জীবন অবসরের কাহিনী একঃ
রফিক সাহেবের দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অবসরে এসে, আজ সময়টা যেনো তার কাটতেই চায় না। আজ নিঃসঙ্গতা তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। কিছু সময়ের জন্য বাইরের কোলাহল থেকে ঘুরে ঘরে ফেরার সাথে সাথে কেমন এক নিস্তব্ধতা তাকে ঘিরে ধরেছে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে যেনে দীর্ঘ এক সময় আজ তার কাছে। চারপাশে কাজের কোনো তাড়া নেই। রুমের কোণায় টেবিলের উপর পড়ে আছে অফিস থেকে দেওয়া অবসরের সাথী একটা জায়নামাজ, একটা টুপি, একটা কোরআন শরীফ, একটা তসবিহ্। এখন জীবনের গণ্ডিটা যেনো তারাই ঠিক করে দিয়েছে। অথচ কর্মব্যস্ত জীবনে অফিসে তার কাজের যেনো কোনো গণ্ডিই ছিলো না, এ ফাইল সে ফাইল, নতুন নতুন প্রোজেক্ট, কতশতো প্রিয় মুখ!
বুকের ভিতর একদলা শক্ত নিঃশ্বাস আটকে গেলো রফিক সাহেবের।
পশ্চিম দিকের জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। আস্তে আস্তে পর্দাটা খুলে তাকান পশ্চিমা কাশের দিকে। এখন সূর্যাস্তের সময়। ততক্ষণে আকাশে সন্ধ্যা তারাটা স্পষ্ট হয়েছে। দিনের শেষ এবং রাতের আগমনের মুহূর্তটি একটি ক্রান্তি লগ্ন। দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে সূর্যের আলো মিলিয়ে যায় ধীরে ধীরে। পশ্চিমাকাশ রক্তিম আখরে রাঙিয়ে দিয়ে সূর্য চলে যায় আরেক দিগন্তে। সেখানে সূর্যের আলোর অপেক্ষা। এখানে তাই ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যার আলো-আঁধারি। সময়টি নিঃসন্দেহে অসাধারণ। কিন্তু এখানে এই অস্ত পারের তীরে তার দীর্ঘশ্বাসকে পাঠিয়ে দেন অঞ্জলি হিসেবে প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর উদ্দেশ্যে। রিয়াকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলো রফিক সাহেব। অল্পকিছু মান অভিমান ছাড়া সুখ- শান্তির প্রকৃত রূপ ছটা বলতে যা বোঝায় তার সবটুকুই ছিলো তাদের ঘরে। আজ সে সব কতো স্মৃতি মনে পড়ছে।
আজ তার অফুরন্ত সময় কিন্তু তা উপভোগ করা বা ভাগ করে নেবার জন্য রিয়া পাশে নেই। অথচ, একসময় একটুকু সময় পাওয়ার জন্য রিয়া ছটফট করতো কতো! অফিসে কাজের চাপে তাকে একমুহূর্ত সময় বের করে ফোনটাও করা হয়ে ওঠেনি। রাতে কোনোরকম ক্লান্ত শরীরটাকে বাসায় বয়ে এনে দেখেছে, রিয়া অনেক অভিমান বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে ছোটো শিশুর মতো। চোখের কোনায় পানি জমে আছে তখনও। হয়তো খালিপেটেই ঘুমিয়ে গেছে। সে পরিশ্রম করে গেছে, তার প্রজন্মের জন্য। একটি কথা আছে,”Industry is the mother of goodluck.”
“Man is the architect of his fortune.”
আসলে অসাধারণ সম্পদের জন্য অসাধারণ শ্রমের প্রয়োজন। শ্রমই ব্যক্তিকে দিতে পারে ঐশ্বর্য, আর জাতিকে দিতে পারে সমৃদ্ধি। তাই সে পরিশ্রম করে গেছে তার পরিবার পরি জনের জন্য, সমাজ ও দেশের জন্য। এদিকে তাই বাড়িতে বহু অনুষ্ঠান গেছে তাকে ছাড়াই। আজ তার প্রচুর সময়, কিন্তু তাকে ডাকার মতো অবসর কারো নেই। সন্তানরা তারা তাদের জগতে ব্যাস্ত। একসময় তার যেমনটা ছিলো। এর নাম জীবন চক্র। আজ তার জন্য অপেক্ষা করে আছে, টেবিলের উপর রাখা অফিস থেকে দেওয়া অবসরের গিফট। এ যেনো জীবন গন্ডির বাউন্ডারি।
‘দুর্বার তরঙ্গ এক বয়ে গেলো তীব্রবেগে
বলে গেলো: আমি আছি যে মুহূর্তে আমি গতিমান,
যখনই হারাই গতি, সে মুহূর্তে আমি নাই।’
নাহ! এ উপহারে তার আক্ষেপ নেই। বা, অনুযোগ অভিযোগ কিছুই না। জায়নামাজ, টুপি, কোরআন শরিফ তার বাড়িতেই আছে। কাজের চাপে পাঁচ-ওয়াক্ত নামাজ পড়তে না পারলেও নামাজটা সে ঠিকই পড়ে নিতো। আজ এসব দেখে মনে হচ্ছে, অফিস যেনো তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলো,”এখন তোমার আর কোনো কাজ নেই, সারাদিন নামাজ রোযা করেই তোমার জীবনের বাকি সময়টা পার করা উচিৎ!” অপেক্ষা মৃত্যুর জন্য এবং মৃত্যুর পরে তুমি যেনো ওপারে ভাল থাকো তাই এই ব্যাবস্থা আমরা করে দিয়েছি, যা দিয়ে তুমি পূণ্য করতে পারো। কারণ, পূণ্যতেই ওপারে মুক্তি মিলবে।”
আজ তার প্রশ্ন, কর্মে কি পূণ্য মিলে না?
জীবন অবসরের কাহিনী দুইঃ
আজ দিনারা আর দিপুর বিয়ের পঞ্চাশ বছর। কতো দীর্ঘ সময় একসাথে পথ চলা। জীবনের শাখা প্রশাখাগুলো আজ আনন্দে মেতেছে। চোখে মুখে সবার বিস্ময়ও কম নয়, এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে ফেলল এ দম্পত্তি। ভালবাসা সৌখিনতায় ভরপুর দুজন মানুষ। দুজনেই স্বশিক্ষায় শিক্ষিত। দিনারা পেশায় স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন। টিপটপ এক সংসার জীবন পার করেছে দুজনেই। সন্তানদের মানুষ করা, স্কুল সব মিলায়ে সে এক ব্যাস্ত জীবন ছিলো দিনারার। কিন্তু এখন দিনের বেশিরভাগ সময় একা এক চেয়ারে কেটে যায় দিনারার সময়। জীবনের শাখা প্রশাখাগুলো তার সবাই ব্যাস্ত। তার স্বামী সমাজের নানাকাজে ব্যাস্ত সময় পার করে ফেলে। অবসর শব্দটা তাই দিনারার জন্যই। আজ তাদের এ জীবন ক্ষণের সুন্দর মুহূর্তে প্রায় পাঁচশো মানুষের পদচারনায় গমগম করছে চারপাশ।
সে এক জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন ছিলো তার নাতির পক্ষ থেকে। চোখেমুখে দুজনের এক তৃপ্তির আলো জলজল করছে। জীবনের উত্থান পতন গুলো একসাথে পার করে এসেছে তারা। সবার হাতে কমবেশি উপহার। তবে বেশিরভাগ অতিথির হাতে হাদিসের বই। তাদেরও বোঝানো হচ্ছে, “অনেক হয়েছে এবার হাদিস পড়ো!”
তবে নিতু চমৎকার একটা শাড়ি কিনেছে দিনারার জন্য। শাড়িটা নিতুরই পছন্দ করে কেনা। নিতু হঠাৎ হঠাৎ যখন দিনারাদের বাড়িতে যায়, দেখে দিনারা চুপচাপ বসে আছে বারান্দার চেয়ারটাতে একা, একেবারে একা। হয়তো চোখের পাতায় তার হাজার স্মৃতি। মুখে সব সময় এক মিষ্টি হাসি। কখনো কখনো আমি ভাবি, দৃশ্যটা যদি এমন হতো, দিনারা বসে আছে, মৃদু সুরে দিনারার পছন্দের গান বাজছে ক্যাসেট প্লেয়ারে। হয়তো একসময় জীবনের মহা কর্মব্যস্ততায় প্রিয় গানগুলো মনের মতো করে শোনা হয়নি। হয়তো কি! আসলেই যে হয় না। নিতুরই বা হয় কোথায়! ওর তো কোনো চাকরি নেই, আছে সংসার নামক এক দায়িত্ব। সেখানে হাজারো কৈফিয়ত। সবার মন যোগায়ে চলা।
দিপুর নিজস্ব লাইব্রেরীতেই আছে প্রচুর বই। সারাজীবনের সৌখিন মানুষ একটা বড় লাইব্রেরী তার শৌখিনতার আভিজাত্যের প্রকাশ। এখানে আমি রুচির আভিজাত্য বলতে চেয়েছি।
কিছু কথা তবুঃ জীবন সায়ন্হে একজন মানুষকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে তার বার্ধক্য বুঝিয়ে দেবার মতো নিষ্ঠুরতা আর কিছু কি আছে, তা আমার জানা নেই। যে সারাজীবন কর্ম করে এসছে সে জানে তার জীবনের শেষ সময়টুকু কখন। শরীর তার কখন ছেড়ে দিবে। মস্তিষ্ক নামক কারিগর যতক্ষণ তার সাথে সুস্থ অবস্থায় থাকবে ততোক্ষণ সে কর্মক্ষম। তার আগে কেউ তাকে একা করে রাখতে পারে না। অধিকাংশ মানুষ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন। তার দীর্ঘ কর্মজীবনের বুদ্ধির চর্চা ও জীবন অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন প্রজন্মের চলার পথকে সহজ করে দেবার কাজটা করা উচিৎ নতুন প্রজন্মেরই। অবসরের উপহার এমন হোক যে তা দেখে সে মানুষটি নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরনা পায়। অধীকাংশ মানুষই চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর বিষন্নতার কারনে মানষিক ও শারীরিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়ে। বয়সের বার্ধক্যে আসার আগেই সে নুয়ে পড়ে। নতুন আলোর এক পথের আলোর দিশারি হোক এসব মানুষ। তাদের জীবন গোধুলিলগ্নে অস্তমান সূর্যের সোনালী আলোয় তাদের হাত ধরে পৃথিবী চলুক এক নতুন উদ্যমে।
তার অবসর নিতুর ভাবনাঃ প্রচন্ড চুপচাপ অফিসপাগল এক মানুষ নিতুর বর। যাকে বলে মেপে মেপে কথা বলার মতো। হয়তো সে নিজেই হিসেব করে রাখে আজ সে ঠিক কতোটুকু কথা বলবে। এটা নিয়ে নিতুর জীবনে আক্ষেপের শেষ নেই। এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। চাওয়া পাওয়া আবেগপূর্ণ সে সব দিনের সমাপ্তি ঘটেছে বহু আগে।যাইহোক, নিতু ঠিক করেছে একটা চমৎকার স্কুল হবে নিতুর। একটু অন্যরকম। যেখানে গতানুগতিক পড়াশুনার কিছুই থাকবে না। তার অবসরের পরে দুজনে মিলে বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলটি পরিচালনা করবে। সেখানে থাকবে একটা বড় লাইব্রেরী, ড্রয়িংএর যাবতীয় জিনিসপত্র, একটা টেলিস্কোপ। একটা বাচ্চার কি পাওয়া উচিৎ, সে কি পেতে পারে তা তাকে শেখানো হবে এ স্কুলে। স্বপ্ন দেখানো, সে স্বপ্নকে যত্ন করতে শেখানো হবে স্কুলটির কাজ। কারণ জীবনের চাকা চলতে অবলম্বন প্রয়োজন। আর এ স্কুলটিই হবে নিতুর অবসরের সাথী। কারন, কর্মময় মানুষের কর্মেই জীবনের চাকা চলে স্থিতি আসলেই মৃত্যু।
,,,,,,,,,,,,রিতু,,,,,,,,,,,,
১৭/০৫/১৮.
১২টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
ভালো একটি বিষয় নিয়ে লিখেছ।
অবসরের সময় উপহারগুলো অন্য রকমও হতে পারে। প্রচলিত উপহার দিয়ে তাঁকে আসলে পংগু করেই রাখা হয়। যিনি অবসরে যাচ্ছেন তিনি যে বিষয়ে অভিজ্ঞ, তাঁকে সে বিষয়ের একটি প্রতীকী উপহার দেয়া যেতে পারে।
আমাদের দেশে অবসরে যাবার পরেই মানুষের জীবন বলতে গেলে জড় হয়ে যায়, স্থির হয়ে যায় তার চিন্তা ভাবনা, জীবন থেমে যায়।
তোমার লেখার বিষয় বস্তুর বৈচিত্র আসলেই মুগ্ধ করার মত। ধন্যবাদ এমন লেখার জন্য।
শুভ কামনা।
মৌনতা রিতু
সত্যি ভাইয়া এটাই করা উচিৎ। আসলে আমাদের ভাবনা চিন্তার মধ্যে পার্থক্য অনেক। আমরা একটা যায়গাতে এসে আটকে থাকি।
পরিবর্তন তবু হয়েছে অনেক। আরো হবে এই আশা।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
রিমি রুম্মান
অবসরে যাবার পর মূলত মানুষের শরীর মন দুটোই ভেঙ্গে যায়।খুব কাছ থেকে নিজের পরিবারের একজনকে দেখেছি। উচ্ছল, উদ্দাম, প্রানবন্ত মানুষটি ক্যমন ভিন্ন এক মানুষ হয়ে গেল। দ্রুতই যেন বুড়িয়ে গেল। ভাল একটি বিষয় তুলে আনা হয়েছে লেখাটিতে …
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ রিমি আপু। ভাল থেকো সব সময়।
এটা আসলে বাস্তব উপলব্দি থেকে লেখা
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
জীবনের এ সময়টা কারো সুখের কারো বা অনেক কষ্টের।লেখাটা চমৎকার হয়েছে।
মৌনতা রিতু
আসলেই মনির ভাই, পরিবারের মানুষ অপেক্ষা করে থাকে এবার তাদের একটা বড় কোনো ব্যাবস্থা হবে। তাদের একটা বাড়ি অথবা সন্তানদের কর্মসস্থান। নতুন কোনো মানুষের সে স্থানটিতে আসার সুযোগ হয়।
তবে যে লোকটি অবসরে যায় সে জানে তার মনের কি অবস্থা হয়।
ধন্যবাদ মনির ভাই। ভালো থাকবেন।
খসড়া
অবসর মানেই অর্থহীন। অবসরে যাবার সময় নতুন কাজ নিতে হবে য়া না হলে মৃতবৎ জীবন খুব কষ্টের হয়। কাহীনীর নতুনত্ব ভাল লাগলো
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ। ভাল থেকো তুমি সব সময়। দোয়া করিও আমার জন্য। (3 -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
শান্তসুন্দরী আপু দারুণ লিখেছো। একজন কর্মব্যস্ত মানুষের জীবন হঠাৎ করে থেমে গেলে কেমন হয়, সে আমি জানি।
আর একটা বয়সের পর যখন কর্মহীন জীবন যাপন করে মানুষ, তখন সকলেই এমনভাবে বয়সকে বাড়িয়ে দেয়, যেনো এইবারে সকলকিছুই থামিয়ে দেয়ার সময় হয়েছে।
চমৎকার!
দিন কে দিন তোমার লেখা আলো ছড়াচ্ছে আপু। -{@
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ নীলনদ। ভাল থেকো নীলাআপু। আমি কোনো চাকরি করি না, তবু উপলব্দি করতে পারি। তবে মানুষ যখন গিফট হিসেবে এসব জিনিস দেয় তখন বিরক্ত বোধ করি। -{@ (3
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু একজন লেখক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতে পারে। তুমি তো এখন একজন লেখক।
লিখে চলো। কেমন? -{@
মৌনতা রিতু
ভালবাসা নিও আপু। তোমার মন্তব্যে আমি সব সময় আবেগ আপ্লুত হই।