জীবন চিতা-(পর্ব৩)

আবু জাকারিয়া ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, বুধবার, ১০:৫৩:৫২পূর্বাহ্ন সাহিত্য ৬ মন্তব্য

পর্ব-৩

এক সপ্তাহ পর সন্ধ্যার আগে শহর থেকে বাড়ি আসল মুহাম্মদ। এই সপ্তাহে ভাগ্যটা তার পক্ষে ছিল। পুরো এক সপ্তাহ কাজ করতে পেরেছে সে। যারা কাজ করিয়েছে তারা উপযুক্ত বেতনও দিয়েছে। কোন মালিক একটা টাকাও বাকি রাখেনি। পারিশ্রমিক সবাই নগদে পরিশোধ করে দিয়েছে। সে কারনে মনটাও কিছুটা ভাল মুহাম্মদের। জামিলা হেসে বলল, সুমাইয়া এসেছিল বর নিয়ে।
মুহম্মদ কিছুটা অবাক হয়ে বলল, কখন আসল আর কখন গেল?
-এসেছিল তুমি যাওয়ার পরের দিন, রাত্রে থেকে সকালে চলে গেছে।
-গেল কেন? তুমি ওদের থাকতে বলনি?
-বলেছিলাম কিন্তু থাকল না।
-কেন?
-জামাইয়ের নাকি বাড়ি কাজ পরে আছে, মসজিদে ইমামতি আছে।
-তাই বলে আমার সাথে একটু দেখাও করলো না?
-ওরা কি জানতো তুমি বাড়ি নেই, শহরে কাজ করতে গিয়েছ?
মুহাম্মাদ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, কেমন আছে ওরা?
-ভালই।
-ভাল থাকলেই ভাল।
মুহাম্মদ সানিকে বাড়িতে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল, সানি কই গেল?
-আসে পাশে খেলছে হয়ত।
-সন্ধ্যার আগে বাড়ি চলে আসতে বলবে। কারন এখানে আমাদের শত্রুর অভাব নেই।
-এখনই চলে আসবে। ও সন্ধ্যার পরে বাইরে থাকেনা, আমি নিষেধ করে দিয়েছি। ওইতো সানি চলে এসেছে।
মুহম্মদ পেছনে তাকিয়ে সানিকে দেখতে পেল।
মুহাম্মদ তার হলুদ চালের ব্যাগ থেকে চারটা বিরিয়ানির প্যাকেট বের করল। সাথে সাথে ঘ্রান ছড়িয়ে পরল চারদিকে। জামিলা হাসি মুখে বলল, কোথায় পেলে?
-শহর থেকে কিনে এনেছি।
জামিলা একটা প্যাকেট নাকের কাছে নিয়ে বলল, কি ঘ্রান!
মুহাম্মদ বলল, ঘ্রান নিলে কি পেট ভরবে, বেড়ে দাও সবাইকে।
জামিলা বলল, এখনই?
-দাও, সানি আর মনির হয়ত খেতে ইচ্ছে করছে।
-আচ্ছা।
জামিলার মনে পরছেনা, সর্বশেষ কবে বিরিয়ানি খেয়েছিল সে। তবে বিয়ের পর প্রায়ই সখ করে রান্না করতো। কিন্তু এখন এসব আর ভাল লাগেনা। তাই রান্না করাও হয়না অনেকদিন। তবে হঠাৎ করে বিরিয়ানি সামনে পেয়ে খুব আনন্দ লাগছে ওর। পেকেটের সব বিরিয়ানি একটা গামলায় ঢেলে নিল জামিলা। তারপর সবাইকে প্লেটে করে খেতে দিল।
জামিলা বলল, অনেক দিন পর ভালই লাগছে। আচ্ছা কেমন দাম নিয়েছে?
-বেশিনা। চার প্যাকেট মাত্র ৪০ টাকা। মুহাম্মদ স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিল।
মুহাম্মদ কাজ করে প্রতিদিন ৫০ টাকা পায়। সেখানে ৪০ টাকা দিয়েই ৪ প্যাকেট বিরিয়ানি কিনেছে। খরচটা জামিলার কাছে বেশি বলেই মনে হল। কারন অভাবের সংসারে ৪০ টাকা দিয়ে সাংসারিক অনেক কিছুই কেনা যেত। সেদিকে গেল না জামিলা। বরং বলল, তুমি হঠাৎ বিরানি আনলে কেন?
-ভাল লাগলো তাই। নগদ টাকাও পেয়েছি কিছু।
-কয়দিন কাজ হয়েছে।
-৭ দিনই। পুরো এক সপ্তাহ।
-টাকা নগদ দিয়েছে মালিক?
-হ্যা। সব টাকা নগদ দিয়ে দিয়েছে, মালিক বাকি রাখেনি।
তাছাড়া গত বার যে টাকা বাকি ছিল, তাও পরিশোধ করে দিয়েছে মালিক।
-তাহলেতো ভালই হল। জামিলা হেসে বলল।
সকাল সকাল ঘুমানোর আয়োজন করল মুহাম্মদ। যদিও অন্য সময় এত তারাতারি কেউ ঘুমায়না।
মুহাম্মদ বলল, ওরাকি ঘরের চালে আবার ঢিল মেরেছিল।
হ্যা। জামিলা উত্তর দিল।
-প্রতিদিন মেরেছে?
-না, শুধু একদিন মারেনি।
-কোনদিন?
-যেদিন সুমাইয়া আর সুমাইয়ার জামাই ছিল।
মুহাম্মদ কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল, জব্বার আসলেই একটা হারামি। ও মানুষের বাচ্চা বলে মনে হচ্ছেনা।
জামিলা বলল, আমার খুব ভয় করে, আমি এখানে আর থাকতে চাইনা।
জামিলা এমন একটি কথা বলায় মুহাম্মাদের কলিজা যেন কেপে উঠল। মুহাম্মদ বলল, কিন্তু আমিতো অন্য কোথাও থাকার ব্যাবস্থা করতে পারিনি।
-আমি ওসব বুঝিনা, তুমি আমাকে এখান থেকে উদ্ধার কর, যেভাবে পারো।
মুহাম্মদ মনে মনে কিছু একটা আচ করতে পারছিল। বলল, হঠাৎ এত বড় সিদ্ধান্ত নিচ্ছ। অন্য কিছু ঘটেছে নাকি?
-হ্যা
-কি?
-আমাকে ওরা বান মেরেছিল, আমি এখানে কিছুতে থাকতে পারব না।
-কিভাবে জানলে তোমাকে বান মারা হয়েছিল।
-সুমাইয়ার জামাই মুহিব বলেছে।
-ওসব ফাও কথা।
-ফাও কথা না। রান্না ঘরের মেঝে থেকে ১৬ টা তাবিজ বের করেছে মুহিব। সাথে একরাশ ছাই। মুহিব বলেছে ওগুলো চিতায় মানুষ পোড়ানোর ছাই। একগোছা চুলও পেয়েছে রান্না ঘরে।
মুহাম্মদ হঠাৎ ভীষন দুশ্চিন্তায় পরে গেল। কি বলবে কিছু ভেবে পেলনা।
জামিলা বলল, দুইটা বান মেরেছে, একটা পেপে গাছটায় আরেকটা দিঘির পাড়ের কলা গাছে। দুটো বানই কেটে দিয়েছে মুহিব। বান কাটার পর শরীরটা আগের চেয়ে ভাল লাগছে।
মুহাম্মদ সারা রাত ধরে চিন্তায় ঘুমাতে পারল না। আসলে জব্বার খুব রকম লেগেছে । মুহাম্মদের কথায় ও কিছুতে ভরসা করতে পারেনা। ও মনে করেছে, মুহাম্মদ হয়ত তার জমি আজীবন দখল করে রাখবে।
সকাল বেলা অনেক চিন্তার পর একটা সিদ্ধান্তে পৌছালো মুহাম্মদ। স্ত্রীকে ছেলে দুটো সহ বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে। তারপর একটা ব্যাবস্থা করতে পারলে নিয়ে আসবে। ততদিনে ওখানে থাকবে জামিলা। আর মুহাম্মদ প্রতি মাসে টাকা পাঠাবে জামিলার নামে।
জামিলা রাজি হয়ে গেল। আসলে অন্য কোন উপায় না দেখে জামিলাও মনে মনে এটাই আশা করছিল। তানা হলে জব্বার জাদুটোনা করে সবাইকে মেরে ফেলবে। সবচেয়ে বেশি চিন্তা ছেলে দুটোকে নিয়ে, জব্বার কখন কি ক্ষতি করে বসে ওদের, বলা যায় না।
বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছে জামিলা। মোহাম্মদ সব কিছু গুছিয়ে দিচ্ছে। জামাকাপড় ট্রাং বাস্কেট যত আছে, ঠেসে ঠুসে ভরে ফেলছে। ছয়টা মুরগী আছে, উঠোনে উঠনে ক ক শব্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেগুলো বেধে ঝুরির মধ্যে আটকে দিল। হারিপাতিলগুলো একটা বস্তায় পুরলো। এখন বাকি আছে ছাগলের ছানাটা। দুরে দাড়িয়ে ঘাস খাচ্ছে আর ভ্য ভ্য করে ডাকছে। মুহাম্মদ ছাগলের ছানার গলায় দড়ি পরিয়ে গাছের সাথে বেদে রাখল।
দুইটা ছাগল ছিল জামিলাদের। একটা বড় আরেকটা ছোট ছানা। ছোট ছানাটা এখনও আছে। কিন্তু যে ছাগলটা বড় ছিল সেটি চোরে নিয়েছে। জামিলা নিশ্চিত, জব্বারের লোকেরাই ছাগলটা চুরি করে খেয়েছে। জামিলা একটা সংকেতও পেয়েছিল ছাগলটা চুরি হবার কিছুদিন আগে। সংকেতটা হল, জামিলা বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে। ছাগলটা কাছেই ঘাস খাচ্ছিল। জব্বারের এক দুরের সম্পর্কের চাচাতো ভাই আকরাম যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে।
আকরাম ছাগলটাকে দেখেই জামিলাকে বলেছিল, ছাগল বিক্রি করবেন? জামিলা না বলেদিয়েছিল। এই একই প্রশ্ন আরো কয়েকদিন করেছিল আকরাম। কিন্তু জামিলা প্রতিবারই না বলে দিয়েছিল। তার কিছু দিন পরেই ছাগলটা উদাও। এই লক্ষন থেকেই জামিলা নিশ্চিত যে, ছাগলটা জব্বারের লোকেরাই চুরি করেছে, সাথে আকরামও ছিল।
জামিলা ভাবল, সাথে ছোট ছাগল ছানাটা চুরি হলেও ভাল হত। বাপের বাড়ি টেনে নিয়ে যেতে হত না।
সব কিছু গোছানো হলে মুহাম্মদ একটা রিক্সা ভ্যান ভাড়া করে নিয়ে আসল। সব মাল জীনিস ভ্যানে তোলা হল। চলার সময় ধাক্কা লেগে মাল জীনিস জাতে না পরে যায় সে জন্য সব কিছু ভাল করে বেধে দেওয়া হল। ছাগল ছানাটাও ভ্যানে তুলে বাধা হল, শুধু ভ্য ভ্য করে ডাকছে। ভ্যানের উপর কোন মতে ঠাই হল মুরগীর ঝুড়িটার।
দুপুরের পর পরই জামিলা তার দুই ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। হঠাৎ দেখা হল জব্বারের সাথে। মুহাম্মদ নিজেই আগে কথা বলে উঠল, ভাইজান আমরা আপনার বাড়ি ছাইড়া দিলাম, আপনার আর কোন ঝামেলা নেই।
জব্বার বলল, ঘরটা কি করবেন?
-ঘরটা আপাদত এই রকম থাক, পরে একসময় এসে বেচে দেব। বাড়িটা নিয়ে বহু চিন্তায় ছিলেন, আমরা দখল করে রাখি কিনা। এখন আর ভয় নেই আপনার। আপনার কেনা বাড়ি, আমরা দখল করব কিভাবে?
জব্বার কোন কথা বলল না। শুধু চুপ করে ভ্যানটার চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখছে। ভাংগা কাচা রাস্তা দিয়ে হেলে দুলে চলছে ভ্যান গাড়িটা। মুহাম্মদ ভ্যানের পিছনে পিছনে যাচ্ছে। মেইম রাস্তায় এসে ভ্যানটা থামল। মুহাম্মদ বলল, বাপের বাড়ি গিয়ে সানিকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেবা। পারলে মনিরেও স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করবা। আমি প্রতি মাশে মাসে তোমার খরচ পাঠাব, সাথে চিঠি লিখব। তুমিও লিখতে ভুল করোনা। জামিলা মাথা নেড়ে জবাব দিল, আচ্ছা।
ভ্যানের মালিক সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মাথায় বেদে রাখা গামছাটার একটা কোনা ফোত ফোত শব্দে বাতাশে উড়ছে। মুহাম্মদ ভ্যানের মালিককে বলল, তুমি সব কিছু লঞ্চে উঠিয়ে দিয়ে আসবে।
ভ্যান আলা মাথা নাড়ল, আচ্ছা।
মুহাম্মদ পকেট থেকে টাকা বের করে গুনে দেখল। কিছু টাকা নিজের হাতে রেখে, সব জামিলাকে দিয়ে দিল। ভ্যানেরওয়ালাকে দিল ২৫ টাকা। যদিও ভাড়া ২০ টাকার বেশি হয়না। ৫ টাকা বেশি দেওয়ার অবশ্য কারন আছে। এতগুলো বোঝা লঞ্চে তুলতে পারবেনা জামিলা। যাতে ভ্যান ওয়ালা আন্তরিকতার সাথে সব বোঝা নিজেই লঞ্চে তুলে দেয়, সেকারনে ৫ টাকা বেশি দিল মুহাম্মদ। ৫ টাকা বেশি খরচ করে পুরোপুরি চিন্তামুক্ত হতে পারলে খারাপ কিশে। অবশ্য মুহাম্মদ নিজেও লঞ্চঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে পারত, কিন্তু তা করলনা। কারন ভ্যানটিতে আরেকটা মানুষ চড়ার যায়গা নেই। যার কারনে আরেকটা ভ্যান ভাড়া করলে বাড়তি খরচ হয়ে যেত। তাছাড়া ভ্যানওয়ালা বলেছে, যেতে হবেনা, আমি সব কিছু ঠিকঠাক করে দিয়ে আসব।
মুহাম্মদ ভ্যানওয়ালার উপর ভরসা করতে পারে, এই এলাকারই ছেলে ভ্যানওয়ালা। বাড়িও চেনে মুহাম্মদ। সুতারাং দুঃচিন্তা করার কিছুনেই।
বেলা দুইটার বেশি বাজে। মেইন রাস্তার পাশে একটা পুকুর আছে, তাতে সুর্যের আলো তেতে উঠেছে। পানির উপর সূর্যের প্রতিফলিত আলো এসে জামিলার মুখের উপর পরছে। জামিলার মনে আছে যখন এই এলাকায় তারা প্রথম এসেছিল। ১২ বছর আগে। তখন তাদের এক মাত্র সন্তান সুমাইয়া ছিল অনেক ছোট । এই এলাকায় আসার দুই বছর পরে জামিলার প্রথম ছেলে সানি জন্ম নেয়। সানি জন্মানোর ৫ বছর পরেই জন্ম নেয় ছোট ছেলে মনি।
যাইহোক তারা তিনজন এসেছিল, মুহাম্মদ, জামিলা আর তাদের মেয়ে সুমাইয়া। বিদেশ থেকে মুহাম্মদের নামে একটা চিঠি এসেছিল। চিঠিটা পাঠিয়েছিল মুহাম্মদের বড় ভাই জহিরুল।
চিঠিটা যেমন লেখা হয়েছিল,

প্রিয় ছোট ভাই,
আমি জানি তুই বাড়িতে তোর পরিবার নিয়ে ভাল নেই। আমাদের আব্বা আম্মা মারা গেছে। আমাদের বাড়িটা নদী গর্ভে বিলিন হয়েগেছে। এখন তোদের কোন থাকার জায়গা নেই। তুই জেনে খুশি হবি, আমি এর মধ্যে কিছু টাকা জোগাড় করে এক খন্ড জমি কিনে ফেলেছি। আমি চাই, তুই জমিটার উপর একটা ঘর তুলে থাকা শুরু কর। কারন জমিটায় দখলে থাকা দরকার আমাদের। তারপর আমি যখন বিদেশ থেকে আসব, তোর নামে জমির কিছু অংশ লিখে দেব। তুই তাতে ঘর তুলে থাকবি।
ইতি
তোর বড় ভাই জহিরুল।

চিঠির অপর পাতায় ক্রয়কৃত জমির ঠিকানা লেখাছিল।
চিঠিটা পেয়ে সেদিন মুহাম্মদের খুশি দেখে কে! গ্রামের সবাইকে পড়ে শুনাচ্ছিল চিঠিটা। স্ত্রী জামিলাকে বলল, জানো জামিলা, আমার ভাই বিদেশ থেকে এসে আমাদের নামে কিছু জমি লিখে দেবে। আমরা সেখানে ঘর তুলে থাকব। আমি শহরে গিয়ে কাজ করে টাকা কামাই করব। আমাদের আর কষ্ট থাকবেনা।
সেদিনের ধারনা ভূল ছিল মুহাম্মদের। তার ভাই জহিরুল তাকে কোন জমি লিখে দেয়নি। বরং কোন ফাঁকে যেন এসে জব্বারের কাছে বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছে। এখন বুঝতে পারছে মুহাম্মদ, তার বড় ভাই জহিরুল সেদিন চিঠিতে মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিল। আসলে নিজের সার্থেই জমিটায় ঘর বানিয়ে থাকতে বলেছিল জহিরুল, যাতে জমিটা তাদের দখলে থাকে। এখন স্বার্থ ফুরিয়ে গেছে তার। মুহাম্মাদ প্রতিদিন মনে মনে অভিষাপ দিতে থাকে বড় ভাই জহিরুলকে, যখনই মনে পরে।

মুরগীগুলো ঝুড়ির মধ্যে বসে কক কক করছে, ছাগলটা করছে ভ্যা ভ্যা। মুহাম্মদ বলল, ছাগলটা কি করবে?
-বাড়ি নিয়ে পালবো। জামিলা উত্তর দিল।
-আর মুরগীগুলো?
-যে দুইটা বেশি ডিম পারে সে দুইটা রেখে দিয়ে বাকি চারটা বেচে ফেলব।
-বেচার দরকার নেই।
-তাহলে?
-রান্না করে খেও।
-তা দেখা যাবে পরে। জামিলা বলল।
মুহাম্মদ সুর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, সন্ধ্যার আগেই পৌছে যেতে পারবে।
-আমারও তাই মনে হয়। জামিলা বলল।
-লঞ্চ থেকে নেমে কিভাবে বাড়ি ফিরবে?
-লঞ্চ ঘাটেই রিক্সা ভ্যান পাওয়া যায়। তাতেই মাল জিনিস নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারব।
-ও। আমার তা মনেছিল না। আসলে তোমার বাপের বাড়ি অনেকদিন জাওয়া হয়নিতো, সেকারনে ভূলে গেছি।
-আমাদের দেখতে কবে যাবে।
-শহরে একটানা অনেকদিন কাজ করব। তারপর একদিন সময় করে তোমাদের দেখতে যাব। আর যদি ততদিনে কোন ব্যাবস্থা হয়ে যায়, তাহলে তোমাদের নিয়ে আসব।
-আচ্ছা, আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকবো।
মুহাম্মদ বড় ছেলে সানির দিকে তাকাল। একদম বাচ্চা ছেলেদের মত চুপচাপ বসে আছে ভ্যানের উপর।
মুহাম্মাদ সানিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ঠিক মত লেখা পড়া করবে বাবা। লেখা পড়া করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমাদের।
সানি শুধু মাথাটা নেড়ে হা সূচক উত্তর দিল। ছোট ছেলে মনি বসে আছে মায়ের কোলে। মুহাম্মদ বলল, মনির প্রতি একটু বেশি খেয়াল রাখবে। পারলে স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করে দিও।
ভ্যানওয়ালা ছেলেটা বলল, দেরি হয়ে যাচ্ছে কথা তারাতারি শেষ করেন। মুহাম্মদ বলল, আচ্ছা যাও তাহলে।
ভ্যানগাড়ি মেইন রাস্তা ধরে লঞ্চ ঘাটের উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করেছে। মুহাম্মাদ সেদিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে রইল। একপর্যায়ে ভ্যানগাড়িটা রাস্তার একটা বাক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল মুহুর্তে।
মুহাম্মদ ছেলে আর বউকে বিদায় জানিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে যাত্র শুরু করল। একটানা অনেকদিন কাজ করবে। এই এলাকায় আর কোনদিন আসার প্রয়োজন পরবে না তার। শুধু একদিন আসবে ভাংগা চোরা ঘরটি বেচে দেয়ার জন্য। যদিও দাম তেমন একটা পাওয়া যাবেনা। কারন ঘরটা কাঠের তৈরী আর ছাউনি গোলপাতার। ঘুনে ধরেছে অনেক যায়গায়। তারপরেও বেচে যে কয়টাকা পাওয়া যায়, তাই লাভ।
শহরে এক মালিকের কাজ করার কথা আছে মুহাম্মদের, বিল্ডিংয়ের কাজ। এখন আপাদত সেখানেই যাবে সে। যতদিন কাজ হয়, করবে। আর মালিকের বাড়িতেই থাকবে, খাওয়া দাওয়াও ওখানে সারবে। সব কিছু আগে থেকেই চুক্তি করে নিয়েছে মুহাম্মদ। যারা মালিকের বাসায় খাবে, তারা ৫০ টাকা করে মাইনে পাবে। আর যারা খাবেনা, তারা দৈনিক ৬০ টাকা করে পাবে। মুহাম্মদের ইচ্ছা আছে কাজ করে টাকা গোছাবে। তা দিয়ে এক খন্ড জমি কিনবে, ঘর তুলবে। তারপরে গিয়ে বউ ছেলে মেয়েকে শশুর বাড়ি থেকে নিয়ে আসবে। বউ ছেলেমেয়েকে শশুর বাড়ী রাখার ঘোর বিরোদী ছিল মুহাম্মদ। কিন্তু বাধ্য হয়ে সেই কাজটিই করতে হল তাকে। (চলবে…..)

৫৯৫জন ৫৯৫জন
0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ