মাহবুবুল আলম //

সাম্প্রতিক সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক কিছু এ্যানকাউন্টার বা ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে সারা দেশে আলোচনা সমালোচনা চলছে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ক্রসফায়ারের ব্যাপারে মানবাধিকার সংগঠন, মানবাধিকার কর্মী, সংবাদপত্র, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মহল প্রতিবাদে ব্যাপক সমালোচনা মুখর। দেশের ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংঘঠন এ হত্যাকান্ডের ঘটনাকে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড দাবি করে তা অচিরেই বন্ধের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তবে বিচার বহির্ভূত হক্যান্ডকে বন্দুকযুদ্ধ, এনকাউন্টার বা ক্রসফায়ার যে নামে অভিহিত করি না কেন এ নিয়ে যেমন উদ্বেগ আছে, তেমনি দেশে অব্যাহতভাবে হত্যা, গুম সন্ত্রাস, জঙ্গীদের আড়ালে একটি বিশেষ রাজনৈতি পক্ষের গুপ্তহত্যায় অতিষ্ঠ বিপুল সংখ্যক মানুষ এখন বিচারবহির্ভূত হক্যাকান্ডের পক্ষেও অবস্থান নিতে শুরু করেছে তা যে নামেই হোক না।

যারা নিয়মিত বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্রাউজ করেন, তারা নিশ্চয় এতদসংক্রান্ত পোষ্ট বা মন্তব্য অবলোকন করে থাকবেন।  আমার এ বক্তব্যের সাথে অনেকটাই প্রাসঙ্গিক ভেবে ভূ-রাজনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার এর (২৬ জুন, ২০১৬) দৈনিক জনকন্ঠের চতুরঙ্গ পাতায় “ ক্রসফায়ার বিতর্ক” শিরোনামের প্রকাশিত নিবন্ধের একটি অংশ এখানে উদ্বৃতি করছি। তিনি ওই নিবন্ধে বলেছেন, “ ২০১৫ সালের প্রথম দিকে এক নাগাড়ে ৯২ দিন অবরোধের নামে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে প্রায় দেড় শ’ মানুষকে নিদারুণ অমানবিকভাবে হত্যা করা হয়। এটা স্বল্প সময়ের মধ্যে এযাবতকালের সর্বোচ্চসংখ্যক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড। সুতরাং শুধুমাত্র ক্রসফায়ারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডে ভয়াবহতা সঠিকভাবে চিত্রিত হয় না এবং ক্রসফায়ারও তার সত্যিকার অর্থ হারায়। ক্রসফায়ার নতুন কোন বিষয় নয়, সব ক্রসফায়ারই বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নয়। যেদিন থেকে আগ্নেয়াস্ত্রের সৃষ্টি হয়েছে সেদিন থেকে ক্রসফায়ারের বিষয়টি ঘটে চলেছে। অস্ত্রের সঙ্গে সংঘর্ষের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পক্ষ-বিপক্ষ উভয়ের হাতে যখন আগ্নেয়াস্ত্র তখন অস্ত্রের সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী। রাষ্ট্রীয় বাহিনী যখন অস্ত্র ব্যবহার করে তখন কোন্টি বৈধ, আর কোন্টি বৈধ নয় তা বিচার্য হয় পরিস্থিতির ওপর এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় আইনসিদ্ধভাবে অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে কিনা তার ওপর। সুতরাং অস্ত্রের ব্যবহার মানেই সেটা আইনবিরুদ্ধ নয়। বাংলাদেশের জঙ্গীদের কাছে আধুনিক অস্ত্র রয়েছে এবং পুলিশ ও জঙ্গীদের মধ্যে সংঘর্ষের সচিত্র প্রতিবেদন বহুবার দেখা গেছে। সংঘর্ষে দুই পক্ষেরই যে কোন ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে এবং অস্ত্রের কার্যকরী দূরত্বের ওপর নির্ভর করে তাতে কাছে বা দূরের তৃতীয় পক্ষের কেউ নিহত-আহত হতে পারে। তাই কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাছবিচার ব্যতিরেকে ঢালাওভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগ তোলা হলে জননিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।”

যাক এ বিষয়ে আরও একজন বিজ্ঞ লেখকের একটি লেখার কিছু অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি। আজ একটি সহযোগী দৈনিকে প্রকাশিত জনাব এ কে এম এ হামিদ এর লেখাটি প্রকাশিত হয়,  তার নিবন্ধে বিষয়ে তিনি একটি যুক্তি দিয়েছেন, এটিও আমার লেখার সাথে প্রাসঙ্গিক মনে করেই এখানে উদ্বৃত করেছি। তিনি বলেছেন,‘বাংলাদেশের জননিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি আজ ধর্মান্ধ উগ্র জঙ্গী গোষ্ঠী। এই জঙ্গীরা সম্প্রতি নারীসহ নিরপরাধ-নিরীহ মানুষকে যেভাবে হত্যা করছে তাতে তারা বর্র্বরতারও সকল সীমা লঙ্ঘন করছে। তাদের আর মানব সন্তান বলা যায় না, তারা দানব ও দানবীয় শক্তির প্রতিনিধি। সুতরাং দানবের জন্য কোন রকম মানবিক বিবেচনা প্রযোজ্য হতে পারে না। মানবতাকে রক্ষা করার জন্য এদের কঠিনহস্তে নিষ্ঠুরভাবে দমন ও নির্মূল করা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে বাস্তবতা বড় কঠিন ও বিচিত্র। এই জঙ্গী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার জায়গায় রয়েছে অনেক ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক পক্ষ, তারা সকলেই আবার অন্য বড় রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে জোটসূত্রে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ। সুতরাং জঙ্গীদের রাজনৈতিক পক্ষ ও তার মিত্ররা জঙ্গীদের সম্পর্কে রাজনৈতিক বক্তব্য দেবে, জঙ্গীদের ব্যবহার করে, রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করতে চাইবে এবং এসবের জন্য নানা অজুহাত ও ছদ্মবেশে জঙ্গীদের আড়াল করার চেষ্টা করবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই কারা জঙ্গী, কোথায় তার উৎপত্তিস্থল, সব অকাট্যভাবে দেশের উচ্চ আদালতে প্রমাণিত হওয়ার পরেও রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য মিথ্যাচারের মাধ্যমে, এখনও আবার মিথ্যা সত্যের সঙ্গে মিশ্রিত করে ওই সব রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও তাদের সুবিধাভোগীরা অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও তাদের মিত্র পক্ষ দীর্ঘ দিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল। সঙ্গত কারণেই সে সময়ে এই জঙ্গীদের মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী পুলিশসহ রাষ্ট্রের সকল অঙ্গনে ঢুকেছে। তারা ঘাপটি মেরে থাকলেও সুযোগ মতো জঙ্গীদের যে সহযোগিতা করছে না, তাও তো ভাবা যাচ্ছে না। সুতরাং কোথা থেকে কি হচ্ছে তা সব সময় বলাও কঠিন। ক্রসফায়ার নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে পুলিশের অপেশাদারিত্বের সুযোগে পশ্চিমা বিশ্বের টাকায় পুষ্ট কিছু এনজিও কর্তারও সব সময় মাঠে দেখা যায়।” শিকদার সাহেব ও এর মাধ্যমে কি বোঝাতে চাইছেন বিজ্ঞলোকেরা নিশ্চয়ই অনধাবন করতে পারবেন।

যাক সেদিকে আর না গিয়ে মূল কথায় ফিরে আছি। ক্রসফায়ার বন্দুকযুদ্ধ বা এ্যানকাউন্টার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত খুঁজতে গিয়ে একটি দৈনিকের ২০ জুন সংখ্যার এক এ পরিসংখ্যান খুঁজে পাই।  তাতে দেখা যায় ২০০৪ থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে, অর্থাৎ গত ১২ বছরে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা হলো এক হাজার ৭১৫। । প্রদত্ত ‘২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধ কমলেও গুমের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ সময়ে ২৯১ জন নিখোঁজ হন।’ সংবাদপত্র বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষ্ঠান ও মানবাধিকার সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৪ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ক্রসফায়ারে মারা গেছে ৬৯৩ জন। ২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ক্রসফায়ারে মারা গেছে ২১৬ জন। এর মধ্যে বিগত ২০১৩ সালে ক্রসফায়ারে মারা গেছে ৭২ জন।

সে হিসেবে ক্রসফায়ার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে এমন ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়ে আসছে।  আমাদের পার্শবর্তী দেশ ভারতে এমন হত্যাকান্ডকে বলে এনকাউন্টার। বাংলাদেশে কখনো বন্দুকযুদ্ধ বা কখনো ক্রসফায়ার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটাকে বলা হয় Justifiable Homicide বা বিধিবদ্ধ হত্যা। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর Justifiable Homicide বা বিধিবদ্ধ হত্যাকান্ডে প্রায় চার শ’ থেকে সাড়ে চার শ’ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। গণতন্ত্র মানবাধিকারের মডেল স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতেও প্রতি বছর বহুসংখ্যক ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটে থাকে।

এ পর্যায়ে এ ক্রসফায়ার শব্দটি কবে থেকে এবং কিভাবে আমাদের অভিধান বা ক্ষমতার রাজনীতির সংস্কৃতিতে যুক্ত হলো তার ওপর কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। ইংরেজিতে একটি কথা আছে ‘Act of the god’ বাংলায় যার সোজাসাপ্টা অর্থ দাঁড়ায় ‘বিধির বিধান’। কেননা, ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে তথাকথিত সন্ত্রাস দমনের আড়ালে বিরুদ্ধ রাজনৈতিক মতাদর্শের বিশেষ করে আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করার জন্য গঠন করে এ্যলিট ফোর্স RAB। RAB গঠন করে ২০০৪ সাল থেকেই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার শুরু করে ‘ক্রসফায়ার’। সে হিসেবে দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে ক্রসফায়ার শব্দটি প্রথম পরিচিতি করেছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় থেকে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার জাতীয় সংসদে ২০০৩ সালের ৭ জুলাই আর্মড ব্যাটালিয়ন সংশোধন আইন, ‘২০০৩ সংশোধন করে পাস করে। RAB-কে আইনের আওতায় আনে। এর সংক্ষিপ্ত নামকরণ করা হয় RAB। পুলিশ বাহিনীর এটা একটি ব্যাটালিয়ন। সেনাবাহিনীসহ সব বাহিনী থেকে কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্তদের প্রেষণে এনে বা চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে।

RAB গঠনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পর জোট সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে দেশব্যাপী ক্লিনহার্ট অভিযান পরিচালনা করে। সেই ক্লিনহার্ট অপারেশনে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর ক্যাম্পে ধরে নেয়ার পর নির্মম নির্যাতনে যারা মারা গেছে তাদের হার্টফেল করে মারা গেছে অভিহিত করা হতো। সুরতহাল রিপোর্ট, ময়নাতদন্ত রিপোর্টে নির্মম নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়ার উল্লেখ থাকার পরও তাকে হত্যাকান্ড না বলে হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছে বলে চালিয়ে দেয়া হতো। উপরন্তু তখন পবিত্র জাতীয় সংসদে এ ধরনের হত্যাকান্ডের ঘটনাকে দায়মুক্তি দেয়ার জন্য ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স পাস করিয়ে নিয়ে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটনার সংস্কৃতি প্রথম চালু করে। ক্লিনহার্ট অভিযানের সমাপ্তির পর বিএনপি-জামায়াত জোট গঠন করে এ্যালিট ফোর্স RAB। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে RAB-এর অভিযানে যারা নিহত হয়েছে, তাদের বলা হতো ক্রসফায়ারে মারা গেছে। দেশ-বিদেশে মানবাধিকার সংস্থাসহ রাজনৈতিক মহল বিচার বহির্ভূত এই হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোর কারণে ক্রসফায়ার শব্দটির পরিবর্তে কিছুদিন এ্যাকাউন্টার নাম দেয়া হয়। ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারে যারা মারা গেছে তাদের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেয়া হতো তাতে বন্দুকযুদ্ধের শব্দটিও উল্লেখ থাকতে দেখা গেছে।

এভাবেই ক্রসফায়ারের যে গল্পটি আমরা শুনে আসছি সেইভাবেই ভাঙ্গারেকের্ডের মতো এখনো পরিবেশন করা হচ্ছে। যেমন র‌্যাব বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রথমে কাউকে গ্রেফতার বা আটক করে। তারপর তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে যায়। যাকে গ্রেফতার বা আটক করা হয়েছে তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গেলে তার সহযোগীরা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। আসামি ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ হয়। বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে গ্রেফতার বা আটক হওয়া ব্যক্তি নিহত হয়। অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার দেখানো হয়। কোন কোন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও আহত হওয়ার খবর দেয়া হয়। সব ঘটনাই ঘটে রাতের আঁধারে। পরের দিন প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয় অমুক ব্যক্তি সন্ত্রাসী, তার বিরুদ্ধে এতটি মামলা আছে, অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের সময়ে তার সহযোগীরা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টাকালে ক্রসফায়ারে মারা গেছে। গত ১৩ বছর ধরে এভাবে ক্রসফায়ার গল্প চলছেই। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ ক্রসফায়ারের ব্যাপারে একটি বই পর্যন্ত লিখে গেছেন। বইয়ের নাম ‘হলুদ হিমু কালো র‌্যাব।’ এই বইয়ে কোলের বাচ্চা ছেলেকে র‌্যাবের ক্রসফায়ারের ভয়ের গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর মতো অধ্যায় রয়েছে। এসব ঘটনার সময়কালও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়েই।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল-এর কাছে জানতে চাওয়া হলে বলেছেন, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে পুলিশ কোনো ক্রসফায়ার (বন্দুকযুদ্ধ) করেনি। আত্মরক্ষার্থে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।’ ২৫ জুন ২০১৬ তার বাসভবনে সাংবাদিকদের সাথে বন্দুকযুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি এ কথা বলেন তিনি আরও বলেন, ‘কোনো ক্রসফায়ার আমাদের পুলিশ করেনি। বরং আত্মরক্ষা করতে কিংবা আসামি ধরতে গিয়ে এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটেছে।’ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তাদের সময়ে ক্রসফায়ারের ঘটনা স্বীকার করেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আত্মরক্ষার্থে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে বা ক্রসফায়ারে নিহতের ঘটনার কথা বলেছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের এই একটি বিষয়ে অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ সরকারও বলছে, ক্রসফায়ারে কোন লোকজন মারা যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আত্মরক্ষার্থে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের ঘটনায় নিহত হওয়ার ঘটনা বলে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারও। এমনকি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীসহ নীতিনির্ধারক মহলও ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। তারপরও ক্রসফায়ার কিভাবে কার নির্দেশে কেমন করে অব্যাহত আছে কেউই সঠিকভাবে বলতে পারেন না।

আমার কথা হলো আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র বা বল প্রয়োগ করার বিষয়টি আমাদের দণ্ডবিধিতে স্বীকৃত। আমাদের দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্রের ব্যবহারের ওপর সিআরপিসিতে স্পষ্টভাবে  বিধি লিপিবদ্ধ আছে। পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল ১৯৪১, অনুসারে ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটার পর প্রতিটির বেলায় ম্যাজিস্ট্রিয়াল বা বিচারিক তদন্ত হওয়ার কথা এবং হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু সে বিধি কখন কোথায় কতটুকু মানা হচ্ছে তাই দেখার বিষয়। তবে এ অধিকারও সংশ্লিষ্ট আইনি ধারায় অনিয়ন্ত্রিত নয়। এ ক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ন্ত্রণ হলো গুলি অথবা অন্য ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে, যার অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। অর্থাৎ লাগামহীন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে না। এ বিষয়টি একমাত্র নিরপেক্ষ তদন্তই সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারবে। যেকোনো বন্দুকধারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি ও দণ্ডবিধি ছাড়াও প্রতি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণমূলক আইন রয়েছে। এসব আইন ও যেসব ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি ও দণ্ডবিধি প্রযোজ্য তা যদি একেবারেই কার্যকর করা না হয়, তাহলে আইনের শাসন ব্যাহত হয়।

শেষ করবো এই বলেই যে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধ সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়, প্রতিটির ভিন্ন সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড হলো- সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে অকারণ পরিস্থিতিতে কাউকে হত্যা করা, যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও বেআইনী। এটা জননিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর। একজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলাও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড। আর রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে শত শত মানুষকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে হত্যা করা বা বা পুড়িয়ে মারা এসবওতো তা হলো বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের সংজ্ঞায় পড়ে। আজকে যারা বিচার বহির্ভূত হত্যান্ড নিয়ে এত কথা বলছেন, তারা কী রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে শত শত মানুষকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে হত্যা করা বা বা পুড়িয়ে মারার বিষয়ে এক সোচ্চার হয়েছিলেন। কই আমারতো তেমন মনে পড়েনা। হয়তো আমার স্মৃতিই আমাকে বিভ্রান্ত করছে!

৫৪৪জন ৫৪২জন
0 Shares

৩টি মন্তব্য

  • মোহাম্মদ আয়নাল হক

    দেশ আজ কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। একটি স্বাধীন দেশে নেই কোনো নিরাপত্তা নেই কোনো মানুষের জীবনের মুল্য প্রতি নিয়ত ঘটে যাচ্ছে হত্যা ঘুম। কিসের আলামত পাচ্ছি নাকি আমরা সেই আদি যোগে ফিরে যাচ্ছি। যে যুগে প্রতি নিয়ত হত্যা রাহাজানি ধর্ষন অবিরত ছিলো।এটাতো সভ্য ও আধুনিক যোগ তাহলে কেনো এমন হচ্ছে প্রতিনিয়ত।নাকি অন্য কোনো অদৃশ্য অশুভ ছায়া কাজ করে যাচ্ছে এই সোনালী বাংলাদেশ কে ঘ্রাস করে খাবার জন্য। যারা দেশ ও দেশের সাধারন জনগন কে নিরাপত্তা দেবার কথা আজ তারাই প্রতি নিয়ত করে যাচ্ছে অন্যায় অবিচার খুন হত্যার মত জঘন্য অপরাধ।

  • আবু খায়ের আনিছ

    ক্রসফায়ার নাকি বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড এর তদন্ত হলেই ত সব বের হয়ে আসে। তদন্ত এর কথা বললে ত আরেক ভয় ঢুকে যায়, তদন্ত এর ফলাফল পাওয়া যাবে তো?
    স্বাভাবিক ভাবেই কোথাও বন্ধুক যুদ্ধ হলে আশেপাশের মানুষ জানতে পারে, আবার নিধার্রিত স্থানেই সঙ্গীরা আত্মগোপন করে থাকবে এটা কি করে হতে পারে?
    বিষয়টা যত সহজ ভাবা হয় ততটা সহজ কি আদৌ?

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ