জন্মের পর থেকে অদ্যাবধি যে ঈদ উদযাপন করে এসেছি, দেখে এসেছি, এবারের ঈদ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার দিনগুলোও ছিল অন্য সকল রমজান মাসের চেয়ে ভিন্ন, যা ইতিহাসের পাতায় করুণ এক বিষাদের গল্প হয়ে লেখা থাকবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে। আর আমরা হয়ে রইলাম বিবর্ণ, বিষণ্ণ এই ঈদ পালনের সাক্ষী। পুরো রমজান মাস কেটে গেলো খুব নিরবে। ছিলনা রেস্তোরাঁগুলোয় ইফতার তৈরির হাঁকডাক, বেচাকেনার হিড়িক। ছিল না মসজিদগুলোয় ইফতারের কোন আয়োজন কিংবা হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে মসজিদ পাণে ছুটে যাওয়া অগণিত মুসল্লির ঢল। দলে দলে তারাবির নামাজ আদায় করার কোন আয়োজনও হয়নি এবার। সবই হয়েছে একান্তে, ঘরোয়া কিংবা পারিবারিক আবহে। প্রতিবার চানরাতে মধ্যরাত অব্দি জ্যাকসন হাইটসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা হতো, দুই হাত ভরে মেহেদি লাগানো হতো, আতশবাজি দেখা হতো। এবারের মহামারীকালীন চানরাতের বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন ছিল যদিও, তবুও কেন যেন প্রতিবারের মতো জ্যাকসন হাইটসে খুব যেতে মন চাইলো। বিদেশ বিভূঁইয়ে এ যে আমার দীর্ঘ পঁচিশ বছরের অভ্যাস! শেষ রমজানের দিন ইফতারের পর অন্যবারের মত গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। থার্টি সেভেন এভিনিউ হয়ে সেভেন্টি থ্রি, ফোর, ফাইভ ষ্ট্রীটগুলো ঘুরলাম। সড়কের ল্যাম্পপোস্ট থেকে নির্গত নিয়ন বাতির লালচে আলোয় কেমন আধো অন্ধকারাচ্ছন্ন এক মনখারাপ করা পরিবেশ বিরাজ করছিল। চারিদিকে খাঁ খাঁ শূন্যতা। কোন জনমানুষ ছিল না। আমার কেবলই মনে পড়ছিল নিকট অতীতের কথা। এই তো গত চানরাতের কথা। কতো মানুষের সরব কোলাহল ছিল চারিদিকে। জমজমাট গান-বাজনা ছিল। রাস্তার দুইপাশে মেহেদির উৎসব ছিল, দুই হাত ভরে মেহেদির আলপনা আঁকা তরুণীদের ভিড় ছিল, ঈদ আনন্দে ভেসে যাওয়া অগনিত মানুষের হেঁটেচলা ছিল। জামাকাপড়, গহনার পশরা ছিল। ছিল দরদাম করে কেনাকাটা করার হিরিক। মনটা সত্যিই বড় বেশি বেদনাবিধুর হয়ে উঠল।
খবরে জানা গিয়েছিল প্রার্থনার স্থানগুলো সম্ভবত উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। আমরা আশাবাদি হয়ে উঠেছিলাম ঈদের নামাজ অন্তত পড়া হবে জমায়াতে। বহুদিন পর বন্ধুদের সাথেও দেখা হবে হয়তো। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি তেমনটি দেখা যায়নি। মসজিদগুলোয় কিংবা খোলা মাঠে স্বল্প সংখ্যক মানুষ শারীরিক দূরত্ব মেনে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। তবে অধিকাংশই বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। এবার সামাজিক নিরাপত্তার কারণে ঘরে ঘরে যেহেতু অতিথিদের আসা-যাওয়ার তোড়জোড় নেই, তাই উপচে পড়া ভিড়ে বাজার করার হিড়িক ছিল না। রান্নার আয়োজনও ছিল সীমিত। অধিকাংশ মানুষ ঈদের কেনাকাটার অর্থ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন মানবিক দিক বিবেচনা করে। এই দুর্দিনে মাতৃভূমির কিছু মানুষের অন্তত কষ্ট লাঘব হোক।
নিউইয়র্কে বসবাসরত বন্ধুদের অনেকেই চেয়েছিলাম ঈদের দিনে অন্তত আমাদের দেখা হোক কোথাও কোন খোলা প্রান্তরে নিরাপদ দূরত্ব অনুসরণ করে। সবারই ছোট ছোট সন্তান। বিধায় সাহস হচ্ছিল না বাইরে বের হতে। কেননা শিশুরা দীর্ঘ প্রায় তিন মাস পরে একে অপরকে দেখবে। একে অন্যের সাথে ছুটোছুটি খেলতে চাইবে, কাছে ঘেঁসতে চাইবে। তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখাটাও কষ্টকর হবে। সকলের মনে আশঙ্কা আর আতঙ্ক ভর করে আছে। নানান দিক বিবেচনায় সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হল সকলের। আমরা একাকি নদীর ধারে নিসর্গের কাছাকাছি সময় কাটালাম। মনোরম সেই নৈসর্গিক পরিবেশে ঈদ উদযাপন করতে আমাদের মতো আরো অনেকেই এলো ঈদের পোশাক পরে। সকলেই শারীরিক দূরত্ব মেনে গল্প করছিল, ছবি তুলছিল। সন্ধ্যার কিছু আগে দুই বন্ধুপরিবারের সাথে দেখা হয়ে গেলো বিশাল নিরিবিলি প্রায় জনশূন্য এক পার্কে। অনেকদিন পর আচমকা প্রিয়জনদের সাথে দেখা হয়ে গেলে ভেতরটায় যেমন আনন্দে খেলে যায়, ঠিক তেমন এক অনুভূতিতে ছুঁয়ে গেলো মন অজান্তেই। কিন্তু আমরা কেউ কাউকে আগের মতো জড়িয়ে ধরলাম না, হ্যান্ডসেক করলাম না, ছবি তুললাম না। সবাই দূরে দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম অচেনা পথিকের মতো। খানিকটা গল্প করলাম স্বল্প পরিচিত কোন আগন্তুকের মতো। যেন আগের সেই হৃদ্যতা, আন্তরিকতা নেই। ক্ষণিক দেখা, কথা বলা শেষে যে যার মতো বাড়ির দিকে ফিরলাম বিষণ্ণ অনুভূতিতে। ফিরতি পথে পুরোটা সময় বিষয়টি যারপরনাই মনখারাপ করালো। মনে হলো, দেখা না হলেই ঢের হতো। আত্মীয় পরিজনহীন এই বিদেশ বিভূঁইয়ে করোনাভাইরাস আমাদের আত্মায় আত্মায় বেঁচে থাকা সম্পর্কগুলোর মাঝেও যেন অদৃশ্য এক দেয়াল তুলে দিয়েছে!
প্যানসিলভেনিয়ায় বসবাসরত আমার এক বন্ধু জানালো, তাদের ওখানেও এবার বড় কোন ঈদ জামায়েত হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে ঘনিষ্ঠ কয়েকটি পরিবার বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে দৈহিক দূরত্ব অনুসরণ করে ঈদের নামাজ আদায় করেছে। কেউ কারো বাড়িতে বেড়াতে যায়নি। কিন্তু অনেক পরিবার একাকি নিজেদের গাড়িতে ঘুরে বেড়িয়েছে। বন্ধু, স্বজনদের বাড়ির সামনে গিয়েছে। গাড়িতে বসেই জানালা দিয়ে দূর থেকে একে অপরের সাথে দেখা করেছে, কুশল বিনিময় করেছে। এমন অভিনব ঈদ কে কবে দেখেছে ? কোথায় হারিয়ে গেলো মানুষের প্রাণচাঞ্চল্য! কোথায় হারালো আমাদের উৎসব-উচ্ছ্বাস! নিউইয়র্কে এবারের ঈদ সত্যিকার অর্থে কারো জন্যেই আনন্দের ছিল না। চারিদিকে অনিশ্চিত আগামির হাতছানি। ঘরে ঘরে স্বজন হারানোর বেদনা। পৃথিবীব্যাপী সাড়ে তিন লাখ প্রাণ হারিয়েছি আমরা কোভিড-১৯ ভাইরাসে। আক্রান্ত পঞ্চাশ লাখ মানুষ। ভয়াবহ এক আতংকের সময় চলছে পৃথিবীতে। এমন বৈরী সময়ে এই যে আমরা বেঁচে আছি, শ্বাস নিচ্ছি পৃথিবীর আলো-বাতাসে, এ-ই আমাদের বড় পাওয়া, আমাদের ঈদ-আনন্দ।
এর অবসানও এক সময় হবে, তখন অন্যেরা হয়তো গল্প করবো সেই সময়ের মানুষগুলো কতোটা নিরিহ ছিল ছোট একটা ভাইরাসের কাছে আমাদের সব সুখ বিকিয়ে দিতে হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা সত্যিই বড় কঠিন।
জীবনে প্রথম এক বিষণ্ণ ঈদ দেখলাম, দেখলো বিশ্ববাসী। যাদের পরিবারের সদস্য প্রাণ হাড়িয়েছেন তাদের কষ্ট আমরা অনুভবও করতে পারবোনা। করোনা চলে যাক, মানুষের মুখে হাসি ফুটুক এটাই কাম্য।
এমন ঈদ কোনোদিন দেখতে হবে তা আমাদের কল্পনারও অতীত ছিলো। ঈদের আনন্দ ছিলোনা কোনো। চানরাতের আনন্দ, তার আগের তারাবির নামাজের পরের কোলাহল, ঈদের দিনের কোলাকুলি সবই এবার অনুপস্থিত এবার। স্বজনদের সাথে দেখা হয়েছে, অথচ কোলাকুলি হয়নি। দুরত্ব মেনে কথা বলা, এসব অসহ্য ছিলো।
নিউ ইয়র্কের ঈদ উদযাপন দেখলাম এই পোস্টের মাধ্যমে।
এমন পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।
বিশ্ববাসী এমন ঈদ প্রথম উদযাপন করলো। আনন্দ হীন, আতঙ্ক গ্রস্ত ঈদ উদযাপন। ঈশ্বর এই দুঃসময় কাটিয়ে আবার নতুন করে বাঁচার উপায় করে দিক এই কামনা করি। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন
১০টি মন্তব্য
সঞ্জয় মালাকার
সত্যি, এক বিষাদের গল্প হয়ে লেখা থাকবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে।
যুক্তরাষ্ট্রে ভালো থাকবেন নিরাপদে থাকবেন সব সময় শুভ কামনা রইল।
সুপায়ন বড়ুয়া
করোনার বিষাক্ত ছোবল
হেনেছে সর্বত্র।
বিশ্ব বিবেক থমকে দাঁড়িয়েছে আজ
তা থেকে মুক্তি চাই
ভাল লাগলো। শুভ কামনা।
কামাল উদ্দিন
এর অবসানও এক সময় হবে, তখন অন্যেরা হয়তো গল্প করবো সেই সময়ের মানুষগুলো কতোটা নিরিহ ছিল ছোট একটা ভাইরাসের কাছে আমাদের সব সুখ বিকিয়ে দিতে হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা সত্যিই বড় কঠিন।
তৌহিদ
জীবনে প্রথম এক বিষণ্ণ ঈদ দেখলাম, দেখলো বিশ্ববাসী। যাদের পরিবারের সদস্য প্রাণ হাড়িয়েছেন তাদের কষ্ট আমরা অনুভবও করতে পারবোনা। করোনা চলে যাক, মানুষের মুখে হাসি ফুটুক এটাই কাম্য।
ভালো থাকুন আপু।
জিসান শা ইকরাম
এমন ঈদ কোনোদিন দেখতে হবে তা আমাদের কল্পনারও অতীত ছিলো। ঈদের আনন্দ ছিলোনা কোনো। চানরাতের আনন্দ, তার আগের তারাবির নামাজের পরের কোলাহল, ঈদের দিনের কোলাকুলি সবই এবার অনুপস্থিত এবার। স্বজনদের সাথে দেখা হয়েছে, অথচ কোলাকুলি হয়নি। দুরত্ব মেনে কথা বলা, এসব অসহ্য ছিলো।
নিউ ইয়র্কের ঈদ উদযাপন দেখলাম এই পোস্টের মাধ্যমে।
এমন পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।
শুভ কামনা দিদি ভাই।
হালিম নজরুল
এমন ইদ যেন আর কোনদিন না আসে।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
বিশ্ববাসী এমন ঈদ প্রথম উদযাপন করলো। আনন্দ হীন, আতঙ্ক গ্রস্ত ঈদ উদযাপন। ঈশ্বর এই দুঃসময় কাটিয়ে আবার নতুন করে বাঁচার উপায় করে দিক এই কামনা করি। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন
ফয়জুল মহী
ভালোবাসা ও শুভ কামনা।
আরজু মুক্তা
ঈদ কেনো?
বেঁচে আছি এটাই বিস্ময়।
ইসিয়াক
সত্যি এমন ইদ আসেনি আগে। আর যেন আসে না কোনদিন সেই কামনা রইলো।
করোনা মুক্ত হোক পৃথিবী।