পার্ক এভিনিউ, মেডিসন এভিনিউ পার হয়ে হেঁটেই যাচ্ছি এই তুষারপাতের সকালে। পাশ দিয়ে শাঁ করে চলে যায় একটি গাড়ী আমায় সতর্ক করে দিয়ে। এমন বিচ্ছিন্ন হাঁটাহাঁটির চেয়ে স্টারবাক্সে ঢুকি। মোটামুটি মানুষজনে পরিপূর্ণ। সবাই চুপচাপ ব্রেকফাস্ট সারছে। পাশাপাশি ওয়াই ফাই সুবিধা থাকাতে কেউ ফোনে, কেউ ল্যাপটপে নিমগ্ন। সুন্সান নীরব, যেন জনমানব শুন্য। এই সুশৃঙ্খল নীরবতাটুকু ভাল লাগে। এক কর্নারের খালি টেবিলটিতে বসি। বাইরের তুষারপাত দেখি। রাস্তার দু’ধারে পার্ক করা সারি সারি গাড়ীগুলো যেন সাদা তুলায় ঢেকে আছে। মানুষগুলোর দিন শুরুর ব্যস্ততা। তুষারপাতেও থেমে নেই কিছু। শুধু অনেক অনেক দিন পর আমার ক্ষণিক সময় হলো… কারো আদেশ, উপদেশ, অনুরোধ বিহীন একান্ত সময় !
কফির কাপ হতে বাস্প উঠছে ঊর্ধ্বমুখী। যেন গরম ভাপা পিঠা থেকে উঠে আসা ধোঁয়া কিংবা ফুঁ দিয়ে দিয়ে আগুন জ্বালানো মাটির চুলা থেকে উঠে আসা ধোঁয়া। সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মাঝে ভেসে বেড়ায় কিছু প্রিয় মুখ। শেষবার দেখা দাদুর মুখ, যিনি আমায় বিদায় দিতে লাঠি ভর করে গাঁয়ের সরু রাস্তার শেষ অবধি এসে অশ্রুজলে দাঁড়িয়েছিলেন… ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন দৃষ্টিসীমায় আমি মিলিয়ে না যাওয়া অবধি। শেষবার দেখা নানুর মুখ, যিনি আমায় বিদায় দিতে দীর্ঘক্ষণ পাঁচতলার ব্যালকণিতে দাঁড়িয়েছিলেন… ঠায় দাঁড়িয়ে আঁচলে চোখ মুছেছেন আমি অন্য সুউচ্চ দালানগুলোর আড়ালে হারিয়ে না যাওয়া অবধি। ভেসে উঠা মুখগুলো বাস্পের সাথে ঊর্ধ্বমুখী হতে হতে মিলিয়ে গেল একে একে…ধীরে ধীরে…
ঘড়িতে বারোটা বাজ্তে এখনো তিরিশ মিনিট বাকী। ছেলেকে আন্তে যাবার সময় হয়ে এলো। আজ সে হান্টার কলেজ হাইস্কুলে এডমিশন টেস্ট দিচ্ছে। আড়াই হাজার ছাত্র-ছাত্রী’র অভিভাবকগন ভাগে ভাগে ক্যাফেটেরিয়া, জিমনেশিয়াম, অডিটোরিয়ামে অপেক্ষারত। এখানেও সুন্সান নিরবতায় সুশৃঙ্খল অপেক্ষা সবার। স্পীকারে এনাউন্স হচ্ছে… রুম তিনশো পনেরো’র ছাত্র-ছাত্রীরা বেরুবে এখন। হাসিমুখে অনেকের সাথে বেরিয়ে এলো রিয়াসাত। আর দশটা বাঙালী মায়ের মতন আমিও ওকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে করতে ছুটি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। আবার হয়তো অনেক অনেক দিন পর কোন একদিন এমন একটু সময় হবে… নিজের একান্ত সময় !
## প্রবাস মানে,হাজারো ব্যস্ততার মাঝে অনুভূতিপ্রবণ আর স্মৃতিকাতর মন
প্রবাস মানে, শত ব্যস্ততার মাঝেও হটাৎ হটাৎ অদ্ভুত বিষণ্ণতার ঘোর ।
২২টি মন্তব্য
মেহেরী তাজ
নিজের একান্ত সময়……
ভালো গেছে। তবে আপনার ছেলের রেজাল্ট টা বললে ও পারতেন।
প্রবাস জীবনে ব্যস্ততার সমপরিমাণ আনন্দ থাকুক আপু।
রিমি রুম্মান
কেবল পরীক্ষা দিলো সে। রেজাল্ট দিতে সময় লাগবে। জানাবো যা-ই হোক না কেন। ভাল থাকবেন।
ব্লগার সজীব
নিজের জন্য একান্ত সময় আসলেই প্রয়োজন,নিজেকে উপলব্ধি করার জন্য। যদিও সে সময়টুকুর বড্ড অভাব আমাদের।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। ধন্যবাদ অশেষ ।
মরুভূমির জলদস্যু
আপনার লেখা পড়লে মনে হয় আপনার সাথেই বুঝি ছিলাম ঘটনা প্রবাহের সময়।
রিমি রুম্মান
আপনি আমার লেখা হৃদয় দিয়ে পড়েছেন বলেই এমনটি মনে হচ্ছে। এটাই একজন লেখকের বড় পাওয়া। অনেক ধন্যবাদ ।
বনলতা সেন
কত সহজ সাবলীলতায় আপনার বিষণ্নতা আমাদের ও ছুঁয়ে যায়।
রিমি রুম্মান
ব্যস্ততায় অনেক কিছুই মনে করবার সময় হয়না প্রবাসীদের। তবে এক মুহূর্তের একান্ত সময়গুলোতে চট করে ফিরে যাই পেছনের কালে নিজের অজান্তে।
খেয়ালী মেয়ে
হাজারো ব্যস্ততার মাঝে হঠাৎ করেই প্রিয়মুখগুলো ভেসে উঠে চোখের সামনে, দিয়ে যায় একটু প্রশান্তি, সেই সাথে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস–এভাবেই কেটে যায় সময়, হয়তো জীবনও..
রিমি রুম্মান
এভাবেই জীবন এগোয় সমাপ্তির দিকে… ভাল থাকুন।
স্বপ্ন
এতো ব্যস্ত জীবনে নিজের জন্য একান্ত সময় পাওয়া কঠিন আজকাল।ভালো থাকবেন আপু।
রিমি রুম্মান
এই যে পেয়ে গেলাম হঠাৎ। অতঃপর লিখে ফেললাম ভাবনাগুলো। শেয়ার করলাম বন্ধুদের সাথে। এভাবে আবার হয়তো অনেক অনেক দিন পর আবার যদি পেয়ে যাই এমন কিছু সময়, লিখে ফেলবো সেই সময়কার ভাবনাগুলো আমার সোনেলার বন্ধুদের জন্যে।
লীলাবতী
নিজের একান্ত সময়ে কত কি যে চলে আসে মনে,এত কিছু স্মৃতিতে থাকে চিন্তাই করাই যায়না।
রিমি রুম্মান
একান্ত সময়ের ভাবনাগুলোর কোন আগামাথা থাকে না। ভাল থাকুন। শুভকামনা।
নওশিন মিশু
আপনার বিষণ্নতা খুব ছুঁয়ে গেল আমাকে। ভাল থাকবেন….
রিমি রুম্মান
যারা একবার চলে গেলো , তাঁরা তো আর ফিরবেনা। তাদের সাথের স্মৃতিগুলো খুব নাড়া দিয়ে যায় কখনো কখনো।
জিসান শা ইকরাম
বাইরের প্রায় সমস্ত দেশের খাবারের স্থানগুলোতে সুন্সান নীরব, যেন জনমানব শুন্য।
আমি এমনও দেখেছি, পাশের টেবিলে বসে দুজন কথা বলছে,শুনছি না আমি।
আর আমাদের দেশে 🙂
নিজেকে নিজের মত করে পাবার জন্য একান্ত কিছু সময়ের প্রয়োজন অবশ্যই।
লেখায় আপনি প্রচুর আবেগ আনতে পারেন।
ভালো থাকুন প্রিয় ব্লগার।
রিমি রুম্মান
এখানে অনেক জনসমাগমেও হৈচৈ নেই। কেউ কারো সমস্যা করতে চায় না। ভাললাগে এমন পরিবেশ। ভাল থাকুন।
অরণ্য
স্মৃতিকাতর মনে বিষণ্ণতার ঘোর মাঝে মাঝে থাকাটাই বোধহয় ভালো, বলছি অবশ্য ১০০ভাগ দেশী অনুভূতি থেকে। মা-নানীদের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা দৃষ্টিসীমায় মিলিয়ে না যাওয়া অবধি ছুঁয়ে গেল আমায়। মনে পড়ে গেল আমার মাকে, আমার নানীকে। দেখতে পেলাম আমার বড় বোন এবং মেজো বোনকেও।
ভাল থাকবেন।
রিমি রুম্মান
প্রিয়জনদের এমন বিদায় কিন্তু মায়া বাড়িয়ে দেয়। সেই অশ্রুসজল মুখগুলো ভুলে থাকা যায়না। চাইলেও না।
সীমান্ত উন্মাদ
আমার একা থাকতে ভিসিঅন ভালো লাগে আপু। একাকিত্ব নিজেকে জানার সেরা উপায়। আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা
রিমি রুম্মান
কখনো কখনো একা থাকতে খুব মন চায় কিছুদিনের জন্যে। এতো এতো ব্যস্ততা, এতো এতো দায়িত্ব ভাল লাগে না। ভাল থাকুন।