আগের দিন রাজশাহী কুয়াশায় আচ্ছন্ন ছিলো। সকালে হোটেলের বারান্দায় বসে চা পান করছি। হঠাৎ সোনা-ঝরা রোদে মনটা ভরে উঠলো। কারণ চিত্রশিল্পী ছবি আঁকে রং-তুলি দিয়ে। আমরা ছবি তুলি আলো দিয়ে। তাই আলো যদি না থাকে তবে ছবির মান ভালো হয় না। ক্যামেরাটা নিয়ে হোটেল থেকে বের হলাম। রওনা দিলাম টি-বাঁধ সংলগ্ন ঘাটে। নৌকায় এদিক-ওদিক ঘুরছি। সূর্যের আলোয় কৃষকদের আনোগোনায় পদ্মারচর মুখরিত। কিষাণ ও কিষাণী একসঙ্গে ধানের চারা রোপণ করছেন। দেখতে ভালোই লাগছিল। ভারতের নদী সীমানা বরাবর নৌকা চলে এসেছে। আর সামনে যাবার সুযোগ নেই। নদীর ধারে ছোটবক, কালিকাক, মাছরাঙ্গা ছাড়া অন্য কোনো পখি চোখে পড়লো না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এমন সময় সামনে কিছু পাখি ডুব দিচ্ছে, তারা মুখে মাছ নিয়ে পানির উপরে উঠছে। এই পাখিটিকে আগে কখনো দেখিনি। মাথায় খোঁপা আছে। পরে জানতে পারি এটি ‘খোঁপাডুবুরি’ বা ‘বড়ডুবুরি’ পাখি। দেখতে খুব সুন্দর! তার চেয়ে সুন্দর পানির উপর ভেসে বেড়ানো আর শিকারের জন্য ডুব দেওয়া।
খোঁপাডুবুরি Podicipedidae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ৫০ সে.মি. দৈর্ঘ্যের মাঝারি আকারের জলচর পাখি। এদের পিঠ কালচে বাদামী। পালক ঘন ও রেশমী। ডানা ছোট। ঠোঁট তীক্ষ্ম ও সুচালো বল্লমের মতো। পা জলপাই সবুজ। পায়ের নখ প্রশস্ত। দেহের নিচের রং সাদা। মাথার চারদিক কালো ও মাথার উপর কালো খোঁপা থাকে। চোখ গাঢ় লাল। উড়ার সময় ডানার স্পষ্ট সাদা পট্টি দেখা যায়। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথার নিচে তামাটে ও কালো পাড়ওয়ালা লম্বা পালক থাকে। পুরুষ পাখির তুলনায় মেয়ে পাখির পালক বেশি থাকে। গাল ও ঘাড়ের উপর অংশ সাদা রঙের হয়। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারায় কোনো পার্থক্য নেই।
খোঁপাডুবুরি হাওর, বিল, নদী, ঝিল, মোহনা ও উপকূলীয় এলাকায় বিচরণ করে। জোড়া বেঁধে ও ছোট দলে থাকতে পছন্দ করে। পানিতে সাঁতার কেটে ভেসে বেড়ায়। মাঝে মাঝে ডুব দিয়ে বল্লমের মতো চোখা ঠোঁট দিয়ে শিকার করে। এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে ছোট ও মাঝারি আকারের মাছ ও ব্যাঙের বাচ্চা। এরা জোড়ায় জোড়ায় পানিতে ডুব দিয়ে ভেসে উঠে গলায় গলা লাগিয়ে মুখোমুখি হয়ে কর্কশ স্বরে ডাকতে থাকে। এদের প্রজননকাল এপ্রিল থেকে জুন মাস। গ্রীষ্মকাল এদের প্রজনন সময়। এরা অল্প পানিতে ঘাস ও বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদের নল দিয়ে বেশ বড় করে ঢিবির মতো বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় ৪-৬টি ডিম দেয়। ২৬-২৮ দিনে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হয়। প্রায় ৯০ দিনের মতো সময় লাগে বাচ্চাদের বাসা ছাড়তে।
খোঁপাডুবুরি আমাদের দেশে দুর্লভ পরিযায়ী পাখি। শীত মৌসুমে আমাদের দেশে আসে খাবারের জন্য। গ্রীষ্মের আগে বা তাদের প্রজননের সময় আমাদের দেশ থেকে চলে যায়। শীতে আমাদের দেশে হাওর বা নদীতে খাবার খেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে প্রজননের জন্য প্রস্তুত হয়। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগের হাওর, জলাশয় ও নদীতে ও উপকূলীয় এলাকায় এদের পাওয়া যায়। এ ছাড়াও আফ্রিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়ায় এদের বিস্তৃতি রয়েছে।
বাংলা নাম: খোঁপাডুবুরী বা বড়ডুবুরী
ইংরেজি নাম: Great crested grebe
বৈজ্ঞানিক নাম: Podiceps cristatus.
ছবিগুলো রাজশাহীর পদ্মারচর থেকে তোলা।
২৩টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
কালিকাকা কী?
এই পাখিটি দেখতে ও জানতে চাই।
‘আমরা ছবি তুলি আলো দিয়ে।’ আপনি কবি কী-না তা ভাবছি।
শামীম চৌধুরী
কালিকাকা না হেলাল ভাই। এটা কালিকাঁক হবে। কালিকাঁক হচ্ছে ধুসর বক। গ্রে হেরণ। পরবর্তীতে কালিকাঁক নিয়ে লিখবো তখন দেখবেন ও জানবেন।
ছাইরাছ হেলাল
ভুলে লিখেছি ভাই।
অপেক্ষায় রইলাম।
জাহিদ হাসান শিশির
হাসের মতই দেখতে।
শামীম চৌধুরী
জ্বী শিশির ভাই। এরা হাঁস জাতীয় পাখি।
জাহিদ হাসান শিশির
তাইতো বলি…..
ইঞ্জা
খুবই সুন্দর বর্ণনা, মুগ্ধ হয়ে পাখি চিনছিলাম।
ধন্যবাদ ভাই এমন সুন্দর এক পাখির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ ভাইজান।
ইঞ্জা
ভালোবাসা। 😍
নিতাই বাবু
দেখতে হুবহু রাজহাঁসের মতো। তবে এঁদের নামটা এই প্রথম জানা হলো। ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় দাদা।
শামীম চৌধুরী
শুভ কামনা রইলো দাদাভাই।
জিসান শা ইকরাম
এই পাখিটি কখনো দেখিনি,
পাখির মাথায় খোঁপা আছে তা আপনার এই পোস্ট না পড়লে জানা হতো না।
অত্যন্ত সুন্দর বর্ননায় আপনার পাখি বিষয়ক পোস্ট গুলো অসাধারন হয়।
শুভ কামনা ভাইজান।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ ভাইজান। আশা করি সামনে আরো অজানা পাখি নিয়ে হাজির হবো।
তৌহিদ
পাখির নামটা কিন্তু সুন্দর। পাখির ছবির জন্য কত কষ্ট করতে হয় আপনাকে!!
আজ নতুন করে নতুন একটি পাখি নিয়ে অনেক কিছু জানলাম। ধন্যবাদ ভাই।
শামীম চৌধুরী
শুভ কামনা রইলো তৌহিদ।
প্রদীপ চক্রবর্তী
দারুণ উপস্থাপন দাদা।
অনেক কিছু জানতে পারলাম।
..
আগামী শীতে আসবেন দাদা বাংলাদেশের বৃহত্তম হাওর পাখি বাড়ি হাকালুকিতে। যেখানে ভিন্ন প্রজাতির পাখির মিলনমেলা বহে।
শামীম চৌধুরী
দাদা আসবো। আসার দিন আপনাকে জানাবো।
মাসুদ চয়ন
খুব ভালো একটি আর্টিকেল উপহার দিলেন।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ ভাই।
আরজু মুক্তা
কতো রং, কতো বাহারি পাখি।
ভালো লাগে পড়তে ও জানতে
শামীম চৌধুরী
ধন্যাবাদ আপু।
মনির হোসেন মমি
খোপাঁ ডুবুরি সম্পর্কে অনেক কিছুই জানলাম।তবে এরা যখন জলে চলে তখন জলের ঢেউ দেখতে খুব সুন্দর লাগে।ছবি দেখে বললাম।খুব ভাল হয়েছে।
শামীম চৌধুরী
সঠিক বলেছেন।