“চৈতক ও মহারানা”
প্রতাপ সিং ছিলেন মেবারের মহারানা উদয় সিং এর পুত্র। মহারানা প্রতাপের কোনো রাজধানী ছিল না। তবু তিনি ছিলেন রাজপুতদের গর্ব ও অহঙ্কারের প্রতীক। ভারতে এখনো তিনি একজন কিংবদন্তীর একজন বীর। তিনি উদয় সিং এর পুত্র হলেও উদয় সিং তার অন্য পুত্র জয়মলকে তার উত্তরাধিকারী করে যান। কিন্তু রাজ্যের সভাসদরা তা মেনে নেননি। কিন্তু মহারানা প্রতাপ তার পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে চাননি। মহারানা প্রতাপ ছিলেন কাগুজে রাজা। কারন তিনি তার জীবদ্দশায় কোনো ভূখন্ড শাসন করতে পারেননি।
মহারানা প্রতাপ মোঘল সম্রাট আকবরকে শাসক হিসেবে কখনোই মেনে নেননি। সারাজীবন তিনি তার বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। আকবরও মহারানার প্রতি একটির পর একটি অভিযান করেও সফল হতে পারেননি। তাকে পরাজিত করার জন্য তার নবরত্ন সভার সদস্য আম্বরের রাজা মানসিংকে কৌশলগত মিত্রতা স্থাপনে আলোচনা করতে প্রতাপের কাছে ছয়াবার কূটনৈতিক মিশন পাঠান। কিন্তু রানা প্রতাপ প্রতিবারই তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এরই জেরে ১৫৭৬ সালের ২১ জুন বর্তমান রাজস্থানের গোগুন্দ শহরের আরাবালি পাহাড়ে হলদিঘাঁটি নামে একটি গ্রামে মোঘল ও রাজপুত বাহিনী মুখোমুখি হয়। ধারনা করা হয় মাটির রং লাল হওয়ার কারনে এ গ্রামের নাম হয় হলদিঘাঁট।
এ যুদ্ধে রানা প্রতাপের অধীনে পদাতিক সৈন্য ছিল ১৯ হাজার এবং অশ্বরোহী সৈন্য ছিল ৩ হাজার। রানা প্রতাপের সৈন্যবাহিনীকে ভাগে ভাগ করা হয়। রানা প্রতাপ ছিলেন মধ্যভাগে। অন্যদিকে মোগল বাহিনীতে সৈন্য ছিল ১০ হাজার অশ্বরোহী সৈন্য, কয়েকটি হাতি এবং পদাতিক সৈন্য। মোঘল বাহিনীকেও পাঁচভাগে ভাগ করা হয়। রাজপুতানার ইতিহাসে এ যুদ্ধের সময় সীমা ছিল ৪ ঘন্টা।
২১ জুন খুব ভোরে মোঘল সৈন্যরা অগ্রযাত্রা করে। সূর্যের আলো ফুটলে ভিল যোদ্ধারা মোঘল সৈন্যদের নদী অতিক্রম করতে দেখতে পায়। মোঘল সৈন্যরা নদী পার হয়ে খানোরের কাছে সমেত হয়। রানা প্রতাপ গর্বিত ভাবে তার শুভ্র কাথিওয়াড়ি ঘোড়ার পিঠে বসে দৃশ্য দেখছিলেন। #চৈতক বা চেতক নামের এ ঘোড়ায় চড়ে তিনি বহুবার যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তার এক হাতে ছিল বিশাল তরবারি আর এক হাতে ছিল সূর্য দেবতার ছবি অঙ্কিত মেবারের ছবি গাঢ় লাল রং এর পতাকা। ইতিমধ্যে সূর্য দেবতাও উঁকি দিয়ে ওঠে। সূর্যের তেজ বাড়তে থাকে। উভয় পক্ষের সৈন্যরা ঘামতে থাকে। মোঘলদের কামানের গর্জন নিকটতর হতে থাকে, থর থর করে কেঁপে উঠতে থাকে মাটি। এ সময় দূর থেকে ধূলি মেঘ উড়াতে উড়াতে রানা প্রতাপ তার চৈতকের পিঠে পিছনে সৈন্যবাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসে। মোঘল রাজপুত সৈন্যরা আত্মরক্ষার জন্য সরে যায়। শাণিত তরবারি ঝলসে ওঠে, ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছুটে আসতে থাকে, রণধ্বনি ওঠে। রানার সৈন্যদের হামলায় মোঘল বাহিনীর অগ্রবর্তী ও বামদিকের সৈন্য তছনছ হয়ে যায়। হলদিঘাঁটির গিরিপথে লাশের স্তুপ পড়ে। মাটি রক্তে লাল হয়ে যায়। এ যুদ্ধে রানা প্রতাপ ২৫কেজী ওজনের বর্ম এবং ৫দশমিক ৭ কেজী ওজনের বর্শা ব্যবহার করেছিলেন। এ যুদ্ধে রানার সৈন্যরা বিরত্বের বহু প্রমাণ দেয়। তুর্যধ্বনি উঠায় রানা তার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে ঘুরে দাঁড়ান। মানসিং ছিলেন তার সামনে। মানসিং তার হাতির হাওদায় বসে সৈন্যদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সাহস দিচ্ছিলেন। রানা প্রতাপ ক্ষিপ্রগতিতে মানসিংএর দিকে এগিয়ে যান। তার ঘোড়া চৈতক মানসিংএর হাতির শুঁড়ের ভেতরে পেছনের পা ঢুকিয়ে দেয়। প্রতাপ বর্ষা নিক্ষেপ করলে মানসিং মাথা নিচু করে ফেলে। এতে মানসিংএর মাহুত নিহত হয়। মানসিংএর হাতির মাহুতকে রানা মানসিং বলে ধরে নিয়ে জয়োল্লাসে ফেটে পড়েন। মানসিং এর হাতিকে বিভ্রান্ত করার জন্য তিনি চৈতকের গায়ে শিশু হাতির ন্যায় নকল পোশাক পরিয়েছিলেন। রানা ধারনা করেছিলেন মোঘলদের বিশাল বিশাল হাতি শিশু হাতিকে আক্রমণ করবে না। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। মানসিং এর হাতি শুণ্ড দিয়ে চৈতকের পেছনের পা ভেঙে ফেলে। খোঁড়া ঘোড়া কাৎ হয়ে যাওয়ায় রানা প্রতাপ নির্ভুলভাবে বর্শা নিক্ষেপে ব্যর্থ হয়। মোঘল সেনাপতি বাহালুল খান রানার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। রানার পাল্টা আক্রমণে তিনি নিহত হন। মোঘল সৈন্যদের বিপর্যয় বুঝতে পেরে কেউ একজন যুদ্ধ ময়দানে সৈন্যদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে গুজব ছড়িয়ে দেয় যে মোঘল সম্রাট আকবর যুদ্ধক্ষেত্রে হাজির হয়েছেন। এ গুজব ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভগ্নহৃদয় সৈন্যদের মাঝে চাঞ্চল্য ফিরে আসে এবং যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। আত্মবিশ্বাসই এই মোঘলদের জয়ী করে।
মোঘল সৈন্যরা রানাকে ঘিরে ফেলে। কিন্তু মনিব রানাকে বাঁচাতে এক পা ভাঙ্গা আহত চৈতক তিন পায়ে লাফাতে থাকে। চৈতক রক্তাক্ত অবস্থায় তার মনিবকে নিয়ে ছুটতে থাকে। প্রচুর রক্তক্ষরণে রানা প্রতাপ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। মাস্কেট, তরবারি ও বর্শার আঘাতে রানার শরীরে ৭টি ক্ষত হয়। এমনি বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে চৈতক মনিবকে নিয়ে ১৩মাইল পথ অতিক্রম করে। ৫মিটার প্রশস্ত একটি ছোট্র নদী ঝাঁপ দিয়ে পার হওয়ার পর আহত চৈতক মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে।
মহারানা প্রতাপ সিং ও তার ঘোড়া চৈতক ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই যুদ্ধ একটি রাজপুত উপখ্যানে পরিণত হয়েছে। উপখ্যানের প্রথম চরণটি হলোঃ ও নীল ঘোড়ে রে সাওয়ার; অর্থাৎ হে নীল ঘোড়ার আরোহী। চৈতক যেখানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সেখানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়।
১৪টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
যুদ্ধ খেলা মানুসের ক্ষতি ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি, ইতিহাস হয়েছে । কিন্তু পৃথিবী কখনও শান্তিময় ছিলনা, এই শান্তির জন্য একদল খাতা কলমে আর একদল কবিতা সাহ্যিত্যে আন্দলন করেছেন আর বিপক্ষে একদল স্বরথের জন্য অশান্তি করে গেছেন। এই জা।
আপনাকে ধন্যবাদ নতুন ভাবে ইতিহাস পড়তে উদসাহিত হচ্ছি।
মৌনতা রিতু
যুদ্ধ অবশ্যই কখনোই মঙ্গল বয়ে আনে না। এই যুদ্ধের মাদ্যমেই শেষ হইছে বহু সভ্যতা, বহু সঠিক ইতিহাসের দলিলপত্র। ইতিহাস আমার সব সময়ই প্রিয়। আমি চেষ্টা করি এটাকে সহজ করে পড়ার ও লেখার।
ধন্যবাদ ভাই পাশে থাকার জন্য। ভাল থাকবেন। লেখা দিন।
মোঃ মজিবর রহমান
ধন্যবাদ আপু।
জিসান শা ইকরাম
ইতিহাসে যুদ্ধ সবচেয়ে বেশি স্থান দখল করে আছে।
রানা প্রতাপ আর মানসিং এর এই যুদ্ধের ইতিহাস এত বিস্তারিত ভাবে জানতামনা।
এই পোস্টের জন্য ধন্যবাদ তোমাকে।
তোমার ইতিহাস ভিত্তিক লেখা পড়ে ইদানিং আমিও ইতিহাস নতুন করে পড়া শুরু করেছি। ভাবছি আমিও কিছু পোস্ট করব কিনা।
মৌনতা রিতু
আমার খুব ভাল লাগে ইতিহাস পড়তে। ভাইয়া, লেখেন। আমিও আরো কিছু জানতে পারব।
আপনার অতি স্নেহই আমাকে এতো সাহস দেয় লেখার। দোয়া করবেন যেন সুস্থ থাকি।
শুন্য শুন্যালয়
মহারানা প্রতাপ সিং এর নাম খুবই প্রশিদ্ধ একটি নাম, তবে বিস্তারিত কিছুই জানা ছিলোনা। সত্যি বলতে ইতিহাস খুব ভয় পেতাম, যা তোমার কারনে এখন গল্পের মতো ইজি লাগছে।
মহারানা প্রতাপ যদি ভুখন্ড শাসন করতে না পারে, তাহলে যুদ্ধ করতো কী কারনে? আই মিন উনার বাবা তো তাকে কিছু দেন নি।
চৈতকের মতো কিছু চরিত্র আছে বলেই ভ্রম হয়, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব কিনা।
বরাবরের মতোই পাশ করেছো ভাবীজান 🙂 মন দিয়ে পড়াশোনা করো 🙂
মৌনতা রিতু
তুমি তো জান, ঢখন রাজাদের অনেক রানী ও উপপত্নী ছিল। রাজার উপর যে রানীর প্রভাব বেশী থাকতো সাধারণত তার সন্তানই পরবর্তী রাজা হিসেবে ঘোষণা করা হতো। মেবরের রাজা উদয় সিং এর পুত্র ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। কিন্তু উদয় সিং তার প্রিয় পুত্র জগমলকে মেবরের উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনীত করেন। কিন্তু রাজসভার সভাসদরা তা মেনে নেননি। তারা চেয়েছিলেন রানা প্রতিপই যেন সিংহাসনে বসেন। কিন্তু রানা প্রতাপ তা করেননি। তিনি মোঘলদের সাথে যুদ্ধ করে গেছেন কারণ, তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে ও রক্তে একজন রাজপুত। তাই কখনোই সে মোঘলদের দ্বারা ভারতবর্ষের শাষণ মেনে নেননি। এজন্য তিনি সেই কিশোর বয়স থেকেই মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যায়।
দারুন একটা প্রশ্ন করেছো। আমি চাই কেউ এমন ছোট ছোট প্রশ্ন করুক।
সত্যিই এসব প্রাণী মানুষের থেকেও বিশ্বাসী।
ননদরা যখন পাশ করায় মানে পোষ্ট ঠিক হইছে। ধন্যবাদ -{@
নীহারিকা
মহারাণা প্রতাপ সিং সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। এরাই বীর যারা সিংহাসনের লোভ না করে দেশের জন্য কাজ করেন। পা ভেংগে যাবার পরও মনিবকে নিয়ে চৈতকের এ দীর্ঘযাত্রা অবাক করেছে আমাকে।
খুব ভালো লেগেছে লেখাটি।
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ -{@ আপনি দিপু মাহমুদের বুসেফেলাস পড়ে দেখতে পারেন।
রানা প্রতাপ আসলেই একজন দেশ প্রেমিক ছিলেন।
ভাল থাকবেন পাশে থাকবেন।
ছাইরাছ হেলাল
এই প্রথম জানলাম, যাক আমার পড়া আপনই পুষিয়ে দিচ্ছেন, ভালই হয়েছে।
অটোম্যানদের অপেক্ষায় আছি কিন্তু।
মৌনতা রিতু
তাই না! আচ্ছা, অটোম্যানদের নিয়ে লিখব।
পাশে আছেন বলেই সাহস পাই লিখতে। ভাল থাকুন কবি।
ব্লগার সজীব
আপু আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এত সহজ ভাবে ইতিহাস বুঝানোর জন্য।
মৌনতা রিতু
কিন্তু এই ছাত্র অনুপস্থিত থাকলে চলবে কেমন করে!
কেমন আছেন ভাই? এইরকম করে ভুলে থাকলে চলবে!
তবে সব সময়ই ভাল থাকুন এই কামনা।
ইঞ্জা
দুর্দান্ত এই ইতিহাসটি জানা ছিলোনা আপু, আজই জানলাম, অবশ্য রানা প্রতাপ সিংয়ের নাম শুনেছি আগে।