তুতুল আর কাজরী এখনো ফেরেনি। হয়তো ফিরবে না। আজকাল তুতুল বাপের বাড়িতে থাকতে বেশি পছন্দ করে অথচ রায়হানের এখন সবচেয়ে বেশি তাকে প্রয়োজন। জুলেখার কানে অনেক কথাই আসে তুতুল সম্পর্কে তিনি অনেকবার ভেবেছেন কিছু জিজ্ঞেস করবেন।তারপর কি জানি কি ভেবে আর জিজ্ঞেস করা হয় নি।
রায়হানের বাবা এখনো সম্ভবত এসব ব্যাপারে কিছু জানেন না বা শোনেন নি। পুরুষ মানুষ অত শত বোঝেনও না, তবে জানতে পারলে ভীষণ আঘাত পাবেন।
এ ক’মাসে তার উপর দিয়ে অকল্পনীয় ঝড় ঝঞ্ঝা গেছে তার উপর জবার জ্বালাতন। না আজকাল মনে হয় এসব দেখার চাইতে মরে যাওয়া অনেক ভালো ছিলো। অন্তত এতো কষ্ট পেতে হতো না।।
(৬)
রাকিব সাহেবের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে তিনি প্রচন্ড রেগে আছেন। এর কারণ আছে অবশ্য,আজকাল তিনি জবা আর জবার স্বামীকে সহ্যই করতে পারেন না। মেয়েটা দিনে দিনে এত লোভী হয়ে উঠছে কি কারণে কে জানে? তার সন্তান যে এমন হবে তা তার কল্পনার বাইরে ছিলো।
একে তো খাওয়ার টেবিল তার উপর জামাই বসে আছে। এই জামাইকে তিনি দুচোখে দেখতে পারেন না। একমাত্র জামাই হওয়া স্বত্ত্বেও এই ছেলেটিকে তিনি প্রচন্ড রকমের অপছন্দ করেন। কেন অপছন্দ করেন তারও বহুবিধ কারণ আছে । সবচেয়ে বড় কারণ ছেলেটি মারাত্মক রকমের লোভী। সে জবাকে লোভী বানিয়ে ফেলেছে নিজের স্বার্থে। কাজ হাসিলের উদ্দেশ্যে।
খাবার টেবিলে কিছুটা সময় চুপচাপ পার হবার পর জবা যখন বুঝলো যে পরিবেশটা ঠিক তার অনুকূলে নেই। তখন নিজেই উপযাচক হয়ে মায়ের সাথে এটা সেটা আলাপ শুরু করলো সে।জুলেখা বানুর ও আজ মন মেজাজ খারাপ। কথাবার্তা কিছুতেই জমছে না যে সেই প্রসঙ্গ ধরে জবা মূল প্রসঙ্গে আসবে।
অথচ জুবায়েরের কড়া হুশিয়ারি যে আজই যা করার করতে হবে।কিছুক্ষণের মধ্যে জবা আসল প্রসঙ্গে এলো,
– মা তোমার জামাই নতুন একটা ব্যবসা শুরু করবে বলে ভাবছে।
– ভালো তো।
– শুধু ভালো সাথে আরো কিছু বলো, একটু সৌজন্য তো আশা করতে পারি নাকি?
জুলেখার গা জ্বলে, সে জানে এরপর কি হবে, টাকা পয়সার কথা উঠবে। মেয়েটা এমন কেন।ও কি পাগল নাকি বোকা?
মেয়েটা একটু দুরন্ত ও জেদি ছিলো ছোটবেলা থেকেই, কন্ট্রোলে আনা যায়নি, বর্তমানে দিন দিন তা আরো বেশিমাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।বেশি আদর দেওয়ার ফল এখন হাতে হাতে পাওয়া যাচ্ছে। আদরে একেবারে বাঁদর যাকে বলে।
অপমানটুকু সয়ে জুলেখা জানতে চাইলেন,
– তা কিসের ব্যবসা। কোথায় করবে? আগেও তো কয়েকটি করেছে। যদিও সফল হতে পারেনি। এবার নিশ্চয়ই পারবে আশা করি।
– হ্যাঁ মা, বাবা তোমরা দোয়া করো। সেজন্য তো তোমাদের এখানে আসা। দোয়া নিতে।
রাকিব সাহেব সগোক্তি করলেন
– দোয়া নিতে এলে? তোমার মা’তো বলল জন্মদিন তাই বায়না করে এসেছো। কেউ তোমার খোঁজ নেয় না নাকি?
– অমন করে ঠেস দিয়ে বলছো কেন বাবা? দোয়া নিতে তো আসছি জন্মদিন তো উপলক্ষ, একটু অন্য কথাও ছিল অবশ্য। মা বাবা দুজনেই আছো যখন, বলছিলাম কি? ভাইয়ার এই অবস্থা তোমরাও আর কদিন। এই বাড়িটা শেষ পর্যন্ত তো আমরা দুই ভাই বোনই পাবো , নাকি?
যাহোক আসল কথায় আসি তোমরা যদি বাড়িটা বেঁচে আমার মানে আমাদের অংশটা বুঝিয়ে দিতে তাহলে আমরা জীবনটাকে নিজের মত করে গুছিয়ে নিতে পারতাম। এভাবে আর কতদিন?
আর ভাইয়ার অংশের টাকা দিয়ে ভাইয়ার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেতাহলে ভাইয়াও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। টাকা পয়সাই তো মূল সমস্যা তাই না?
রাকিব সাহেব মেয়ের স্পর্ধায় যারপর নাই অবাক হলেন,তাঁর ভ্রু কুচকে উঠলো। সমস্ত শরীর রাগে জ্বলে উঠলো। মাখা ভাত রেখে তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বেসিনে হাত ধুতে গেলেন।
আর কোন কথা হলো না বাকি সবাই খাওয়া শেষ করে যার যার মতো টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লো।
হঠাৎ করে পুরো বাড়িটা জুড়ে মধ্য রাতের নিস্তব্ধতা নেমে এলো যেন।
তেমন সুবিধা করতে না পেরে রাত বাড়লে জবা জানায় তারা এখন চলে যাবে, আর এ বাড়িতে আসা হবে কিনা সে ব্যাপারে তাকে ভাবতে হবে ,ইত্যাদি ইত্যাদি।
– এত রাগ কেন তোর?
-এতে আবার রাগের কি দেখলে মা।আমি চাই না আমার জন্য জুবায়ের তোমাদের বাড়িতে এসে অপমানিত হোক।
– ওকে কে অপমান করলে? কি যা তা বকছিস।
-ন্যাকামি রাখো তো, আর হ্যাঁ ভাইয়ার অসুখের সময় যে কুড়ি হাজার টাকা নিয়েছিলে ওটা কি দিতে পারবে?
-তোর বাবার কাছে শুনি?
-না পারলে সমস্যা নেই, ভাইয়ার তো একটা মোটর সাইকেল ছিলো। ওটা তো পড়ে থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে যাবে। চাইলে ওটা ধার দিতে পারো। ভাইয়া সুস্থ হলে না হয় তখন ফেরত দিয়ে যাবো। ভাইয়ার শখের জিনিস ভেবো না ,যত্নে থাকবে।
জুলেখা মেয়ে বিচার বুদ্ধি স্বার্থপরতায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পরে তুতুল ফোন দিলো জুলেখা বানুকে।
– মা জবা নাকি কাল খুলনায় যাবে? কি একটা জরুরি কাজে?
– আমি জানি না। তো কি হয়েছে?
-রায়হানের বাইকটা একটু নিতে চাচ্ছিলো। পরে ফেরত দিয়ে যাবে।
– কিন্তু………….
ওকে চাবিটা দিয়ে দিন মা। আমি আপনার সাথে এ ব্যাপারে পরে কথা বলছি। একটু ব্যস্ত আছি।
কলকাঠি কোথেকে নড়েছে জুলেখার বুঝতে একটুও দেরি হলো না। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।তাদের মৃত্যুর পর এতো সাধের সংসার তছনচ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না এটা এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছেন।
কারো কাছে কিছু শুনলেন না আর ,আর শুনাশুনি করে অশান্তি বাড়িয়েও লাভ নেই বুঝতে পেরে ,জুলেখা বানু মটর সাইকেলটার চাবিটা জবার হাতে ধরিয়ে দিলেন। শুধু বললেন,
– তোর এত লোভ? এত লোভ ভালো না’রে জবা।
জবা ও জুবায়ের দুজনেই সমান বেহায়া। ওরা কিছুক্ষণের মধ্যে মটর সাইকেলটা নিয়ে হাসতে হাসতে বিদায় হলো।
(৭)
দিন কয়েক পরে…..
আছরের নামাজ পড়ে জায়নামাজ গুছিয়ে তসবি হাতে জুলেখা বানু তুতুলের ঘরে ঢুকলেন।
আজ তাকে কয়েকটি কথা পরিষ্কার করে জানিয়ে দিতে হবে তুতুলকে। সমস্যা জটিলতর হবার আগে সমস্যার সমাধান করতে হয়।
ইদানিং তুতুলের মতিগতি জুলেখার একটুও ভালো লাগছে না। প্রায় প্রতিদিনই অনেক কথাই কানে আসছে তার, এমনিতে রায়হানের বাবার শরীরটা আজ কদিন খুব বেশি ভালো না। বুকে চাপ চাপ ব্যাথা বলছে। এই বয়সে এত পরিশ্রম তার পক্ষে সবকিছু একা হাতে সামলানো বেশ কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু করারও কিছু নেই।ডক্তিারের পরামর্শ দরকার এখন মাসের শেষ হাত একেবারে খালি।
তাই মাসের প্রথমে ছাড়া ডাক্তারের কাছে যাওয়া হবে না।এই নিয়ে জুলেখা বানু বেশ চিন্তায় আছেন কারণ মাস পুরতে এখনো বেশ কদিন বাকি,লোকটার কিছু হলে পুরো পরিবারটা ভেসে যাবে। এতোদিন তুতুলের ব্যাপারটা তিনি তাই ইচ্ছে করে রাকিব সাহেবের কানে তুলেন নি। বেচারা জানতে পারলে প্রচন্ড কষ্ট পাবেন। এমনিতে চারপাশ ঘিরে আসছে ঘোর অন্ধকারে।
অন্যদিকে তুতুলের ব্যপারটা নিয়ে জুলেখা বানু নিজেও কি কম কষ্ট পাচ্ছেন। কিন্তু কিছুই করার নেই যেন।
প্রথম প্রথম তিনি ব্যাপারটা ততটা আমলে নেননি।তারপর বহুমুখে শুনে আর অবিশ্বাস করবেন কি করে।
তুতুল এক মনে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সাজগোজে ব্যস্ত। খুব সুন্দর লাগছে তাকে।যার স্বামী পক্ষাঘাতগ্রস্থ পঙ্গু তার এত সাজগোজ অন্য কারণ নির্দেশ করে।
তুতুল বরাবরই সুন্দরী তবে সে যখন এ বাড়িতে বউ হয়ে আসে তখন এত ভালো তাকে দেখাতো না ইদানীং যেন রূপ তার কাছে মোহময়ী হয়ে ধরা দিয়েছে।
-তুমি কি এখন কোথাও বের হচ্ছো মা?
– হ্যাঁ একটু কাজ আছে বাইরে। ফিরতে রাত হতে পারে।রায়হানের সব চেঞ্জ করে দিয়েছি,তেমন কোন অসুবিধা আর হবে না হয়তো। হলে আপনারা তো আছেনই,দেখবেন। ওষুধ গুলো সব বাইরে রেখেছি। বাবা এলে খাইয়ে দিতে বলবেন ।
– কাজরীও যাচ্ছে?
– ওকে কার কাছে রেখে যাবো মা?
– ওর পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে।
– সে আপনাকে না ভাবলেও চলবে মা,আমি তো আছি নাকি?
– তুমি ওর মা,আসলে সবচেয়ে তুমি ভালো বুঝবে কিসে ওর ভালো কিসে মন্দ। যা হোক তোমার সাথে একটু কথা ছিল।
– আমার দেরি হয়ে যাবে, এমনিতে দেরি হয়ে গেছে তারপর কি ভেবে বলল,
– ঠিক আছে কি বলবেন বলুন।
– তুমি এই যে প্রতিদিন অসুস্থ স্বামীকে রেখে চলে যাও কোনদিন বাড়ি ফেরো আবার কোনদিন ফেরো না এতে নানা জনে নানা কথা বলে।
– মানে? আপনার সাথে আবার কে কি বলল।আর কে কি বলল না বলল আমার তাতে কিছু যায় আসে না মা।
– তোমার মেয়ে বড় হচ্ছে?সমাজে আমাদেরএকটা সামাজিক অবস্থান।
– আমি আগেও বলেছি আপনারা আপনাদের অর্থব ছেলেকে নিয়ে ভাবুন।আমাকে আর আমার মেয়েকে নিয়ে নয়। আর আমি ঠিক করেছি ওকে হোস্টেলে দিয়ে দিবো।
-এইটুকু বাচ্চা মেয়েকে তুমি হোস্টেলে দেবে? কেন?আমরা তো এখনো বেঁচে বর্তে আছি।
– আর আপনাদের আমি জ্বালাতন করতে চাই না।মা অনেকদিন বলবো বলবো ভাবছি বলা হয়ে উঠছে না,যেহেতু আপনি কথা তুললেন সেহেতু ভালো হলো।আসলে আমিও তো রক্ত মাংসের মানুষ, আমার নিজের একটা জীবন আছে। এভাবে আর ক’দিন? আপনাদের এখানে আমার মনে হয় খুব বেশি দিন থাকা হবে না।
– থাকা হবে না মানে? এসব তুমি কি বলছো? থাকা হবে না মানেটা কি? আমাদের কথা না হয় বাদ দিলাম তুমি এই সংসার ছেড়ে স্বামী সন্তান ছেড়ে কোথায় যাবে? কেন যাবে?
– মা আমি না এইসন ন্যাকামি একদম সহ্য করতে পারি না। আপনি দিব্যি সবাইকে নিয়ে চুটিয়ে সংসার করছেন। আমার অবস্থা বয়স এসব নিয়ে কি একবারও ভেবেছেন? নিজের মেয়ে হলে ভাবতেন।
কিসে আমার দিন রাত কাটে একবারও খোঁজ নিয়েছেন? নেননি।
জুলেখা বানু থমকে গেলেন রূঢ় বাস্তবতার কাছে,
তিনি কোন রকমে বললেন,
– তোমার একটা সন্তান আছে মা। ওর ভবিষ্যৎ আছে।
-আর আমার ভবিষ্যত?
-সব ঠিক হয়ে যাবে মা একটু সময় লাগবে হয়তো।
-আমি জানি, কিছুই ঠিক হবে না।
-তোমার মেয়েটার কথা একটু ভাবো।
– ভেবেছি, ওটাই তো পথের কাঁটা না হলে কবেই পথ দেখতাম।আমার পক্ষে দীর্ঘ দিন এই পঙ্গু অসুস্থ স্বামীর ঘর করা সম্ভব না।
(৮)
রাকিব সাহেবের এক বন্ধু ক’দিন আগে জানিয়েছিলেন, নবী নগরে নাকি একজন কবিরাজ আছে। তার দেওয়া তেল পড়া প্যারালাইসিস রুগীর শরীরে মালিশ করলে, রুগী খুব দ্রুত সেরে ওঠে। বিপদের সময় মানুষের সব বিশ্বাসের ভিত্তি দূর্বল হয়ে যায়। রাকিব সাহেব কখনোই এই সব তেল পড়া পানি পড়ায় বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু ওই বলে বিপদ মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তি মূলে আঘাত করে।
সেই কবিরাজের বিস্তারিত খোঁজ খবর নিয়ে রাকিব সাহেব সাভার থেকে ফিরছিলেন।সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, বাসের মাঝামাঝি ছিটে বসে আছেন তিনি। জ্যামে পড়ার কারণে অনেক যাত্রী নেমে গেছে। বাস প্রায় ফাঁকা।
পথ চলতে নিজের সাইড ব্যাগে সবসময় বই রাখেন তিনি,এটা তার অনেক দিনের পুরানে অভ্যাস। সময় কাটানোর জন্য এখন তিনি বাসের মৃদু আলোয় বই পড়ার চেষ্টা করছেন। জ্যামে পড়া সময়টা কাজে লাগানো তার পুরান অভ্যাস। গাড়ি এগুচ্ছে ধীর গতিতে। মাঝে মাঝে কিছু যাত্রী উঠছে, আবার গন্তব্য এলে নেমে যাচ্ছে কেউ কেউ। রাকিব সাহেব ডুবে আছেন বইয়ের মাঝে।
হঠাৎ সামনের সিটে নারীর কন্ঠটি তার চেনা মনে হলো।একটু খেয়াল করে কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি বুঝতে পারলেন এটা তুতুলে গলা। তিনি কিছু বলার উদ্যোগ নিতেই কয়েকটি কথা তার কানে এলো, তিনি বরফের মত জমে গেলেন। একি বলছে তুতুল…… সঙ্গের লোকটিই বা কে? মেয়েটি তাদের প্রতি এতটা ঘৃণা পুষে রেখেছে অথচ তারা….
ছেলেটি বলল,
– তারপর কি ফাইনাল করলে?
– কতবার বলবো।বললাম তো সামনের মাসে বিয়ে করছি আমরা।
– তোমার মেয়েটাকে কি করবে?
– বোডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেবো।
– সেই ভালো নির্ঝঞ্ঝাট থাকা যাবে।
-আর ওই পঙ্গুটাকে?
-ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়ে দেবো দু একদিনের মধ্যে।
আমি আর পারছি না, অভিনয় করে করে ক্লান্ত জানো তো।
-আসলেই।
-বুড়ো বুড়িকে কি করে ম্যানেজ করবে?
-আরে রাখো তো,ওরা আমার কিছু করতে পারবে না। আর আমার ওত মায়া টায়া নেই। বরং সারাদিন ঘ্যানঘ্যানানির হাত থেকে বাঁচা যাবে। আমাকে নীতি নৈতিকতা শেখাতে আসে, যত সব বিরক্তিকর লোকজন। রায়হান সুস্থ থাকলে এতদিনে ওল্ড হোমে পাঠিয়ে দিতাম ঠিক। কপাল ভালো বুড়ো বুড়ীর। ওদের মেয়েও তো চায় ওরা ওল্ড হোমে যাক। করোনা এসে সব প্লান ভন্ডুল হয়ে গেলো।
– করোনা এসে ভালো হয়নি বলছো?
তুতুল এবার হো হো হো করে হেসে ছেলেটির গায়ে গড়িয়ে পড়লো।
– একেবারে যে খাবাপ হয়েছে তা বলা যাচ্ছে কোথায়? করোনা না এলে তো তোমার কাছে আসা হয়ে উঠতো না। তোমাকে নিজের করে পাওয়া হতো না। ঝামেলাটা মিটিয়ে নেই তারপর দুজনে চুটিয়ে সংসার করবো।
–
(৯)
দরজা খুলে রাকি সাহেবের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেলেন জুলেখা,
– কি হয়েছে তোমার?এমন দেখাচ্ছে কেন?
– শরীরটা ভালো লাগছে না।মাথা ঘুরছে জুলেখা।
-বেসিন থেকে হাত ধুয়ে ফ্যানের নিচে বসো ফ্যান ছেড়ে দিচ্ছি। পানি খাবে? পানি দেবো?
রাকিব সাহেব অস্ফুট স্বরে বললেন
-দাও।
-ঠিক আছে হাত মুখ ধুতে হবে না,গোসল করবে তো।আগে ফ্যানের নিচে বসো বিশ্রাম নাও,তারপর গোসল করো। গোসল করলে নিশ্চয় ভালো লাগবে।
– আর বিশ্রাম আর ভালো লাগা,আমাদের সব আশা শেষ হয়ে গেছে জুলেখা সব আশা শেষ হয়ে গেছে।
পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে জুলেখা প্রশ্ন করেন
-কোথাও কোন ঝামেলা হয়েছে? কোন সমস্যা। আশা সব শেষ হয়ে যাবে কেন? আমরা এত সহজে হার মানবো না। কি হয়েছে কি?
মুখে প্রায় এসে গেছিলো কিন্তু রুচিবোধ এসে বাধা হয়ে দাড়ালো। কি করে তিনি ছেলের বউ দিকে আঙ্গুল তুলবেন?
রাকিব সাহেব মাথা নাড়ালেন, মুখ খুলতে দ্বিধাগ্রস্থ তিনি। যদি মুখ ফসকে কোন অসংলগ্ন কথা বের হয়ে যায়।
বুকের ব্যাথাটা আবার ফিরে আসছে সেই সাথে মাথা ব্যথা ।হয়তো গ্যাসের ব্যথা। জুলেখা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
-ডাক্তার ডাকবো?
-না ঠিক হয়ে যাবে।এখন একটু ভালো বোধ হচ্ছে।
-এ মাসের টাকা পেলে একটা ভালো ডাক্তারের কাছে তোমাকে নিয়ে যাবো। আর আমি বলি কি এবার ভ্যাকসিনের জন্য রেজিষ্ট্রেশন করে ফেলো। ভ্যাকসিনটা নিয়ে নাও। এর পর নাকি সরকার আর ফ্রী দেবে না। কিনতে হবে।
-তুমি দেবে না ভ্যাকসিন।
-আমি তো বাড়িতে থাকি।তোমার নেয়াটা বেশি জরুরি। আর ডাক্তার দেখানোটাও।
সে রাতে তুতুল বাড়ি ফিরলো না।রাত বাড়ার সাথে সাথে রাকিব সাহেবের বুকের ব্যথা বাড়তে লাগলো।জুলেখা জবার কাছে ফোন দিলো সে জানালো তারা সবাই নাকি গ্রামে বেড়াতে গিয়েছে। এখন আসতে পারবে না। তুতুলের ফোনও বন্ধ পাওয়া গেলো।
রাকিব সাহেব বললেন
– আমার সমস্যা হচ্ছে না তুৃমি খামোখা অস্থির হচ্ছো আগামীকাল ডাক্তারের কাছে যাবোভাবছি,তুমিও সাথে যেও কিন্তু খোকার কাছে কে থাকবে?
জুলেখাবানুর চোখ ভারি হয়ে এলো।তিনি কান্না লুকাতে পাশের ঘরে চলে গেলেন।
(১০)
শেষ রাতে ব্যথাটা একটু কমলে রাকিব সাহেব ও জুলেখা বানু দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লেন।হঠাৎ কারো বিভৎস গোঙানির আওয়াজে জুলেখা বানুর ঘুম ভেঙে গেলো, ঘুম ভাঙতেই দেখলেন অনেক বেলা হয়ে গেছে।পাশের ঘর থেকে রায়হান চেঁচাচ্ছে ,গোঙানির আওয়াজটা তার, রায়হানের সারা শরীর মল মূত্রে একাকার।
জুলেখা তাড়াহুড়োয় উঠতে গিয়ে রাকিব সাহেবের গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে চমকে উঠলেন,
-একি রায়েহানের বাবার শরীর এত ঠান্ডা কেন?
কিছুক্ষণ পরে জুলেখা লজ থেকে গগন বিদারী চিৎকার ভেসে এলো
– ওরে রায়হান রে এসে দেখে যা বাপজান কি সর্বনাশ হলো রে।তোর আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে রে।ওরে আমাদের কি হবে রে। কে দেখবে রে। আল্লাহ তুমি এতো নিষ্ঠুর কি করে হলে। আল্লাহ আল্লাহ……
শেষ
৮টি মন্তব্য
সাখাওয়াত হোসেন
অনেক বড় গল্প! ছোট হলে আমার জন্য পড়তে সুবিধা হতো। কিছুটা পড়েছি, বাকিটা ডিউটির পরে পড়ব।
তবে যেটুকু পড়েছি দারুণ ভাল লেগেছে —
পপি তালুকদার
বাস্তব জীবন হয়তো এমনি!!! কখনো কখনো সব দুঃখ যেন এক সাথে নেমে আসে যেন কিছুতেই ঘোর অমানিশা কাটে না।অনেক ভালো বাস্তব সম্মত একটি গল্প পড়লাম।বেশ ভালো লাগলো।
অনেক অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা রইল।
ইসিয়াক
গল্প ভালো লাগলো জেনে অনুপ্রাণিত হলাম।
শুভ কামনা রইলো।
ইসিয়াক
ধন্যবাদ সাখাওয়াত হোসেন ভাইয়া। গল্পটা একটু প্রায় ৪১০০+ শব্দ। কষ্ট করে পড়েছেন।বাকিটুকুও পড়বেন আশা করি।
গল্প ভালো লেগেছে জেনে অনুপ্রাণিত হলাম।
শুভ কামনা রইলো।
আরজু মুক্তা
বাস্তবতা এমনি। আমাদের মধ্যবিত্তের টানাপোড়ন শেষ হয়না। একটা জটিলতা শেষ হলে আর একটা শুরু হয়।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন নিয়ে চমৎকার গল্প। সমস্যার জাহাজে ডুবে থাকাই যেন এদের জীবন। আজকাল সবাই কেমন জানি স্বার্থপর হয়ে গেছে। সন্তান রা আজকাল বাবা-মায়ের সাথে স্বার্থের বলয়ে বন্দী, মানবতা, ভালোবাসা হারিয়ে যেতে বসেছে। অফুরন্ত শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো
শামীনুল হক হীরা
very nice
সাখাওয়াত হোসেন
মধ্যবিত্তের যাঁতাকলে আমরা একেবারেই পিষ্ট।
দারুণ লিখেছেন ভাইয়া।