শ্রুতিকল্প-প্রথমে সংজ্ঞা দেওয়া যাক। অনুপ্রাস, অন্ত্যমিল, মধ্যমিল, পর পর শব্দের অর্ন্তগত স্বরবর্ণের মিল ধ্বনি-ব্যঞ্জনার জন্য অন্য যা কিছু সম্ভব, যেমন ধ্বনিস্পন্দ, তা গদ্যের থেকে ধার করা হোক, কথ্য ভাষা থেকে আহরিত হোক, সংলাপ থেকে স্পন্দিত হোক-এসব মিলেই শ্রুতিমাণে ধ্বনির মূর্ত-বিমূর্ত রূপ, এই হচ্ছে শ্রুতিকল্প। তাই চিত্রকল্প, যা চিত্রে কল্পনা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম; তেমনি যা কিছু ধ্বনিরূপের বৈচিত্র্য, ব্যাপকতা, গভীরতা সৃষ্টি করতে সক্ষম তাই শ্রুতিকল্প। চিত্রকল্প যেমন শুধু রূপক থেকে গভীরতর, মহত্তর, বৃহত্তর ব্যঞ্জনার অধিকারী, তেমনি শ্রুতিকল্প নেহাৎ অন্ত্যমিলের অধিক; বিষয় ও কল্পনাকে ধ্বনিবাহিত করে শ্রেষ্ঠ অনুষঙ্গ যাতে কবিতার আরাধ্য গভীরতরভাবে পাঠকের বোধির সঙ্গে মিশতে পারে, মিলতে পারে, অবলোকিত হতে পারে। এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য: জীবনানন্দের কবিতার ধ্বনি-বিচিত্রতার, শ্রুতিকল্পের অনুসন্ধান, অবলোকন, শ্রবণ এবং অবশেষে সকল কবিতাপ্রেমীর সঙ্গে অর্ন্তদীপ্ত হয়ে ওঠা:
লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার,
এই ধূলি,-ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার
ডুবে যায় নীলিমায়,-স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে,
-শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে, শুক্লাকাশে, নক্ষত্রের রাতে;
ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক,
তোমার চকিতস্পর্শে হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!
[নীলিমা (ঝরা পালক)]
কল্লোল, ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬-এ প্রকাশিত এই কবিতা, যা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে মুগ্ধ করেছিলো; আজ কি মনে হয় জীবনানন্দের কলম থেকে বেরিয়েছিলো? তৎসম যুগ্মধ্বনিতে আন্দোলিত, বিষয়ে প্রায় মালার্মের নীলিমার রাবীন্দ্রিক বঙ্গজ সংস্করণের মতো, এ কবিতা কি বরং সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কৈশোরিক তন্বীর অর্ন্তগত হওয়াই সঙ্গততর মনে হয় না? কিন্তু অক্ষরবৃত্তের এ ধ্বনি উচ্চাবচতার এক প্রান্ত থেকে একই ছন্দের সম্পূর্ণ বিপরীত প্রান্তের বিলম্বিত, অতিবিলম্বিত ধ্বনির অনুচ্চ সমতলে ঘুরে গেলেন জীবনানন্দ ঝরা পালক (১৯২৭)-এর ৯ বছর পর ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬)-এর কবিতাবলিতে। সুরের প্রগাঢ়তা তো শূন্যের থেকে আসে না। জাতীয় গ্রন্থাগারে রক্ষিত ৪০টি খাতার খণ্ডিত কোনো অংশে এই শ্রুতির সাধনার ইতিহাস নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে। এ পরিশ্রমের কথা অবশ্য জীবনানন্দ ধূসর পাণ্ডুলিপি’র ভূমিকায় তাঁর স্বাভাবিক মৃদুকণ্ঠের ইশারায় জানিয়ে গেছেন। এগারো বছরের নিভৃত কল্পনা-প্রতিভার পরিশ্রমের পর জীবনানন্দের স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর স্পষ্ট করে শোনা গেলো ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬)-এর সতেরটি কবিতায়। এ পরিণত কণ্ঠস্বরের অস্ফুট আওয়াজ অবশ্য নজরুল-মোহিতলাল রূপধ্বনি অনুসৃত কৈশোরিক এবং ঝংকারপ্রধান ঝরা পালক’ও একেবারে দুর্নিরীক্ষ্য নয়; যেমন:
সাপিনীর মত বাঁকা আঙুলে ফুটেছে তার কঙ্কালের রূপ,
ভেঙেছে নাকের ডাঁশা,-হিম স্তন,-হিম রোমকূপ!
[ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল (ঝরা পালক)]
উদ্ধৃত ক’লাইনেই জীবনানন্দের কবিতাধ্বনির মূলসূত্র নিবদ্ধ রয়েছে: লম্বা লয়, ড্যাশ, শান্ত দু মাত্রার অন্ত্যমিল, ঝংকারহীনতা, ধ্বনি-অধ্বনির প্রলম্বিত বুনোট।
(…………………………………………………………………….চলবে)
২০টি মন্তব্য
ব্লগার সজীব
আপনি সম্ভবত এই লেখার কথাই আগাম ঘোষনা দিয়েছিলেন। প্রতিটি পর্ব অবশ্যই পড়বো দাদা। শ্রুতিকল্পের বিশ্লেষন ভালো লেগেছে। আসলে বিশ্লেষন মুলক লেখা কম পাওয়া যায়। ধন্যবাদ আপনাকে।
সাতকাহন
ধন্যবাদ সজীব।
হৃদয়ের স্পন্দন
অপেক্ষায় রইলাম পরের পর্বের
সাতকাহন
ধন্যবাদ স্পন্দন
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
অপেক্ষা -{@
সাতকাহন
ধন্যবাদ মনির।
অরণ্য
প্রথমতঃ অপেক্ষায় থাকব। আগ্রহ পাচ্ছি জানবার।
দ্বিতীয়তঃ নিজস্ব মতামত, লেখাটিতে সরল বাক্যের আধিক্য যদি বাড়ানো যেত! যদিও আমার এ চাওয়া আমার ইংরেজী ব্যাকরণের Simple, Complex and Compound Sentence -এর জ্ঞানকে ভর করে। আমার মত দূর্বল পাঠকরা সরল বাক্যকে মাথায় নিতে পারে তাড়াতাড়ি। এ বয়সে নিজের RAM বাড়ানোর সুযোগ খুবই কম মনে হচ্ছে।
তৃতীয়তঃ আমার দ্বিতীয় মন্তব্য আপনি ঝেড়ে ফেলতে পারেন আপনার লেখার স্বকীয়তার স্বার্থে। ধন্যবাদ আপনাকে।
সাতকাহন
ধন্যবাদ আপনার মতামতের জন্য। তবে শ্রুতিকল্প নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এর থেকে সহজ ভাষায় বলাটা আমার পক্ষে সম্ভব না। আর এটা একটি থিসিসের ভূমিকাংশ। আর গবেষণামূলক কাজ যেহেতু সেহেতু একটু কাঠখোট্টা হবেই। এটাই স্বাভাবিক।
শুন্য শুন্যালয়
বাংলা আর বাংলা কবিতা এতো কঠিন কেনো?
আমি কিছু বুঝিনাই। 🙁
সাতকাহন
নিজের ভিতরে নিয়ে নিন, বুঝতে কষ্ট হবে না।
শিশির কনা
কবিতার বিশ্লেষন ! লেখাটিতে থিসিসের ছায়া (y)
সাতকাহন
ঠিক ধরেছেন শিশির কনা, এটা থিসিসেরই একটি অংশ।
খেয়ালী মেয়ে
অনেক কঠিন-
সাতকাহন
নিজের ভিতরে নিয়ে নিন, দেখবেন সহজ হয়ে গেছে।
সাইদ মিলটন
চলুক
বিশ্লেষন ভালো লাগছে কাঠখোট্টা না 🙂
সাতকাহন
ধন্যবাদ, সাইদ মিলটন।
সোনিয়া হক
বিশ্লেষন ভালো লেগেছে ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ সোনিয়া হক।
জিসান শা ইকরাম
শ্রুতি কল্প শিখলাম।
এই লেখার প্রতি আগ্রহ ছিলো আগাম ঘোষনার দিন থেকেই।
ধন্যবাদ দাদা।
মনোযোগ থাকবে এই লেখার প্রতি।
সাতকাহন
আর লজ্জ্বা দিবেন না জিসান ভাই। আপনারা আছেন বলেই লিখতে আনন্দ পাই।