চলে গেছে বন্ধু আমার

রিমি রুম্মান ১৮ জুলাই ২০২১, রবিবার, ০৯:৫৫:২৬পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৭ মন্তব্য

১৭ই মে ভোরের দিকে মুঠোফোনে মেসেজ এলো। ঘুম ঘুম চোখে হাতড়ে খুঁজে নিলাম ফোন। জরুরি বার্তা কিনা আধো খোলা চোখে দেখে নিলাম। নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষের ক্ষুদে বার্তা। মনে করিয়ে দিল, 24-hours subway service resumes today, May 17 in New York City.ছোট্ট একটি লাইন মন ভাল করে দিলো। দীর্ঘ এক বছরেরও অধিক সময় পর নিউইয়র্ক নগরির ট্রেন চলাচল আগের স্বাভাবিক নিয়মে চলবে। মহামারীর সংক্রমণ আশানুরূপ কমে আসায় ১৭ই মে থেকে প্রায় সবকিছুই খুলে দেয়া হয়েছে। মানুষজন আগের মতো আবারও রেস্তোরাঁয় বসে খাবে, গল্প করবে। চায়ের কাপে তুমুল ঝড় বইয়ে দিবে। হা হা হো হো শব্দে হেসে উঠবে। ব্যস্ত হয়ে উঠবে আলো ঝলমলে টাইমস স্কয়ার। মানুষের কর্মব্যস্ততা বাড়বে। এমন সুখস্বপ্নের মাঝে আবারো ঘুমিয়ে গেলাম। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেও টুপ করে আবারও ক্ষুদে বার্তা আসার আওয়াজ। চোখ খুলে দেখতে ইচ্ছে হল না। ঘুমিয়ে রইলাম। উঠলাম বেশ বেলা করে। ততক্ষণে বাইরে ঝকঝকে রোদ। মুঠোফোন হাতে নিতেই বন্ধু হুমায়ুনের ক্ষুদে বার্তায় চোখ আটকে রইল। মুক্তা আর নেই! মাথার উপরে সিলিং ফ্যান ঘুরছিল। মনে হচ্ছিল সমস্ত পৃথিবীটা তীব্র এক ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুরে উঠলো যেন!

মুক্তা আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। আমরা শাদা সেলোয়ার, নীল কামিজের উপরে শাদা ভাঁজ করা ওড়না পরে, চুলে দুই বেণী দুলিয়ে স্কুলে যেতাম রোজ। আমরা টিফিন ঘণ্টা বেজে উঠলে টিফিন নিয়ে কাড়াকাড়ি করতাম। গেটের বাইরে কানু’দার আচার খেতাম। ক্লাসের দরজার চিপায় কাঁচা আম ভেঙে ভাগাভাগি করে লবন-মরিচ দিয়ে খেতাম। এস এস সি পাশ করার পর আমাদের কলেজ ভিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু যোগাযোগ থেমে থাকেনি। সময় সুযোগ পেলে আমরা পরস্পরের বাসায় গিয়ে সময় কাটাতাম। গল্প করতাম। না-দেখা হওয়া সময়ের জমানো গল্প। আমাদের বাবারা বন্ধু হওয়ায় পারিবারিকভাবে আসা-যাওয়ার বিষয়টি চলমান থাকে। কলেজে পড়াকালীন সময়ে মুক্তার বিয়ে হয়ে গেল। আমার দাদার বাড়ির পাশেই শ্বশুর বাড়ি তাঁর। আমি বরপক্ষ না কনেপক্ষ ধন্দে পড়ে যেতাম। দুইবন্ধু মিলে এ নিয়ে ঠাট্টা মশকারা করতাম। মুক্তা ব্যস্ত হয়ে উঠে সংসার, সন্তান নিয়ে। আমি ব্যস্ত ঢাকায়, ইডেন কলেজে পড়াশোনা নিয়ে। ইদের, পুজার ছুটিতে আমি ছুটে যেতাম আমার মফঃস্বল শহর চাঁদপুরে। সে ছুটে আসতো স্বামীর কর্মস্থলের শহর থেকে বাবার বাড়িতে। আমাদের আবার দেখা হতো। গল্প হতো সুখের, দুঃখের। আমাদের না-বলা কোনো গল্প বাকির খাতায় পড়ে থাকত না। একদিন বিয়ে হয়ে গেল আমারও। স্বামীর সঙ্গে পাড়ি জমালাম আমেরিকার উদ্দেশ্যে। পেছনে পড়ে রইল আমার পরিবার, স্বজন, এবং বন্ধুরা। পড়ে রইল শৈশব-কৈশোরের সোনালি দিন। পড়ে রইল মুক্তা আর আমার সুখদুঃখের গল্পরা।

যখনই দেশে গিয়েছি, ছুটে গিয়েছি মুক্তার সাজানো সংসারে। স্বামী, দুইপুত্রকে নিয়ে বড় পরিপাটি, গোছানো সংসার। জগত সংসার নিয়ে কোনো অভিযোগ অনুযোগ ছিল না তাঁর। যত্ন করে কতো কী খেতে দিতো! ভালোবাসতো উজাড় করে। গভীর দুটি চোখে তাকিয়ে জানাত, ওর ছোটবোন আমেরিকায় থাকে। ভাইবোনদের সেখানে নিয়ে যাবার জন্যে আবেদন করেছে। হিসেব করতো, এদেশে আসতে আর কতদিন সময় লাগবে। অদ্ভুত মায়াময় চোখদুটিতে উপচে পড়া স্বপ্ন ছিল। সন্তানদের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন। আর সেই চোখের দিকে তাকিয়ে আমি সকলের অদেখার মাঝে টুপ করে স্বপ্ন দেখে নিতাম, আমরা দুই বন্ধু নিউইয়র্ক শহরে এক হবো। পাতাল ট্রেনের ঘটঘট আওয়াজের মাঝে নিজেদের সুখদুঃখের গল্প করতে করতে পৌঁছে যাবো কোলাহলমুখর ম্যানহাটনের রাস্তায়। ক্লান্ত হলে জিরিয়ে নিতে কোনো এক কফিশপের কোণের দিকের টেবিলে মুখোমুখি বসবো। ধোঁয়া উঠা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে স্বচ্ছ কাঁচের ওপাশের প্রশস্ত সড়কে ছুটে চলা হলুদ ক্যাবগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠবো, ‘ শেষ পর্যন্ত আমরা আবার এক হলাম এই বিদেশ বিভূঁইয়ে!

২০১৮ সালে শেষবার দেশে গিয়েছিলাম পারিবারিক উৎসব উপলক্ষে। তুমুল ব্যস্ততায় সময় ফুরিয়ে আসে। ফিরবার দিন ঘনায়। ভেবেছিলাম সেইবার বুঝি আর দেখা হবে না আমাদের। সেদিন ছিল ইদ-উল-আযহা। রাতে ফ্লাইট। লাগেজ গোছগাছ করছি। দুপুরের দিকে মুক্তা ফোন করে দেখা করার আকুতি জানায়। আমারও দেখা না করে নিউইয়র্ক ফিরে আসতে মন সায় দিচ্ছিল না। ওঁর বসুন্ধরার বাড়িতে যাই। অনেকদিন বাদে আমাদের দেখা হয়। এই যে পৃথিবীর দুই প্রান্তে আমাদের বসবাস, সাংসারিক ব্যস্ততায় যোগাযোগ হয়ে উঠেনা, তবুও মনে হলো আমরা কেউ কখনো শারীরিকভাবে দূরে ছিলাম না। যেন আজন্ম আত্মায় আত্মায় মিশে ছিলাম। যেন প্রতিদিনই আমাদের দেখা হয়েছে! অল্প সময়ে খলবলিয়ে কত কথা বললাম সেদিন! যত্ন করে ইদের দিনের নিজহাতে রান্না করা খাবার খাওয়ালো। ফিরে আসার সময় সে গেট অব্দি এগিয়ে দিলো। দাঁড়িয়ে রইল। আমি গেটের বাইরে অপেক্ষমাণ গাড়িতে চেপে বসলাম। একবারও পিছু ফিরে তাকালাম না। যে কোনো বিদায়ে পিছু ফিরে চাইতে নেই। এতে কষ্ট বাড়ে। হাহাকার বাড়ে। মায়া বাড়ে। কী লাভ মায়া বাড়িয়ে! কে জানতো, সে-ই ছিল আমাদের শেষ দেখা!

আমার প্রাণের শহর নিউইয়র্ক যখন করোনা মহামারিকে জয় করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে, সারা পৃথিবী যখন ছন্দে ফেরার পথে, ঠিক সেই সময়ে আমার বন্ধু করোনা নামক ক্ষুদ্র অণুজীবের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গেল! ১৭ দিন আই সি ইউ তে যমে মানুষে লড়াই চলল। আমরা দেশের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বন্ধুরা কেউ জানলাম না। শুনেছি একটু একটু করে সেরেও উঠছিল সে। তবে কীভাবে কী হলো? আমার ডাক্তার বন্ধু তাসলিমা জানালো, ‘ পোস্ট কোভিড কমপ্লিকেশন’। ১৭ই মে মুক্তা আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেল। সেদিন নিউইয়র্ক নগরির আকাশে ঝকঝকে রোদ ছিল। গাঢ় নীল আকাশে খণ্ড খণ্ড শাদা মেঘ ভেসে যাচ্ছিল উত্তর থেকে দক্ষিণে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বিশাল ওই আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, নীল জামা, শাদা সেলোয়ার আর শাদা ভাঁজ করা ওড়না পরে দুই বেণী দুলিয়ে মুক্তা ছুটে চলেছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। আমি তাঁকে ছুঁয়ে দিতে চাইছি প্রাণপণে। কিছুতেই পারছিনা। ছুঁতে গেলেই শাদা মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে।

মুক্তা, কেমন আছিস রে আকাশের ওপারে? শেষ পর্যন্ত আমরা আর এই নিউইয়র্ক শহরে এক হতে পারলাম কই? আমার দেশে ফেরার অনুষঙ্গগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে যে! দেশে গেলে হাজারো মানুষের ভিড়ে আমার বড় একলা লাগবে রে! খুব একলা লাগবে। প্রতি বছর ইদ-উল-আযহা এলে আমাদের শেষ দেখা হওয়ার দিনটি খুব মনে পড়বে। নিরন্তর খুঁজে ফিরবো তোকে। না-বলা বাকি কথাগুলো জমে থাকবে অসহায়ভাবে। বলতে না পারার বেদনায় বুক ভার হয়ে থাকবে। দম বন্ধ হয়ে আসবে। তবু তোকে কোথাও খুঁজে পাবো না!

রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

৫৯০জন ৫২৬জন
0 Shares

৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ