লাঞ্চব্রেকে পাশের ফাস্টফুডের দোকানটিতে যখন খেতে যেতাম, তখন পরিচয় সত্তর ছুঁইছুঁই বয়সের মিস্টার এরন এর সাথে। কোন ভূমিকা ছাড়াই গল্প শুরু করতো। গল্পের প্রায় পুরো অংশ জুড়েই থাকতো তার একমাত্র পুত্র আর মৃত স্ত্রী। ওই সময়টাতে যেন তাকে শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা আর বিষণ্ণতায় পেয়ে বসতো। বেদনাবিধুর একটা পরিবেশে আমি তার গল্প শুনতাম আর সেই সময় চেহারায় তার শোক আর ভালবাসার বহিপ্রকাশ ঘটতো।
পাশেই একটি এপার্টমেন্টে মিস্টার এরন একাই থাকতেন একমাত্র ছেলে থাকে অন্য শহরে। পিতা-পুত্রের ফোনে কথা হয় মাঝে মাঝে। দেখা হয়না বললেই চলে। ফাদার’স ডে তে ছেলে উপহার পাঠায়, এতেই এরন ভীষণ খুশি। আমি আমার বাবাকে বিশেষ দিনটিতে উপহার পাঠাইনা শুনে সে খুব আহত স্বরে বলতো, ” তুমি তোমার বাবাকে ভালই বাসোনা “। আমিও বলতাম, ” বিশেষ একটি দিনের জন্য আমি আমার বাবাকে ভালোবাসি না… আমি ভালোবাসি প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে ।”
এরপর সূর্য উঠে, বাইরে আলো ফোটে, আবার আঁধার ঘনায়। আমি একাকি চুপচাপ লাঞ্চ করি… এরনের দেখা নেই ! এপ্রিলের এক দুপুর… কফি হাতে বাইরে দাঁড়িয়ে। এপার্টমেন্টের চারিপাশে এ্যাম্বুলেন্স, পুলিশের গাড়ী। অন্য অনেকের মতোই উৎসুক আমি ঘটনা জানবার চেষ্টা করছি। অবশেষে জানলাম, দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল বলে প্রতিবেশীরাই পুলিশে খবর দিয়েছে। একাকি এপার্টমেন্টটিতে পাঁচদিন আগেই এরনের মৃত্যু হয়েছিল।
কাজ শেষে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেই। ট্রেন ক্রমশ দূরে সরে যেতে যেতে ম্রিয়মান হতে থাকে কোলাহল। দৃশ্যমান অনেক মানুষের মাঝে অদৃশ্য এরনের মুখখানা ভেসে উঠে। আহা ! মৃত্যু কি এসেছিলো তার ঘুমন্ত শরীরের উপর দিয়ে ? শেষ সময়টাতে ছিল না কোন মমতার হাত কপালে… প্রিয়জনের ভালবাসাময় মায়াবী চাহনি… কিংবা দেয়নি কেউ মুখে দু’ফোটা তৃষ্ণার জল…!
তবে দু’ফোটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়েছিল “ভিনদেশী আমার”___বর্ষণমুখর সেই সন্ধ্যায় !! বিলিভ ইট অর নট___ সেই সন্ধ্যাটুকু অন্য দিনের সন্ধ্যা’র চেয়েও বেশী অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হয়েছিলো আমার ।
## সবকিছুর পরও আমার দেশ, আমার কালচারই ভাল। অনেক অভাব অনটনের পরও অন্তত সেখানে আছে বুকভরা ভালোবাসা,একজন বৃদ্ধের জন্য। এরন’দের মত একাকী, নিঃসঙ্গ মৃত্যু তো আর হয় না !
১৮টি মন্তব্য
বনলতা সেন
দেখুন ভোগবাদের সমাজ জীবনে এটাই স্বাভাবিক পরিণতি ।
আমাদের দেশেও ওল্ড হোম গড়ে উঠছে , জীবনের শেষ একাকিত্বের আশ্রয় স্থল হিসেবে ।
এরন ও কিন্তু তার বাবার ঠিকানা মনে রাখেনি ।
আল্লাহ, আমাদের রক্ষা করুণ সব অমানবিকতা থেকে ।
বাস্তবতা তুলে ধরেছেন সুন্দর করে ।
এমন করে একটু একটু লিখুন । অনেকদিন পর লিখলেন ।
রিমি রুম্মান
একাকী মৃত্যু চাই না… প্রিয় চেনা মুখগুলো ঘিরে থাকুক শেষ সময়টাতে …ভাল থাকুন।
শুন্য শুন্যালয়
অনেক কস্ট লাগলো পড়ে, এভাবে কি তারা কখনো ভাবে?
নিজের জন্য কি রেখেছে বিধাতাই জানে, ফিরে যেতে ইচ্ছে করে খুব দেশে, এমন লেখা আমার যন্ত্রণা আরো বাড়িয়ে দেয়
🙁
রিমি রুম্মান
ওদের জন্য হয়তো এটাই স্বাভাবিক … আমরা তো এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারি না … যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেবার জন্য দুঃখিত … ভাল থাকুন।
অপরাজিতা সারাহ
অসম্ভব কষ্ট লাগল পড়ে।সত্যি,একারনেই মনে হয়,হাজার দোষ ত্রুটির পরেও ,আমার দেশের মানুষগুলো এখনো এতটা পচে যায়নি।তাই দেশ ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও যেতে চাই না।ভালোবাসি এই দেশকে,এই দেশের মানুষগুলোকে।
http://www.youtube.com/watch?v=f7tDq4X9m5E
রিমি রুম্মান
ভালবাসি দেশকে… দেশের মানুষগুলোকে … ভাল থাকুন।
সীমান্ত উন্মাদ
সবকিছুর পরও আমার দেশ, আমার কালচারই ভাল। অনেক অভাব অনটনের পরও অন্তত সেখানে আছে বুকভরা ভালোবাসা,একজন বৃদ্ধের জন্য। এরন’দের মত একাকী, নিঃসঙ্গ মৃত্যু তো আর হয় না ! একশতভাগ সহমত। আপনার গল্প লিখনিতে ভালোলাগা রেখে গেলাম। শুভকামনা জানিবেন নিরন্তর।
রিমি রুম্মান
আপনিও ভাল থাকবেন…
খসড়া
মৃত্যু কখনই শ্যাম সমান নয়।
রিমি রুম্মান
মৃত্যু হোক প্রিয় চেনা মুখগুলোর সান্নিধ্যে … ভাল থাকুন।
ব্লগার সজীব
খুব খারাপ লাগলো । টাচি লেখা । আমাদের দেশেও কিছু সন্তান আছে , যারা মা বাবাকে বৃদ্ধ নিবাসে রাখে । এসব সন্তারের বিচার করা উচিৎ ।
রিমি রুম্মান
সেই সব সন্তানদের বিচারের প্রয়োজন নেই… তারা এমনিতেই একটা সময় অভিশপ্ত জীবন যাপন করে… ভাল থাকুন।
জিসান শা ইকরাম
খুব খারাপ লাগে পিতা মাতার এমন নিঃসঙ্গ মৃত্যুর খবর পেলে ।
আমাদের দেশে এটি এখনো শুরু হয়নি
তবে বিদেশী খারাপ বিষয়গুলো গ্রহন করার একটা বাতিক আছে আমাদের
সে বিবেচনায় শুরুও হয়ে যেতে পারে ।
নিজের দেখা ঘটনা এবং এ ঘটনায় আপনার মনের ভাব প্রকাশ করাটাই হচ্ছে একজন পারফেক্ট ব্লগারের কাজ ।
শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ ।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকবেন ভাইয়া… লিখতে চাই, কিন্তু সময় করে উঠতে পারিনা। তবুও লিখবো আশা করি।
মশাই
এমন মৃত্যু আল্লাহ যেন কাউকেই না দেন শুধু আমাকে ছাড়া। সবাইকেই কারো না কারো সান্নিধ্যে মৃত্যু দেক এই কামনা করি।
রিমি রুম্মান
কেন মশাই… কেন এই অভিমান…!! ভাল থাকুন…
ছাইরাছ হেলাল
আপনি লিখতে শুরু করেছেন দেখে ভাল লাগল ।
এই মৃত্যু আমরা কিছুতেই কামনা করি না ।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন… প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে থাকুন শেষ সময়টা… এই কামনা রইল…