“-ওই গান থামা। পাক সেনারা শুনলে বুইঝা যাইবো তুই কোথায়। তোর মরণের ভয় নাই নাকি?’
-আরে মরবোইতো একদিন। ভয় পাওয়ার কী আছে? গান গাইয়া লই”
এমনই গান পাগল ছিলেন মানুষটা। একাত্তরে যখন জীবন বাঁচা আর মরার সান্নিধ্যে ছিল তখনও গানকে ভুলেন নি তিনি।হাতে অস্ত্র আর কণ্ঠে গান নিয়েই করেছিলেন যুদ্ধজয়! শুধু একাত্তরেই নয় দেশের জন্য লড়েছেন আটষট্টি- ঊনসত্তরেও। মাত্র সতের বছর বয়সে যোগ দিয়েছিলেন আন্দোলনে। সে সময়ে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর হয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গান গাইতে গিয়েও বুক কাঁপেনি তাঁর। জেলায় জেলায় ঘুরতেন তাঁরা, গান গাইতেন সরকারের বিরুদ্ধে। পুলিশের তাড়া খেয়ে অসংখ্যবার দৌঁড়ে পালিয়েছেন তিনি। এভাবেই কেটে যায় আটষট্টি-ঊনসত্তর-সত্তুর।সূচনা হয় স্বাধীনতার বছর,উত্তাল পুরো পূর্ব বাংলা। ২৫শে মার্চ এক রাতের ব্যবধানেই যেন মৃত নগরীতে পরিণত হয় ঢাকা। রাস্তায়-রাস্তায়,গলিতে-গলিতে,বাড়িতে-বাড়িতে পরে থাকতে দেখা যায় শত শত মানুষের লাশ।যারা বেঁচে ছিলেন তাঁরাও জন্য মৃত্যুর সময় গুনছিলেন।দেশের এই অবস্থা দেখে নিজেকে আর ঘরে আটকে রাখতে পারেননি মানুষটা।সিদ্ধান্ত নিলেন যুদ্ধে যাবে সে! তাঁর জবানিতে-
“একাত্তরে ২৫ মার্চের পর সারা শহরে কারফিউ। আর্মিদের জ্বালায় থাকতে পারতাম না। পালিয়ে থাকতাম। বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম,এভাবে নয়। মরলে যুদ্ধ করেই মরব। সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম, ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নেবো। যুদ্ধ করব। যে যার মতো চলে গেল। আমি যেদিন গেলাম, সেদিন আমার সঙ্গে ছিল দুই বন্ধু শাফি আর কচি। বেলা সাড়ে ১১টা। মাকে গিয়ে বললাম, ‘মা, যুদ্ধে যেতে চাই।’ মা বললেন, ‘ঠিক আছে, তোর বাবাকে বল। কাঁপতে কাঁপতে গেলাম বাবার সামনে। মাথা নিচু করে বললাম, আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। চিন্তা করলাম, এই বুঝি লাথি বা থাপ্পড় দেবেন। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে, যুদ্ধে যাইবা ভালো কথা। দেশ স্বাধীন না কইরা ঘরে ফিরতে পারবা না”।
এরপরে আর পেছনে ফিরে তাকান নি তিনি।পায়ে হেঁটে রওনা হন আগরতলার পথে।সেখানে তাঁর সঙ্গী হন তাঁর দুই বন্ধু। লক্ষ্য ছিল যেভাবেই হোক সেক্টর ২ এ খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধে যোগদান করা।অবশেষে লক্ষ্য পূরণ হল তাঁর। পৌঁছে যান মেলাঘরে,খালেদ মোশাররফের কাছে।সেখানে আরো অসংখ্য আরবান গেরিলার সাথে তিনিও ট্রেনিং নেন। তাঁর অস্ত্র শিক্ষার ট্রেনার ছিল রুমি। হ্যাঁ, বিস্ময়ের কিছু নেই। এই রুমি সেই রুমি-ই, আম্মা জাহানারা ইমামের ছেলে। রুমি ছিল অস্ত্রচালনায় সবচেয়ে দক্ষ। এলএমজি, রাইফেল সবকিছু চালনাই রুমির কাছ থেকে শিখেছিলেন তিনি।মেলাঘর থেকে অপারেশনে ঢাকায় ফিরে আম্মার কাছে এই লোকটির গানের বেশ প্রশংসাও করেছিলেন রুমি।“একাত্তরের দিনগুলি” থেকে সেই লাইনগুলো হুবুহু তুলে দিচ্ছি-
“জানো আম্মা,ওখানে তো সন্ধ্যে সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যেই খাওয়া দাওয়া হয়ে যায়।সারাদিন প্রচণ্ড খাটনিতে সবাই এতো টায়ার্ড থেকে যে আটটা নয়টার মধ্যেই বেশি ভাগ ছেলে ঘুমিয়ে যায়।দু’ একটা তাঁবুতে হয়তো কেউ কেউ আরও খানিকক্ষণ জেগে গান টান গায় কিংবা আড্ডা দেয়। সে রাতে টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে কি,একটা তাঁবুতে আলো জ্বলছে,আর সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুরঃ
হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ…”
পাঠক,ধরতে পেরেছেন কি আমি কার কথা বলছি? না ধরতে পারলে চলুন রুমির জবানিতেই জানা যাক-
“বুঝলাম আজম খান গাইছে।আজম খানের সুন্দর গানের গলা।আবার অন্যদিকে ভীষন সাহসী গেরিলা, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা।সেদিন সেইরাতে চারিদিকে ভীষন অন্ধকার,অন্যসব ব্যারাক আর তাঁবুর বাতি নিভিয়ে সবাই ঘুমিয়ে গেছে।ন’টা দশটা মানেই হচ্ছে নিশুতি রাত।ঐ একটা তাঁবুর ভেতর হারিকেনের আলো ছড়িতে সাদা রঙের পুরো তাবুটা যেন ফসফরাসের মতো জ্বলছে।উঁচু থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেন বিশাল সমুদ্রে একটা আলোকিত জাহাজ।আর আজম খানের গানের সুর,মনে হচ্ছিলো যেন চারিদিকে ইথারে ভেসে ভেসে হাজার হাজার মেইল ছড়িয়ে পড়ছে। তখন আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠেছিলো।এই বৃষ্টিঝরা গভীর রাতের অন্ধকারে আমিও যেন দেখতে পাচ্ছিলাম নির্জন টিলার মাঝে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ৩০৩ রাইফেল হাতে সেন্ট্রি ডিউটিতে সমস্ত ইন্দ্রিয় টান করে দাঁড়িয়ে আছে,আর তাঁদের চারপাশ দিয়ে বায়ুমণ্ডলে ভেসে ভেসে যাচ্ছে আজম খানের উদাত্ত গলার গানঃ
হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ
কেঁপে কেঁপে উঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে,
যে কোলাহলের রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ।
জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।
হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন
জন্ম নিয়েছে সচেতনতার ধান
গত অকালের মৃত্যুকে মুছে
আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ।
……………………………….
শাবাশ বাংলাদেশ,এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়!
জ্বলে পুড়ে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়…”
এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কার কথা বলছিলাম।হ্যাঁ, আমি আজম খানের কথা বলছিলাম।আমি মুক্তিযোদ্ধা আজম খানের কথা বলছিলাম।তিনি শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধাই নন, তিনি মহাগুরু,কিংবদন্তী,পপসম্রাট আজম খান…
(আজ এ পর্যন্তই। পরবর্তী পর্বে তুলে ধরবো তাঁর দুর্দান্ত সব অভিযানের কথা)
৯টি মন্তব্য
মেহেরী তাজ
খুব উৎসাহ নিয়েই পড়লাম। ভালো লাগলো।
পরের পর্বের অপেক্ষাই রইলাম।
ফাতেমা জোহরা
ধন্যবাদ আপু -{@
জিসান শা ইকরাম
গুরু সম্পর্কে বেশ কিছু অজানা তথ্য জানলাম।
আরো জানার অপেক্ষায় আছি………
ফাতেমা জোহরা
শীঘ্রই পরবর্তী পর্ব দিবো 🙂
খসড়া
আমার প্রিয় শিল্পি।
ফাতেমা জোহরা
🙂 🙂 🙂
শুন্য শুন্যালয়
উঁচু থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেন বিশাল সমুদ্রে একটা আলোকিত জাহাজ।আর আজম খানের গানের সুর,মনে হচ্ছিলো যেন চারিদিকে ইথারে ভেসে ভেসে হাজার হাজার মেইল ছড়িয়ে পড়ছে,………… গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। দিব্যি যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, আর অনুভব করতে পারছি গানের টিউনগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এমন অসাধারণ সব অজানা শেয়ারের জন্য।
ফাতেমা জোহরা
আপনাদের জন্যই লেখা। ধন্যবাদ আপু (3
খেয়ালী মেয়ে
আজম খান সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা হলো এই পোস্টের মাধ্যমে–অনেক ধন্যবাদ আপনাকে..