এক সময় প্রচুর গান শুনতাম।তখন ডিজিঁটাল যুগটা আমাদের এ দেশে চালু হয়নি।এনালগের জীবনে মানুষের জীবীকার সন্ধানে ছুটে চলা দেশের এ প্রান্ত হতে ঐ প্রান্তরে।তেমনি এক জাতি গোষ্টি ক্যানভেসার বা যারা পথে ঘাটে হাট বাজারে বিভিন্ন কৌশলে খেলা দেখিয়ে গান শুনিয়ে দু’পয়সা রোজগার করেন।নাচ আমার ময়না তুই পয়সা পাবিরে…যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম বকসি বাজার পানের খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম,, ইত্যাদি গানগুলোর সাথে বানর সাপ বেজি ইত্যাদি নামক জন্তুগুলোর অনবদ্য নাচ আর ভ্যাংচিতে মানুষকে আনন্দ দিত।মজমাতে ক্যানভেসাররা আনন্দ বেচে নিজেদের জীবন জীবিকা চালাতেন।আজকাল সেই সব ক্যানভাসারদের তেমন একটা দেখা যায় না বলা যায় বিলুপ্তির পথে তারা।
যারা ক্যানভেসার তাদের মজমাতে কথা বলার রয়েছে প্রচুর দক্ষতা।কথা আর অঙ্গভঙ্গির বিশেষ কৌশলই মানুষ জড়ো করার মুল উপাদান।তাদের কথার শুরুতেই থাকে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।পরম করুণাময় আল্লাহর নামে শুরু করা কিংবা তারা প্রত্যেকেই পীর আউলীয়া ভক্ত।কেউ কেউ পীর আউলীয়ার ছবি দেখিও পয়সা তুলতেন,কেউ বা গোপন তাবিজঁ দিয়েও পয়সা হাতিয়ে নিতেন।তাদের সব মুল মন্ত্র ছিলো বিশ্বাস।আপনি বিশ্বাস করেছেন তো কিছুটা কাজও হয়েছে এমনও প্রমাণ পাওয়া যেত নতুবা একই স্থানে ভূয়া দিয়ে লং টাইম মজমা চালিয়ে যেতে পারতো না।তাদের কথা “বিশ্বাসে বস্তু মিলে তর্কে বহু দূর”।তবে ছোট বেলায় খুব অবাক হতাম তাদের কথা বার্তা এবং হিড়িক পড়া ঔষধ বিক্রী দেখে।পৃথিবীর সকল রোগের মহাঔষধের কারিগররা একদিন হয়তো পাশ করা ডাক্তারদেরও ফেল করে দিবেন।
ভয় লাগত কিছু কিছু মজমা দেখতে।যেমন বেদ বেদীনিদের সাপের খেলা।হরেক রকম সাপ নিয়ে পুরুষরা মজমা করত হাট বাজারে আর বেদেনীরা মজমা জমাতো বাড়ী বাড়ীতে।হাটঁ বাজারে কখনো কখনো সাপ-বেজীরঁ যুদ্ধও দেখা যেত।বেদীনিদের বাসা বাড়ীতে খেলায় তাদের বচন ভঙ্গি গীত আজো আমাদের ভাবায় আজো মধুর লাগে।খা খা খা তুই বক্ষিলারে মাথায় ধইরা খা,যে খেলা দেখে পয়সা দিবে না তারে ধইরা খাঁ ইত্যাদি গীতগুলো এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।সাপের খেলা দেখাই,দাতে পুক সাফ করাই ইত্যাদি শ্লোগানের বেদিনীগুলো যা ছিলো এক সময় সারা বাংলায় তা এখন দেখতে পাইনা বললেই চলে।
তখনো এ দেশে যাদু বিদ্যার রাজা জুয়েল আইচ তেমন ভাবে আর্বিভুত হননি।তখন ক্যানভাসাররা যাদুর রাজা পিসি সরকার বা কামরুখকামাক্ষ্যার নাম ভাঙ্গিয়ে ক্যানভাস করতেন।সে সব মজমায় এক জন জল জ্যান্ত মানুষের দেহ হতে কল্লা বা ঘাড় আলাদা করতেন অনায়াসে।যাদু শুরুর আগে ক্যানভাসারের চারপাশে গোলাকার হয়ে যে লোকগুলো দাড়িয়ে থাকতো সে সকল লোকগুলোর পা বরাবর গোলাকৃতির দাগ কেটে হুশিয়ার করে দিতেন৴যারা এ বৃত্তের বাহিরে যাবেন বা খেলা শেষ না হওয়া আগে চলে যাবেন তাদের অনেক ক্ষতি হবে।কারো কারো অন্ডকোষও নাই হয়ে যেতে পারে তাই সাবধান!খেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ এখান হতে এক পা নড়বেন না।আমি তখন খুব ছোট ছিলাম।আমাদের চলে যেতে বলা হত।আমরা আর কই যাই কৌতুহলময় এত সুন্দর যাদু না দেখে কি যাওয়া যায়!আমরা বড়দের পায়ের চিপাচুপায় দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তা দেখতাম।কি সাংঘাতিক!একজন জলজ্যান্ত মানুষকে শুয়িয়ে মৃত মানুষের মতো তার উপর চাদর বিছিয়ে তলোয়ার দিয়ে কেটে দেহকে কত সহজেই আলাদা করে দিল।তলোয়ারেরঁ আঘাতে খন্ডিত লাশটা চাদরেরঁ ভিতরে থর থর করে কাপছেঁ আর জীবনাষের শব্দে ঘোঙ্গাছে।ভয়ে দেহে কাপন ধরে যেত আর ঐ দিকে ক্যানভেচার খুব দ্রুত এবং ছটফটে উত্তেজিত ভাবে বলতে থাকে“কেউ এক পা নড়বেন না তাহলে মেয়ে বা ছেলেটিকে আর বাচানো যাবে না আর আর আল্লাহর দোহাই লাগে যে যা পারেন যার কাছে যা আছে টাকা পয়সা সব মাটিতে ফেলুন।আমি ভয়ে পকেটে ছিলো দশ পয়সা তাও ফেলে দিলাম।এরই মধ্যে সে বলতে থাকেন অনেকটা রসিকতা করে”সবাই সবার অন্ডকোষ চেক করুন দেখুন ঠিক আছে কি না”।অনেকে ইতিমধ্যে অন্ডকোষ আছে কি না ভেবে চেকও করে ফেলেন।এমন সব দুর্দান্ত অভিনয়ে টাকা পয়সা রোজগারে ধান্দায় থাকতেন তখনকার ক্যানভাসাররা।
তখনকার এমন সব ক্যানভেসারদের সাথে কিছু শ্রেণী ক্যানভেসার ছিলো যারা শুধু গান গেয়ে বেড়াত।পল্লীগীতি ভাটিয়ালী আধুনিক হিন্দী উর্ধু বহু ধরনের গান গেয়ে মজমা জমিয়ে পয়সা চাইত।আমরা বাঙ্গালী শুধু গান শুনেই তেমন একটা পয়সা দিতে চাইতাম না,গান শুনেই চলে যেতাম তা তারা বুঝতে পেরে কিছু কিছু ক্যানভেসাররা শালসা বা তাবিজ বিক্রয় করে পয়সা হাতিয়ে নিতেন।প্রথমে মজমায় অসংখ্য মানুষের সামনে দরবার শরীফের ছবি দেখিয়ে খাজাঁ বাবার নামে পয়সা তুলতেন এরপর গান পাশা পাশি একটি করে তাবিজঁ ফ্রি বলে দিতেন যা মুষ্ঠিবদ্ধ করে দাড়িয়ে থাকতে হত গান বা কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত।এরপর যাদের হাতে তাবিজঁ দেয়া হয়েছে তাদের নিকট দুচার পাচ টাকা করে গান গাওয়া মেয়েটিকে খেতে দিতে বলতেন।এরপর শুরু করতেন তাবিজেরঁ মহা গুণের বিবরণ।এর মধ্যে তাবিজেরঁ হাদিয়া ধরে যারা দিতেন তরা তাবিজটি হাতেই রাখেন আর যারা হাদিয়া দিতেন না তারা তাবিজগুলো ফেরত দিতেন।ধীরে ধীরে মজমায় লোক সংখ্যা কমিয়ে এনে গুটি কয়েকজনকে খুশি করে বা বাধ্য করে হাতিয়ে নিতেন মোটা অংকের টাকা।
তবে এস সবিই ভন্ড বা ভুয়া যদিও কিছু কাজ হয় তা কেবল বিশ্বাস আর নিয়ম করে জীবন যাপন করার জন্য।নতুবা সামন্য কাগজে জাফলং কালিতে কিছু একটা লেখার কি সাধ্য আছে মানুষের পচে যাওয়া মন বা অঙ্গ সারবার।অনেকে আবার কোন এক বিশেষ কাজের জন্য আমবশ্যার গভীর রাতে একা নীরবে যেন কাক পক্ষিও টের না পায় ঐ শ্মষান বা কবরস্থান হতে এক দমে লাশের হাড় কিংবা মাটি কিংবা অন্য কিছু তুলে এনে সেই রাতেই উদ্দ্যেশ্যস্থানে মাটির নীতে পুতে রাখতে হবে ইত্যাদি কবিরাজঁদের ভাওতাবাজী আমি কোন কালেই বিশ্বাস করতাম না,তখনো করিনি।
এ সম্পর্কে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা।বয়সের দোষে মন ছিলো বেশ বিষন্ন।বিষন্ন মন দেখে বাড়ীর আপণ মানুষগুলো ভাবলো-কাম ছাড়ছে ওরে কবিরাঁজের কাছে নিতে হবে।খোজাঁ হল ভাল কোন কবিরাজঁ।পেয়েও গেলেন তারা-বহুল জনপ্রিয় কবিরাজঁ।আমার শত আপত্তিও তখন তাদের কাছে কেউ না কেউ আমাকে তাবিজঁ করেছে এমন সব ভাবনা ভাবতে থাকেন।অবশেষে রাজী হলাম কবিরাজেঁর কাছে যাব এবং তাদের ফালতু কবিরাজঁ সম্পর্কে বিশ্বাসের ভুল ভাঙ্গাবো।কবিরাজঁ আমার আপণ জনের হাতে শুধু মাত্র একটি লোহার ছোট একটি তাবিজঁ ধরিয়ে দিলেন।এই তাবিজঁই নাকি আমার জীবন সুন্দর হয়ে উঠবে,ভুলে যাবো ব্যাথা কষ্ট,মন আসবে লেখা পড়ার আগ্রহ।আর জীবনের অর্থে বিত্তে স্বয়ংসম্পর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে পৌছে যাবো খুব দ্রুত।আরো কত কি যে সারবে এই একটি তাবিজেঁ তা বলা বাহুল্য।হাদিয়া নিলেন বেশী না তখনকার দিনে মাত্র ৫০১ টাকা।তাবিজঁ নিয়ে বাসায় এলাম।এখন তাবিজঁ আমাকে বাম হাতের কনুইয়ের উপরে পড়তে হবে।আমিতো নারাজ ওখানে নয় কোমরে পড়বো তাতে কেউ দেখতে পারবে না।অনেক পিরাপিরিতে হাতেই আমাকে তা পড়তে বাধ্য করল তবে তার আগে আপণজনদের বললাম শর্ত আছে আমার।তারা বললেন,বল কি শর্ত?আমি বললাম আমি এটাকে তাবিজঁটাকে খুলে দেখবো এবং দেখাবো এর ভিতর কি এমন মহাশক্তি আছে যা দিয়ে একজন অসুস্থ বা বিষন্ন মানুষকে সুস্থ করে।তারা যদিও রাজী হয়নি কিন্তু আমি অনুমতি পাওয়ার অপেক্ষা না করেই দ্রুত তাবিজেরঁ মোম দিয়ে মারা মুখ খুলে এক এক করে ভিতরে থাকা বস্তুগুলো বের করে তাদের সামনে রাখছি আর বলছি….এই যে এই নখ!এই চুল,এই যে কাগজেঁ লেখা কিছু আরবী অক্ষর,কিছু পানের চুন,একটি ছোট হাড়ের টুকরো এইগুলোর কি সাধ্য আছে আমার মনকে শান্ত করার তাও আবার লোহার তাবিজেঁ বন্দী?এ সব দেখে তারা চুপ হয়ে গেলেন।এবং আমি বললাম আপনাগো পাচশ হাজার টাকাগুলোই বৃথা গেল।এই টাকাগুলো যদি ফকিরদের দিতেন তাহলে আয়ু বাড়ার দোয়া পেতাম।আপনাগো এমন সব কান্ড দেখে আমার মন এখন পুরোপুরি ভাল হয়ে গেছে।যান এই তাবিজঁ নিয়া ঐ কবিরাজের কাছ হতে টাকা ফেরত আনেন।এই হলো অবস্থা।একজন ভাল কবিরাজ কখনো যাদুটোনা,বান,বশ করা ,সংসার ভাঙ্গা বা জোরার তাবিজঁ দিবে সে জীবন যৌবন মাথাকে ঠান্ডা রাখতে দিবেন বনজ ঔষধ।
আনন্দের আড়লে যাই ঘটুক ঐসব ছিলো আমাদের দেশের গ্রাম বাংলার চমক যা এখনো আছে তবে মাঠে ঘাটে কিংবা হাট বজারের কোন গানের আসরে নয় এখন তারা উচু তলার মানুষ।পত্রিকায় টিভিতে রীতিমত বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্যানভাচারী করেন।ডিস টিভিতে কিছু ভিডিও চ্যানেলে দেখতে পাওয়া যায় বিশাল সাইনবোর্ডের বিশাল অফিস।সর্বো রোগের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ এক ফাইলই রোগমুক্তি।বিশ্বের ওমুক নামজাদা স্থান হতে অভিজ্ঞতা অর্জনকারী কিংবা স্বপ্নে পাওয়া স্রষ্টার নিজ হাতের নিয়ামত ইত্যাদি এ সব বিজ্ঞাপন যখন দেখি তখন ভাবি এতো রোগ-বালাই তারা সারাতে পারে তাহলে দেশে বড় বড় ডাক্তারগো বিদ্যালয় রাইখা কি লাভ?সরকার কি আহম্মক নাকি।ওদের একেক জনকে একেক হাসপাতালে বসিয়ে দিলেইতো আর দেশে কোন রোগ জীবানুই থাকে না।কি বলেন আপনেরা ঠিক কইছি না? এ সব বিষয়ে আমরা সকলি কম বেশী জ্ঞাত।কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মদতে এ সব এখন দেশে অহরহ।সবার সব কিছুই ঠিক থাকে শুধু ক্ষতিটা হয় আমাদের মত যারা রোগ নিরাময়ে কোথাও কোন ভরসা খোজেঁ পাই না।কিংবা শরিরে প্রকৃতপক্ষে বাতের ব্যাথা অথচ মেধাহীন ডাক্তার কিংবা প্যাথলজির পরীক্ষার রিপোর্টে উঠে আসে ক্যান্সার।মারো ক্যামো থেরাপি অবশেষে অকালেই জীবনাষন।
ছবি:অনলাইন
৮টি মন্তব্য
মাহমুদ আল মেহেদী
অনেক ভাল লাগল ভাই
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
ধন্যবাদ -{@
মোঃ মজিবর রহমান
জীবন হায়রে জীবন এটাই জীবন।
মোঃ মজিবর রহমান
সবই জিবনের জন্য।
আগুন রঙের শিমুল
আমাদের গ্রামের হাটে মাঝেমধ্যে দেখতাম এদেরকে, এখন আর দেখিনা।
লেখা ভালো হইছে ভাই 🙂
মৌনতা রিতু
আগের গানগুলো আসলেই অন্যরকম এক প্রাণ ছিলো। গ্রাম বাংলার মানুষের মনে এখনও দাগ কেটে আছে। কবিরাজি নিয়ে ব্লগে একবার লেখা দিছিলাম। মেমনের বাবাকে আমি একদিন বললাম, ঐ কবিরাজের মাইকিং এর জন্য তো আমার ছেলেদের নিয়ে এ বাসায় থাকাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।” ওর বাবা ঐ কবিরাজকে ধরে সেই রংমাখা আটার দলা খাওয়াইছিলো সব। তার কাছে সর্ব রোগের চিকিৎসা ছিলো। ভাবা যায়!
তাবিজ কোবচে আমার কোনোদিন বিশ্বাস ছিলো না। তবে এ ব্যাপারে আমার খুব বিরক্তকর একটা অভিজ্ঞতা আছে।
পরে কোনোদিন লিখব।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
হা হা হা।লিখে ফেলুন -{@
সঞ্জয় কুমার
অতীত স্মৃতিময় । তবে হয়তো ইচ্ছা এবং উদ্দোগ থাকলে আমাদের ঐ পুরনো গান সংস্কৃতি গুলো হারিয়ে যেত না ।
প্রতারণার কৌশল পাল্টিয়ে প্রতারক চক্র এখনও আছে । এগুলোতে ক্ষতি হয় চিকিৎসা করতে অসামর্থবান মানুষেরা ।
ধন্যবাদ পুরনো একটা বিষয়কে নতুন করে সামনে আনার জন্য