এলোমেলো ভাবনায় আমার স্কুল

সাজেদুল হক ২১ জুলাই ২০২০, মঙ্গলবার, ০৮:৩১:২২অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১৩ মন্তব্য

আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি বৃষ্টি। সকালের এই বৃষ্টি আলসেমিতে পেয়ে বসে।বিছানা ছাড়তে ইচ্ছা করে না।আড়মোড়া দিয়ে এপাশ ওপাশ করে শুয়ে থাকতেই ভালো লাগে।যারা লেখা লেখি করেন তাদের কাছে বর্ষা এক অসাধারণ মূহুর্ত।এমন কি যারা আমার মতো এক আধটু লিখেন তাদেরও। মনের আনন্দে লেখালেখি।কিন্তু এখন পরিবেশ এতো স্থবির সবকিছু যেন স্তব্ধতার ভিতর আছে। থমকে আছে সব।হ্যাঙ্গারে রাখা শার্টের মতো ঝুলে থাকা।কাজে লাগলে ব্যবহার নচেৎ ঝুলে থাকা।

বৈরী সময় পুরনো স্মৃতিকে মনে করিয়ে দেয়।এসব স্মৃতি খুব প্রবল ভাবে নাড়িয়ে দেয়।ধ্যানমগ্ন করে। একটি মাত্র রাস্তা দিয়ে হাজারো গন্ত্যবে ছুটে চলে মন।

তখন শ্রীমঙ্গলে,সুরভী পাড়ায় থাকা।ব্র‍্যাকের এ্যাগ্রো ফরেষ্টিতে কাজ করার সুবাদে। তাছাড়াও শ্রীমঙ্গলের সঙ্গে সখ্যতা বহুদিনের। ছেলেবেলায় এশহর থেকে ওশহর ঘুরে বেড়ানো। বাবার বদলীর চাকুরির সুবাদে। জীবনের প্রথম স্কুলিং এই শ্রীমঙ্গলে। পরে কিছু দিন কমলগঞ্জের সদরে। তারপর ভানুগাছ এলাকার কোনো এক টিলায়।টিলা হলেও পাহাড়। আমার কাছে তো বটেই।উঁচু-নীচু টিলা ঘেরা ভানুগাছ। যেন স্বপ্নমাখা অসাধারণ এক জায়গা।

কমলগঞ্জে থাকতেই ভানুগাছের কোনও টিলার উপর এক বাগানবাড়ি (বাগান সহ বাড়ি) কিনেন বাবা।একটা জায়গায় মোটামুটি স্থির হতে না হতেই অন্য জায়গায়।খুব কষ্টের বিষয়।খুবই খারাপ লাগে,কিন্তু কিচ্ছুটি করার নেই।

ওখানে যাওয়ার পরে অবশ্য ভালো লাগা শুরু হলো।বিশাল এলাকা নিয়ে বাড়ি।হাজারো রকমের গাছগাছালির সমাবেশ।খুবই প্রাকৃতিক এবং অপার সৌন্দর্যের।কাঁঠাল,আম,পেয়ারা,আনারস সহ আরও হাজারো গাছ।ওষধি গাছের ও অভাব নেই।

সমস্যা হলো পানির। টিলা থেকে নেমে সমতলে একটা কূয়া।প্রতিদিন ওখান থেকেই পানি উঠাতে হয়।এছাড়া ভালোই কাটে সময়।খুব সকালে টিলারই এক মক্তবে হুজুরের কাছে পড়া। তা শেষ করে খেয়ে দেয়ে আবার স্কুল। স্কুলটি টিলা থেকে বেশ খানিকটা দূরে। মাইল দেড়/দুই তো হবেই।টিলার খাদে সমতলে। টিলার কয়েক জন একত্রে স্কুলে যাই এবং আবার একত্রেই ফিরি।

ওখানে সব’চে প্রিয় বন্ধু নামটা সুবল।বাবা নেই,ভাইয়ের সাথে থাকে।লেখা-পড়া ছাড়া খেলাধুলার সুযোগ নাই। স্কুল থেকে ফিরেই ভাইয়ের কাজে হাত লাগাতে হয়।আর আমার সারা বেলা একা। একা একা মিশি গাছের সঙ্গে। পাখির সঙ্গে। রঙিন প্রজাপতির সঙ্গে।ওরাই বন্ধু হয় একসময়।

যে স্কুলটাতে পড়তাম তার নাম বালিগাঁও ফ্রি প্রাইমারি স্কুল।সমতলে নামার পরেও অনেক পথ হেটে তারপর স্কুল। দু’পাশে ধানক্ষেত। মাঝখানে পথ। মোটামুটি প্রশস্ত।পথটার একটা অংশ পানিতে ডুবে থাকে।পানি স্বচ্ছ ,মাটি দেখা যায়। হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ডুবে যায়।

পানির এ অংশটুকু আসলেই আমাদের ভোঁ দৌড়।কেননা জোঁকের ভয়।আগে পেরুতে পারলেই যেন রক্ষা। আগে যারা পার হয়, স্বচ্ছ পানির কারণে সব দেখা যায়। পরে পানি ঘোলা হয়ে যায়।তাই ভয় বেশি।
ক্ষেত পেরিয়েই রেললাইন।রেললাইনে উঠেই লাইনে  কান পেতে কোনো ট্রেনের আগমন বার্তা শোনা। তারপর   রেললাইন ধরে কিছুদূর যাবার পরে পরে স্কুল।

ধান পাকার মৌসুমে স্কুল থেকে ফেরার পথে সবাই মিলে ধানের ছড়া ভেঙে একত্রে সংগ্রহ করতাম। পরে তা দিয়ে টিলার নিচের এক বৃদ্ধ মহিলার কাছ থেকে ওই ধানের বিনিময়ে মুড়ি নিতাম। আহ্!কতইনা স্বাদ সেই মুড়ির।

তারপর চাকুরি নিয়ে যখন শ্রীমঙ্গল অনেক বার ভেবেছি একবার যাবো স্কুলটার খুঁজে। যাওয়া হয়নি আর।জানি না কেন?যখন চলে এসেছি খুব মনে পড়ছে আবার! হয়তো কোনোদিন শুধু স্কুলটির জন্যই যাবো।যাওয়া হবে।

আরও যেতে ইচ্ছে করবে ছোটবেলার সেই বন্ধুটির খুঁজে। জানি না সে এখন কোথায় আছে,কেমন আছে।যার জন্য এক আজন্ম অপরাধবোধ তাড়িয়ে বেড়ায়। কোনো এক কারণে একবার সুবলের সাথে ঝগড়া হয়।কিভাবে শায়েস্তা করা যায়।মনে মনে ভাবনা সারাক্ষণ স্কুলটি ছিলো বেড়ার তৈরি। উপরে টিন।তিনটে মোটে রুম।কোনো বেঞ্চ নেই। রুমের বেড়া ঘেঁষে চারপাশ দিয়ে তিনটা চেরা সুপারি গাছের কাঠ।নিচে কিছুদূর পর পর বাঁশের খুঁটির সাথে বাঁধা।ওখানে বসেই লেখা-পড়া।

ঝগড়ার কারণে একসময় কথা নেই সুবলের সাথে। হলেও ত্যাড়া ত্যাড়া দু’একটা কথা। একদিন সুযোগ বুঝে তার পেন্সিলটি বসার সিটের নিচে যে বাঁশ তাতে ঢুকিয়ে দিই।ছুটির সময় আর তা খুঁজে পায় না।বেচারার মন খারাপ। চোখ প্রায় ছলছল। স্কুল ছুটি হলে একত্রেই ফিরি টিলায়।

আমাদের বাগানের সামনে দিয়ে কিছুপথ পরে ওরা থাকে।ওখানে এসে সে দাঁড়িয়ে থাকে। যেতে চাচ্ছিল না যেন। মা বাইরেই অপেক্ষায় ছিলো। দেখে এগিয়ে আসে।আমি ভিতরে ঢুকে যাই।সুবলের মন খারাপের বিষয়টি বুঝতে পারে মা।

জানতে চাইলে বলি ওর পেন্সিল হারিয়েছে। কিছু বুঝলো কিনা জানি না। মা বললো,যদি কিছু করে থাকো, দিয়ে দিও।কথাটা শোনার পর থেকে প্রচন্ড পীড়ন শুরু হয়।পরপর দুই দিন স্কুলে যায় না সুবল।অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ে আমার।স্কুলে গিয়ে দেখে রাখি ঠিক ঠাক আছে কিনা পেন্সিলটা। দায়িত্ব বেড়ে যায়। যদি না আবার পেন্সিলটা বেহাত হয়ে যায়।

বিকেলে সুবলের বাড়িতে যাই।ও কাজ করছে।বাঁশের ঝুড়ি বানানোতে ব্যস্ত ভাইয়ের সাথে। কিছু বলে না।অপরাধ বোধ তীব্র হয়।জানতে পারি পেন্সিল হারানোর অপরাধে অনেক মেরেছে তাকে।ফলশ্রুতিতে স্কুল যাওয়াও বন্ধ।কি করবো বুঝে উঠতে পারি না কিছু।

তখন আমার অবস্থা কি ছিলো মনে নেই।কিন্তু এখন যখন লিখছি কষ্টবোধে জর্জরিত হচ্ছি।সুবলের ভাইকে বুঝিয়ে রাজি করাই। কাল থেকে স্কুলে যাবে।আনন্দ হয় আমার।সাথে সুবলেরও।আমি বুঝতে পারি।
স্কুলে যাওয়ার পর থেকেই অস্তিরতা,না পেন্সিলটা ঠিক জায়গাতেই আছে। এখন সুযোগের অপেক্ষা।
অবশেষে দু’জনে মিলে খুঁজে খুঁজে সেটা পাওয়া।আমার খুঁজা তো মিছে মিছে। ফিরে পেয়ে তার কি আনন্দ। সেই থেকে আমাদের বন্ধুত্ব আরও বেড়ে যায়।

যথারীতি আবার একদিন বিদায়ের পালা। পাহাড়ের সে বাগান বাড়ি বিক্রি করে চলে আসছি।বিদায়ের বেলায় সুবল আমাকে জড়িয়ে ধরে। খুব শক্ত করে। আজও টের পাই, বুকের পাঁজর কাঁপানো সেই জড়িয়ে ধরা। তারপর কোনো যোগাযোগ নাই তার আর আমার।মাঝে মাঝে ওর অনুভব টের পাই। খুব করে।

কিন্তু যে কথাটা কোনদিন তাকে বলা হয়নি,যদি বলতে পারি সে জন্য হয়তো যাবো। সেই স্বপ্নের টিলায়।শৈশবের সেই স্বপ্নের ভানুগাছ।

৫১৫জন ৪৩৭জন
0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ