন ছূটে চলেছে মরুর পানে। গ্রানাইট প্রাসাদের ফাটলে ফাটলে বইছে নোনা রক্তের ধারা। পাঁচশত বছরের অন্ধকার বিদীর্ণ করে আলোকিত হয়েছে বেদুঈনের প্রেম। বেদুঈন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, ‘রোমে এলেই আমি একজন রোমান’ একথার কোন ভিত্তি নেই। এটি হায়েনাদের সুযোগ সন্ধানী বাক্য মাত্র!
আমি মরুর বেদুঈন, ঈশান হতে নৈঋতের প্রতিটি ধুলিকণায় মিশে আছে আমার রক্তাক্ত ইতিহাস। আমি ভালোবাসতে জানি, ভালোবাসাকে কুক্ষিগত করা সর্বনাশা সম্রাটের শেষ পরিনতিও জানি। পৃথিবীতে টিকে থাকতে এ যে আমারই অস্তিত্বের লালিত ধারা। আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো। অনাদি অনন্তকালের ইতিহাসে শেষ প্রহরের সর্বশেষ ব্যক্তি বেদুঈনকে জয়ী প্রেমিক হিসেবে স্মরণ করবে একমাত্র আমার ইশ্বর।
চলো দূর দ্বীপবাসিনী, আবারো তুমি রুক্ষ মরুভূমিতে ফুল ফোটাবে। সকালের শুভ্রতায়, ভর দুপুরের তপ্ত রৌদ্রে আর গোধুলীর লাল আলোকছটায় তোমার খোঁপায় বেঁধে দেবো তিন রঙা ফুল।
লুক্রেতিয়ার কপালে আলতো চুমু দিয়ে বেদুঈন হাসে। শত সহস্র বছর ধরে আজন্ম ছূটে চলা বেদুঈনের মুখে আজ হাসির জোয়ার। পিছনে রোম জ্বলছে, দেবদারুর ছায়াতলে বেজে চলেছে নিরো’র বাঁশির সুর।
আহা! পৃথিবীতে আজও লুক্রেতিয়াদের অনেকেই প্রেমিক বেদুঈনের ভালোবাসা পায় না।
পুনঃশ্চ-
লুক্রেতিয়া – [৫১০ খৃষ্টপূর্বে রোমান সম্রাজ্যের ইতিহাসে একজন সম্ভ্রান্ত নারী, যিনি ধর্ষনের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর এই আত্মহত্যাই শত বছরের রোমান সম্রাজ্যকে পতনের মুখে ঠেলে দেয়।
পরবর্তীতে ৫০০ বছর পরে গণতান্ত্রিক রোমের সূচনালগ্নে দু’জন রোমান ইতিহাসবিদ ‘লিভি’ ও ‘ডায়নোসিস’ লুক্রেতিয়ার এই মর্মান্তিক ঘটনাকে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করেন।
এ শতাব্দীর ইতিহাসবিদরা অনেকেই লেডি লুক্রেতিয়াকে কাল্পনিকচরিত্র বলেই বিশ্বাস করেন। তবে কালের পরিক্রমায় লুক্রেতিয়ার সম্ভ্রম হারানোর ঘটনাটি পরবর্তীকালে রোমে নারীর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের পুনরাবৃত্তিকে রুখে দিতে এক ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন ঘটায়।
গল্পের নায়ক প্রেমিক ‘বেদুঈন’ পৃথিবীতে লুক্রেতিয়ার মত নিপীড়িত সকল নারীদের সাহসী অবলম্বন।]
টিবার নদী – রোমে অবস্থিত।
[বিস্তারিত জানতে নীল কালিতে হাইলাইটেড লেখায় ক্লিক করুন।]
১৮টি মন্তব্য
নাজমুল আহসান
বহুদিন পর ব্লগে এলেন ভাইছাব! আছেন কেমন?
তৌহিদুল ইসলাম
আছিতো ভালোই আলহামদুলিল্লাহ! আপনি আছেন কেমন?
বন্যা লিপি
হ…আমিও কইতাছি, ভাউ বহুকাল পর পদধূলি দিলেন এ পাড়ায়।
গল্প ঠান্ডা মস্তিষ্কে পড়তে হবে। আবার আসব।
তৌহিদুল ইসলাম
আচ্ছা আসুন, আসলে লেখালিখির সময়টা সেইভাবে হচ্ছেনা।
হালিমা আক্তার
অনেক দিন পর এলেন। যুগে যুগে নারীরা নিপীড়িত হয়ে আসছে। ভালো লাগলো গল্পটি। শুভ কামনা রইলো।
তৌহিদুল ইসলাম
আপনাদের লেখা পড়িতো আমি। নিজে লিখতে পারছিনা ব্যস্ততার জন্য। ভালো থাকবেন আপু।
মনির হোসেন মমি
ইতিহাস পরিবর্তনে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার আর্বিভাব ঘটে।রোমান সম্রাজ্যের পট পরিবর্তনে লুক্রেতিয়ার ঘটনা বেদুঈনের প্রেম সব যেনো এখন স্বাক্ষী হয়ে আছে রোম ইতিহাসের পাতায়।
বহুদিন পর অপেক্ষায় ছিলাম ব্যস্ততা কাটিয়ে আসবেন।ধন্যবাদ।
ম্যাগাজিনের জন্য লেখা দিবেন।
ভালো থাকবেন
সুস্থ থাকবেন।
তৌহিদুল ইসলাম
সুন্দর মন্তব্যে ভালোলাগা। ইতিহাস আমার বরাবরই ভালো লাগে, তাই লিখি। সময় পেলে ম্যাগাজিনের জন্য লিখবো। শুভকামনা ভাই।
রোকসানা খন্দকার রুকু
নিপীড়িতদের নিয়ে কথা বলা লোকের বড্ড অভাব। কেবল সাহসীরাই পারে
ম্যাগাজিনের জন্য লেখা হলে শিরোনাম এ সোনেলা ম্যাগাজিন-২০২২ লিখে দেবেন।
নিয়মিত হবার চেষ্টা করুন ভাই🌹
তৌহিদুল ইসলাম
এ লেখা ম্যাগাজিনের জন্য নয়। ব্যস্ততা কাটিয়ে আসবো ইনশাআল্লাহ। ভালো থাকুন আপু।
সাবিনা ইয়াসমিন
সকাল দুপুর সন্ধ্যা, তিন বেলায় তিন রঙের ফুল খোঁপায় পরিয়ে দেবার ইচ্ছেটা ভালো লেগেছে।
শুভ কামনা 🌹🌹
তৌহিদুল ইসলাম
বেদুঈনের ইচ্ছেগুলো অসীম, সব ইচ্ছে পূরণ হয়না যে!
শুভকামনা আপু।
খাদিজাতুল কুবরা
গল্পটা খুব ভালো লেগেছে। অমর প্রেম গাঁথা এখনো আছে বলে বিশ্বাস করি এবং বাঁধাগুলো ও একই রকম আছে। একদিকে সত্যিকারের প্রেমের মাঝে ধর্ম এক বিশাল বর্ম অন্যদিকে নরপশুর দল খুবলে নেয় নারী মাংস।
চোখে পানি এসে গেছে।
নিয়মিত লিখুন তৌহিদ ভাইয়া।
আপনার লেখা মিস করি সবসময়
তৌহিদুল ইসলাম
পাঠকের আবেগে নিজেও তাড়িত হলাম আপু। মন্তব্যে অনেক ভালোলাগা।
শুভকামনা জানবেন।
জিসান শা ইকরাম
বেদুঈনের ভালোবাসা উদহারন হয়ে সবার মাঝে ছড়িয়ে যাক।
ভালো লেগেছে গল্প।
শব্দ চয়নে মুগ্ধ হলাম।
শুভ কামনা
তৌহিদুল ইসলাম
আপনার মন্তব্য সবসময়ই অনুপ্রেরণার। ধন্যবাদ ভাই
রিতু জাহান
রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে আমি বহুবার ডুব দিতে গেছি,,
এতো বিস্তৃত!
মিথ আমার খুব বেশি প্রিয়।
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই,, এমন সহজ করে লেখার জন্য।
আমার প্রিয় বিষয় ইতিহাসের এ অংশগুলো।
তৌহিদুল ইসলাম
ইতিহাস আমাকে সবসময়ই আকৃষ্ট করে আপু। পড়ার মত কিছু পেলে নাওয়াখাওয়া ভুলে আগে পড়তে বসি। ভালো থাকুন এটাই প্রার্থনা।